• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
কুসিকে জয়-পরাজয় বিশ্লেষণ

কৌশলী বিএনপিতে ডুবেছে আ. লীগ


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ১, ২০১৭, ০৪:৫৩ পিএম
কৌশলী বিএনপিতে ডুবেছে আ. লীগ

ঢাকা: দলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-অবিশ্বাস ও কোন্দল এবং নির্বাচনী কৌশলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে পেরে না উঠায় ক্ষমতাসীন সমর্থিত নৌকার প্রার্থী কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান ও রাজনীতিবিদ আঞ্জুম সুলতানা সীমার পরাজয় ঘটেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে, দলে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব থাকলেও তা ভোটারদের মধ্যে প্রভাব পড়তে না দেওয়ার কৌশলগত ভুলের কারণে সিটির মেয়র পদে পরাজয়ের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না ক্ষমতাসীন সমর্থিত প্রার্থীরা। এছাড়া স্থানীয় রাজনীতিতে দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব ছাড়াও আরো ছয় কারণে নৌকার ভরাডুবি ত্বরান্বিত করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা।

জয়-পরাজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনীত প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানাও স্থানীয় আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতার ষড়যন্ত্রের কারণে তার পরাজয় হবে মন্তব্য করেছেন। তার এ পরাজয়ের জন্য দলীয় নেত্রীর কাছে লজ্জিত বলেও একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন।

অপরদিকে ধানের শীষের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর ধারাবাহিক বিজয়ের নেপথ্যের কারণ নির্বাচনী কৌশল বলে দলটির নেতারা দাবি করেছেন। তাদের অভিমত, বুকে নৌকা অন্তরে ধানের শীষ নির্বাচনী কৌশল ছিল বিএনপি প্রার্থীর জয়ের অন্যতম কারণ।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রকাশিত নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণের তথ্যমতে, স্থগিত দুটি কেন্দ্রের ভোট বাদে ১০১ কেন্দ্রের মধ্যে সাক্কু ৬৭ কেন্দ্রে এবং সীমা ৩৪ কেন্দ্রে বেশি ভোট পেয়েছেন। এ ছাড়া ১০টিতে ৮০ শতাংশের ওপরে ভোট পড়া কেন্দ্রগুলোতে জিতেছেন সীমা।

আর ঝাঙ্গালীয়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে ৯০.৮৫ ভাগ। আর বাঁদুরতলা নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সর্বনিম্ন ভোট পড়েছে ৪৪.৪২ ভাগ। এছাড়া ৩১ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশের নিচে; যার মধ্যে সবকটিতেই জিতেছেন সাক্কু।

অর্থাৎ বেশি ভোট পড়া কেন্দ্রে নৌকার সীমা এবং কম ভোট পড়া কেন্দ্রগুলোতে সাক্কু জয়ী হয়েছেন। তার পরও দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হওয়ার ক্ষেত্রে তার জয় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

রাজনৈতিক নেতা এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সুস্থ রাজনৈতিক ধারার যে সংস্কৃতি ফিরে এসেছিল কুমিল্লায় সিটি নির্বাচনে পুরনো চিত্রের প্রতিফলন দেখা গেছে। মানুষের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে এ সিটি নির্বাচনে।

বলা যায়, ১০৩টি কেন্দ্রের প্রত্যেকটিতে দুপুর ১২টার পর প্রকাশ্যে জালভোট, কেন্দ্র দখল করে ব্যালট ছিনতাই, ভোট কর্মকর্তাদের মারধর এবং ভাড়া করা নেতাকর্মীদের শোডাউন ছিল ফলাফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত। কিন্তু বিভিন্ন কেন্দ্রের ফল আসতে শুরু করলে নৌকা প্রার্থীর পরাজয় হচ্ছে নিশ্চিত হয়েই সটকে পড়তে থাকেন নৌকার দলীয় কর্মী-সমর্থকরা। অপরদিকে ধানের শীষের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর দেখা যায়, গলায় নৌকা প্রতীকের কার্ড ঝোলানো কিন্তু সাক্কুর বিজয়ে শামিল তারাও।

এছাড়া দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আফজাল পরিবারের দুঃশাসন-নির্যাতন ও অন্যের সম্পত্তি জবরদখল, নির্বাচনী পরিকল্পনার অভাব এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে সমন্বয় না করে একজন মন্ত্রীর পাঠানো ভাড়া করা নেতা-কর্মীদের দিয়ে নির্বাচন উঠানো চেষ্টা ছিল পরাজয়ের কারণগুলোর একটি। তাছাড়া সদর ক্ষমতাসীন এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও তার কর্মী-সমর্থক এবং পরিকল্পনামন্ত্রীর মধ্যে সমঝোতাও পরাজয় হয়েছে বলেও স্থানীয় নেতাদের অভিমত, যা খোদ নৌকার প্রার্থীর বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে।

পাশাপাশি নৌকার ভোটব্যাংক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুরো ভোট না পাওয়া, কর্মীদের জন্য প্রার্থীর দেওয়া নির্বাচনের খরচের টাকা নেতাদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়া এবং স্থানীয় নেতাদের উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশি গুরুত্ব দেওয়াও পরাজয়ের নেপথ্য হিসেবে কাজ করেছে এ সিটি নির্বাচনে।

অপরদিকে কুমিল্লায় ধানের শীষের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। রয়েছে সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু পরিবারের ইমেজ, প্রতিপক্ষ প্রার্থীর বিরোধী পক্ষকে হাতে রাখা, আফজাল খান এবং তার সন্তানদের দ্বারা নির্যাতিতদের সব সময় আশ্রয় দেওয়া, নিজ দল ও জোট-নেতাকর্মীদের সঙ্গে সর্বদা মিশে থাকা এবং দায়িত্বের পাঁচ বছরে নিজের ব্যর্থতার কথা ভোটারদের কাছে স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া এবং আধুনিক সিটি গঠনে তার অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে তাকে আরেকবার সুযোগ দিতে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাওয়া এবং ভোট প্রার্থনার কৌশল জয়ের ভীত গড়ে দেয় বলে স্থানীয় নাগরিক ও দলীয় কর্মীরা জানিয়েছেন।

এমনকি ধানের শীষের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ‘নির্বাচনের আগে থেকে শেষ পর্যন্ত এবং বিজয়ের পরও বলছি নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আমিই জিতব। তার ফল আপনারা দেখতে পেয়েছেন। তবে ব্যাপক ভোট কারচুপি না করলে জয়ের ক্ষেত্রে ভোটের ব্যবধান অনেক বেশি হতো।’ আর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, বিএনপির নির্বাচনী কৌশলের কারণে ধানের শীষের প্রার্থীর বিজয় হয়েছে।

অপরদিকে নৌকার প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা বলেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র নৌকার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, ‘আমার চাওয়া-পাওয়ার কিচ্ছু নেই। বঙ্গবন্ধুর কন্যা আমাকে মনোনীত করেছিলেন। নৌকা প্রতীক আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন। কুমিল্লার সর্বস্তরের জনগণ আমার পাশেই ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আওয়ামী লীগের কিছু ব্যক্তিবিশেষের ষড়যন্ত্রের জন্য আমি শেখ হাসিনার কাছে আজ লজ্জিত।’

এর আগে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ নৌকার পরাজয়ের বিষয়ে বলেন, দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে সীমার পরাজয় হয়েছে। এ ছাড়া কুমিল্লার আওয়ামী লীগের স্থানীয় দুজন নেতা মামুন ও আবুল খায়ের দলীয় দ্বন্দ্বের বিষয়ে বলেন, ‘আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক তারা আছি আপনার সাথে সব সময়।’ অপরজন বলেন, আপনি লজ্জিত নন, লজ্জিত তারা যাদের কারণে বঙ্গবন্ধুর নৌকার পরাজয় হয়েছে।

আওয়ামী লীগের একজন উপজেলা চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দলীয় কোন্দল নয়, প্রার্থী নির্বাচনে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে নৌকার পরাজয় হয়েছে। কারণ ওই পরিবারের প্রতি মানুষের একটা নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। পাশাপাশি সদর দক্ষিণের ওয়ার্ডগুলো থেকে যেভাবে ভোট পাওয়ার কথা ছিল সেটা না পাওয়ায় পরাজয় এড়ানো যায়নি। তবে গত সিটির তুলনায় ভোটের ব্যবধান কমেছে।

এটা দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে ঐক্যের ফল। অপরদিকে এই কুমিল্লায় বিএনপির শক্ত অবস্থান রয়েছে। একজন সাবেক ছাত্রনেতা ও আইনজীবী নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, সদর এমপির সঙ্গে সমন্বয় না করে একজন মন্ত্রীর ভাড়া করা লোকদের দিয়ে নির্বাচন করানোর কারণে নৌকার পরাজয় হয়েছে।

আর নির্বাচনের কৌশলে ভুল থাকার সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে নির্বাচন সমন্বয় করার জন্য একজন আহ্বায়ক ছিলেন, তারা ভোটের কথা না ভেবে দলীয়ভাবে টাকা ব্যয় না করে নিজেরা টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন, ফলে পরাজয় এড়ানো সম্ভব হয়নি।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বলেন, কুসিক সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ সব কেন্দ্রেই দখল ও ভোট কারচুপির ঘটনা ঘটেছে। এত বেশি কারচুপির পরও নৌকার প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে দুপুরে আগে অধিকাংশই ভোটার ভোট দেওয়ার কারণে।

আর জানিপপের চেয়ারম্যান ও ঢাবির অধ্যাপক নাজমূল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, সুস্থধারা রাজনীতি থেকে আবার কুসিক নির্বাচন অসুস্থ ধারায় ফিরে গেছে। ভোট কারচুপির মহোৎসব চলেছে, যা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। তবে জয়-পরাজয় এ ক্ষেত্রে নৌকার নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!