• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রসফায়ার চলুক, তবে কোন নিরপরাধ যেন মারা না পড়ে


আবু সাঈদ সজল মে ২৪, ২০১৮, ১১:০২ এএম
ক্রসফায়ার চলুক, তবে কোন নিরপরাধ যেন মারা না পড়ে

ঢাকা : কান্নাকাটি করে ক্রসফায়ার নিবারণ করা সম্ভব নয়। আইনের মাধ্যমে বড় বড় মাদক সম্রাটদের ফাঁসি দিয়ে বাদবাকীদের সেই অপরাধের শাস্তির ভয় দেখিয়ে অপরাধ প্রবণতা কিছুটা কমানো সম্ভব। তা না হলে কিছু মাদক ব্যবসায়ীদের মেরে ফেলে বাকিদের ভয় দেখালেও সমস্যার সমাধান হতে পারে। ক্রসফায়ার দিয়ে এভাবে আম-বাগানে মারার কোনও যুক্তিকতা নেই। তবে এনিয়ে বেশিরভাগ মানুষের বিশেষ কোন মাথাব্যাথা নাই, বরং একটু সতর্ক একটা সমর্থন আছে-ক্রসফায়ার চলুক, শুধু কোন নিরপরাধ যেন মারা না পড়ে। ‘বিচারবহির্ভ‚ত হত্যা’ বা ‘ক্রসফায়ার’ সন্ত্রাস দমনের নামে এ খেলা শুরু হয় খালেদা-নিজামীর জোট সরকারের সময়ে। বর্তমান সরকারও ‘বিচারবহির্ভ‚ত হত্যা’ বা ‘ক্রসফায়ার’এর মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘দল ক্ষমতায় গেলে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে।’

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ‘ক্রসফায়ার মৃত্যু’গুলো ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ হলেও সরকারের তদন্তে এসব ঘটনাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এসব তদন্তে দেখা হয়, কোন পরিস্থিতিতে গুলি ছোড়া হয়েছিল এবং গুলি ছোড়ার মতো আদৌ কোনো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল কি না। কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে গুলি ছোড়া যুক্তিযুক্ত না হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি ঘটনার তদন্তও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যারা ক্রসফায়ারের নামে লাইন অব ফায়ারে সরাসরি নিহত হয়েছে তাদের বেলায় কোন আইন কার্যকর ছিল বলে মনে হয় না। ক্রসফায়ারের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটে রাতের অন্ধকারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিটি ঘটনার একই বর্ণনা দেয়। বলা হয়, বন্দুকযুদ্ধের কথা। কিন্তু হতাহত হয় এক পক্ষে। এসব বর্ণনার সত্যতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়। মানুষ এসব বর্ণনা বিশ্বাস করে না।

বাংলাদেশের চেয়ে আরও বেশি অপরাধ বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পৃথিবীর আরও অনেক দেশ সংঘটিত হচ্ছে। সেসব দেশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সরকার বা রাষ্ট্র নির্দেশ দিচ্ছে না। কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে পারে না। গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে সরকার অঙ্গীকার করে ক্রসফায়ারে হত্যার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানো হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি মে মাসে জেনেভায় মানবাধিকারবিষয়ক এক পর্যালোচনা সভায় বলেছিলেন, বর্তমান সরকার বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হকও বলেছেন, ‘ক্রসফায়ার বলে কিছু নেই।’ এখন ক্রসফায়ারকেই শেষ ভরসা মানলে বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্যপদ ত্যাগ করা।

২৭ অক্টোবর ২০০৯, দৈনিক সংবাদ-এ মুক্ত আলোচনায় লিখা হয়েছে, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দাবি করেছেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে না।’ কিন্তু ক্রসফায়ারের নামে তো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে - সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা গুলি চালাবে, আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুলি খাবে?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মর্মার্থ হলো ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আত্মরক্ষার স্বার্থেই গুলি করে সন্ত্রাসী মারতে বাধ্য হচ্ছেন।’

২৪ অক্টোবর ২০০৯, প্রথম আলো’র সম্পাদকীয়তে লিখা হয়েছে, ‘গত ৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুস্পষ্টভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘এনকাউন্টার’-এর সমালোচনা করেন। সেদিন তিনি এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রত্যয়ও ঘোষণা করেন। তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারেও এটা বন্ধের প্রতিশ্রুতি ছিল। অথচ কী নিষ্ঠুর পরিহাস! স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী লাগাতারভাবে ‘ক্রসফায়ার’-এর নামে বেআইনি হত্যাকে নানাভাবে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন, সাফাই গাইছেন। উন্মত্ত জনতার দ্বারা পিটিয়ে হত্যা কিংবা খুনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাণ্ডের পার্থক্য তাহলে কোথায়? অপরাধী ও আইনের রক্ষকদের আচরণের মধ্যে যখন পার্থক্য লোপ পায়, তখন আসলে আইনের শাসনই হুমকির সম্মুখীন হয়।’ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের এই বিষয়ে লাগামছাড়া বক্তব্য বন্ধ করা উচিত।

কোন সভ্য সমাজে বিনাবিচারে মানুষ হত্যা চলতে পারে না। আইনের শাসন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এক সঙ্গে চলতে পারে না। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সরাকারের ওপর খুশী নয়। শুধু তাই নয়, এদেশের সাধারণ জনগণ তথা সচেতন সুশীল সমাজও বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকে অমানবিক বলে দাবি করছে। তাই ‘বিনাবিচারে মানুষ হত্যা’ বা ‘ক্রসফায়ার’ নয় সন্ত্রাস দমনে প্রচলিত আইনের সংস্কার ও আইনের শতভাগ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক।

মিথ্যা মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার অভিযোগ

জানা গেছে (২৩ মে ২০১৭) চট্টগ্রামে হাবিবুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে মিথ্যা মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার অভিযোগ উঠেছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে। নিহতের পরিবারের দাবি, গত বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর মোমিন রোড ঝাউতলা মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হওয়ার পর সাদা পোশাকধারী কয়েকজন তাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে তাকে হত্যা করে র‌্যাব।

তুলে নিয়ে হত্যার অভিযোগ

এদিকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ-চাপরাইল সড়কে সব্দুল মন্ডল নামে এক ব্যক্তিকে মাদক ব্যবসায়ী সন্দেহে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মেওে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। সূত্রে জানাযায়, গত ২০ মে ২০১৭ তারিখ ঝিনাইদহের নরেন্দ্রপুর পুলিশ চেকপোস্টের কাছে র‌্যাব একটি তল্লাশিচৌকি বসায়। এ সময় দুটি মোটরসাইকেলে করে বেশ কয়েকজন ওই সড়ক দিয়ে যাচ্ছিল। র‌্যাবের সন্দেহে হলে গুলি চালায় একপর্যায়ে সব্দুল নামে একজন নিহত হয়। তবে পরিবারের দাবি ২০ তারিখ বিকেলে সব্দুল  বাড়ির পাশের একটি শসাখেতে কাজ করছিলেন। এমন সময় সাদাপোশাকে ছয় থেকে সাতজন এসে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর রাতে মাঠের মধ্যে ক্রসফায়ারে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।

এভাবে হাবিবুর ও সব্দুলের মতো নিরীহ নাগরীক মারা মেরে মাদক নিরাময় প্রশ্নেই উঠেনা। সঠিক তদন্ত করে মাদক সম্রাটদের মেরে অবশ্য কিছুটা হলেও মাদক নিরাময় সম্ভব। তবে সন্দেহের বশবর্তী কিংবা ব্যক্তি স্বার্থে নিরপাধ লোকদের এভাবে মেরে ফেলা কোনও বৈধ রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের কাম্য নয়। তাই বিনা অপরাধে একটি ক্রসফায়ারও নয়, সরকারকে এটা বন্ধের জন্য সরবে ঘোষণা দিতে হবে এবং সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মাদক সম্রাটদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দোষীদের দিতে হবে ক্রসফায়ার কিংবা ফাঁসি। তবে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে মিথ্যা মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার শিকারে কোনও নিরপরাধ ব্যক্তি যেন মারা না পড়ে।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!