• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষতিকর গ্যাসে বাড়ছে বজ্রপাত!


বিশেষ প্রতিনিধি মে ১, ২০১৮, ০১:২৯ পিএম
ক্ষতিকর গ্যাসে বাড়ছে বজ্রপাত!

ঢাকা : কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে বাড়ছে বজ্রপাত। বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে করণীয় নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর সচেতনতামূলক প্রচারণাও বাড়িয়েছে। মে-জুন মাস কালবৈশাখীর মৌসুম হওয়ায় বজ্রপাত স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু গত কয়েক বছরের বজ্রপাত স্বাভাবিক দুর্যোগ হিসেবে দেখছেন না গবেষকরা।

বজ্রপাতের কারণ অনুসন্ধানে বৈজ্ঞানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো গবেষণা এখনো বিশ্বের কোথাও নেই। তবে পরিবেশ ও তড়িৎ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে সম্ভাব্য বেশ কিছু কারণকে দায়ী করছেন।

তাদের মতে- জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, বাতাসে সালফার ও নাইট্রোজেনের যৌগ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘটতে পারে বজ্রপাতের ঘটনা। আর এসব কারণের পেছনে তাদের রয়েছে বৈজ্ঞানিক যুক্তিও।

একই সঙ্গে মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ারও অস্বাভাবিক বজ্রপাতের জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা। আর বজ্রপাতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার পেছনে ব্রিটিশ শাসনামলে স্থাপন করা ধাতব পিলার চুরি হওয়াকেও দায়ী করছেন তারা।

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, স্বাভাবিক বায়ুতে ৭৮ দশমিক শূন্য ৯ ভাগ নাইট্রোজেন, ২০ দশমিক ৯৫ ভাগ অক্সিজেন, দশমিক ৯৩ ভাগ আর্গন ও দশমিক শূন্য ৩৯ ভাগ কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং সামান্য পরিমাণ অন্যান্য গ্যাস থাকে।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার বাতাসের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ৬৪-১৪৩ মাইক্রোগ্রাম সালফার ডাই-অক্সাইড বিদ্যমান। আর প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড রয়েছে ২৫-৩২ মাইক্রোগ্রাম, যা স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।

বজ্রপাতের কারণ হিসেবে ঝড়ো বাতাসের প্রভাবে দ্রুতগতির কালো মেঘের মধ্যকার ঘর্ষণ ও সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হওয়া ইলেকট্রনের (স্থিরবিদ্যুৎ) প্রবাহকেই দায়ী করা হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় ইলেকট্রনের প্রবাহই বিদ্যুৎ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাদা মেঘের উপাদানের অধিকাংশই জলীয় বাষ্প বা পানি কণা হয়ে থাকে। ফলে সাদা মেঘের ঘর্ষণে যথেষ্ট ইলেকট্রন সৃষ্টি হয় না। কিন্তু কালো মেঘে নাইট্রোজেন ও সালফার গোত্রে যৌগ গ্যাসের পরিমাণ বেশি থাকায় দ্রুতগতিতে সংঘর্ষে প্রচুর ইলেকট্রনের সৃষ্টি হয়। আর এসব ইলেকট্রন বাতাসের জলীয় বাষ্পকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে চলে আসে এবং সৃষ্টি হয় বজ্রপাতের।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে অতিমাত্রায় নাইট্রোজেন, সালফার ও কার্বন গ্যাসের নিঃসরণের পরিমাণ বেড়েছে। এসব গ্যাস মেঘের জলীয় কণার সঙ্গে মিশে যায়। মে-জুন মাসে ঋতু পরিবর্তনের কারণে বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প সৃষ্টি হয়। ফলে স্বাভাবিক বায়ু প্রবাহের কারণে এসব জলীয় বাষ্প উপরের দিকে উঠতে থাকে।

গবেষকরা বলছেন, কালো মেঘে থাকা যৌগ গ্যাসগুলো রোদের তাপে এবং বাতাসের দ্রুতগতির কারণে প্লাজমা (বিক্রিয়ার অনুকূল) অবস্থায় থাকে। এতে করে সামান্য ঘর্ষণে এসব যৌগ গ্যাস পরস্পরের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটায়, ফলে সৃষ্টি হয় অ্যাসিড রেইন (অম্লবৃষ্টি) আর প্রচুর পরিমাণ ইলেকট্রন। মেঘের জলীয় কণায় এসব গ্যাসের পরিমাণ যত বাড়বে ইলেকট্রন বা বিদ্যুৎ সৃষ্টির পরিমাণও ততটা বাড়বে।

বজ্রপাতের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের সাবেক প্রধান ও বর্তমান সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মো. আবদুল মতিন এসব তথ্য দেন।

তিনি বলেন, প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কার্বন, নাইট্রোজেন ও সালফার গ্যাসের পরিমাণ যত বাড়বে বজ্রপাতের পরিমাণও তত বাড়তে থাকবে।

আবদুল মতিন বলেন, একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগাভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। বাসাবাড়িতে আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি তার ক্ষমতা মাত্র ২২০ ভোল্ট। শিল্পকারখানায় ১২০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। আর জাতীয় গ্রিডে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১১০ ভোল্ট বিদ্যুৎই যথেষ্ট।

বজ্রপাতের অন্যতম কারণ কালো মেঘের উপাদান সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব বলেন, ‘বজ্রপাতের কারণ নিয়ে আমাদের তেমন কোনো গবেষণা নেই। তবে সৃষ্টির শুরু থেকেই বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে।’

অধ্যাপক মাহবুব বলেন, ‘কালো মেঘে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ সালফার ও নাইট্রোজেনের বেশ কিছু যৌগ গ্যাস বিদ্যমান থাকে। বায়ুমণ্ডলের অন্যতম উপাদানগুলো হলো অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড। কিন্তু বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে সালফার ও নাইট্রোজেনের অন্যান্য যৌগিক গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গেছে। শিল্পকারখানার নির্গত টক্সিড গ্যাসগুলো জলীয় বাষ্পের সঙ্গে একত্রিত হয়ে কালো মেঘের সঙ্গে মিশে যায়।’

তিনি বলেন, আসলে আমাদের এ বিষয়ে কোনো গবেষণা না থাকায় আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না এসব টক্সিড গ্যাস বজ্রপাতের জন্য দায়ী। তবে এসব গ্যাসের পরিমাণ বায়ুমণ্ডলে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কাজী দীন মোহাম্মদ খোশরু বলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ভ‚মি জরিপের সুবিধার্থে যেসব ধাতব সীমানা পিলার বসিয়েছিল সেগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে বজ্রনিরোধক হিসেবে কাজ করত। কারণ এসব পিলার কপার (তামা) ও জিঙ্কের (দস্তা) মিশ্রণে সঙ্কর ধাতবের তৈরি ছিল। উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ সুপরিবাহী হওয়ায় বজ্রপাতের তড়িৎ প্রবাহটা আগে এই পিলারগুলো টেনে নিত। কিন্তু এগুলো চুরি হয়ে যাওয়ার কারণে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থাটা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ক্ষয়ক্ষতিও বেড়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!