• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গতি হারাচ্ছে ট্রেন


বিশেষ প্রতিনিধি অক্টোবর ২০, ২০১৮, ০৬:০১ পিএম
গতি হারাচ্ছে ট্রেন

ঢাকা : পুরোনো রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকমতো করতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে দেশে মোট রেললাইন রয়েছে ২ হাজার ৯২৯ কিলোমিটার। তার মধ্যে মানসম্পন্ন রেললাইন মাত্র ৭৩৯ কিলোমিটার বা ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ।

সে অনুযায়ী, দেশের ২ হাজার ১৯০ কিলোমিটার বা ৭৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নির্ধারিত মান ছাড়াই চলছে। ফলে ট্রেনগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রেললাইনে গতি তুলতে পারছে না। ২০০১ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের প্রায় পুরোটাতেই ৮০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করদো। বর্তমানে গতি কমিয়ে চলছে ৭২ কিলোমিটারে। ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পর্যন্ত রুটে ৬৫ কিলোমিটারের বদলে ৫০ কিলোমিটারেরও কম গতিতে ট্রেন চলছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের যন্ত্রাংশের সংকট ও চুরি, লোকবলের অভাব, রেললাইনের ওপর মানুষের চলাচল এবং রেললাইনের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য ব্যালাস্ট পাথর না পাওয়ার কারণে দেশের রেললাইনের এখন বেহাল দশা। আর ওসব সমস্যার সমাধান না করে শুধু নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হলে রেলওয়ের আধুনিকায়নের সুফল পাওয়া যাবে না সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ফিশপ্লেট দিয়ে রেললাইনের একটি পাতের (রেল) সঙ্গে আরেকটি পাতকে যুক্ত করে রাখা হয়। কিন্তু ওই ফিশপ্লেট ঢিলে হয়ে যাওয়ায় রেললাইন বেঁকে যায়। তাতে ট্রেনের গতিও ঠিক থাকে না। সেজন্য প্রায়ই ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

সূত্র জানায়, নতুন রেললাইনে কোনো ধরনের সমস্যা নেই। তবে পুরোনো রেললাইনে সমস্যা প্রকট। অভিযোগ রয়েছে- রেললাইন ঠিক রাখার জন্য ওয়েম্যান, গ্যাংম্যান ও কীম্যানদের পাওয়া যায় না। তারা ঠিকমতো রেললাইন মেরামত করে না। ব্রিটিশ আমলে কাঠের সিøপার দিয়ে রেললাইন নির্মাণ করা হতো। কাঠের স্লিপারের স্থায়িত্ব কম থাকায় বর্তমানে কংক্রিটের স্লিপার স্থাপন করা হয়। সিমেন্ট, বালু ও রড দিয়ে তৈরি করা হয় কংক্রিটের স্লিপার। ডুয়েল গেজের কংক্রিটের একটি স্লিপারের ওজন ৩৫০ কেজি, ব্রড গেজের ৩০০ কেজি এবং মিটার গেজের স্লিপারের ওজন ২৫০ কেজি। একইভাবে দৈর্ঘ্যও কমবেশি হয়ে থাকে। ওই কংক্রিটের স্লিপারের ওপর ইস্পাত লাইন বসানো হয়। রেলওয়ের প্রকৌশলীদের দাবি- বাংলাদেশে এখন যে ধরনের রেললাইন তৈরি হচ্ছে, তার ওপর দিয়ে একশ কিলোমিটারের কিছু বেশি গতিতে ট্রেন চলানো সম্ভব।

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশে রেলওয়ের ইতিহাস দেড়শ বছরেরও বেশি। তবে স্বাধীনতার পর  থেকে এখন পর্যন্ত এদেশে রেললাইন বেড়েছে ৭১ কিলোমিটার। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর ব্রিটিশ শাসনামলে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতী পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার লাইন দিয়ে ওই অঞ্চলে রেলওয়ের যাত্রা শুরু হয়। আসাম-বাংলা রেলওয়ে থেকে পাকিস্তান আমলে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে (ইবিআর) এবং স্বাধীন দেশে নাম হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। ভারত বিভক্তিতে ইবিআর উত্তরাধিকার সূত্রে পায় ২ হাজার ৬০৬ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার রেললাইন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ রেলওয়ে পায় ২ হাজার ৮৫৮ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেললাইন। তবে বিগত ২০১০-১১ অর্থবছরে রেললাইন কমে হয় ২ হাজার ৭৯১ কিলোমিটার।

কিন্তু পরের বছর ২০১১-১২ সালে রেললাইন বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮৭৭ দশমিক ১০ কিলোমিটার। ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত সংখ্যাটি একই থাকে। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট রেললাইন দাঁড়ায় ২ হাজার ৯২৯ দশমিক ৫০ কিলোমিটারে। বিগত ৪৮ বছরে ৭০ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার রেললাইন বেড়েছে। কিন্তু ৯০ দশকে বিশ্ব ব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলো রেল খাতে ঋণ দেয়া তলানিতে নামিয়ে আনে। আর ওই সময় বাংলাদেশ রেলওয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় সড়কপথে অর্থ বরাদ্দ হতে থাকে। ফলে ওই সময় থেকে এদেশে রেলওয়ে সেক্টর অবহেলিত হয়ে পড়ে। বয়সের ভার, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব আর লোকবল সংকটে রেললাইন ও ইঞ্জিনগুলো ধুঁকতে থাকে।

রেলওয়ের প্রকৌশলী বিভাগ থেকে ১৪টি রুটকে মানসম্পন্ন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো পার্বতীপুর-পঞ্চগড় ১৩২ কিলোমিটার, কাঞ্চন-বিরল সীমান্ত ১২ কিলোমিটার, লালমনিরহাট-বুড়িমারী ৮৫ কিলোমিটার, রাজশাহী-রোহনপুর সীমান্ত ৮৫ কিলোমিটার, আমনুরা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১৩ কিলোমিটার, মাঝগ্রাম-পাবনা ২৫ কিলোমিটার, টঙ্গী-ভৈরববাজার (ডাউন লাইন) ৬৪ কিলোমিটার, লাকসাম-চিনকী আস্তানা (ডাউন লাইন) ৫১ কিলোমিটার, ষোলোশহর-দোহাজারী ৪১ কিলোমিটার, লাকসাম-চাঁদপুর ৩১ কিলোমিটার, কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া ৭৫ কিলোমিটার, কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ-গোবরা ৪৭ কিলোমিটার, পাচুরিয়া-ফরিদপুর ২৫ কিলোমিটার, পাবনা-ধালারচর ৫৩ কিলোমিটার। কিন্তু মাত্র ৭৩৯ কিলোমিটার মানসম্পন্ন রেললাইনের বাইরে বাকি ২ হাজার ১৯০ কিলোমিটার রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে সত্তে¡ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ওসব রেললাইনকে মানহীন বলতে নারাজ। যদিও পুরোনো রেললাইন দিয়েই দেশে ট্রেন সার্ভিস সচল রাখা হচ্ছে। তবে নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পেরও কাজ চলছে। পাশাপাশি পুরোনো রেললাইনগুলোও সংস্কার করা হচ্ছে।

রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১১-১৫ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ৪৩ হাজার ৫০৯ কোটি ৮০ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। আর ২০১৬-২০ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ওই খাতে ৬৬ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্পের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তার মধ্যে নতুন ৮৫৬ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ, এক হাজার ১১০ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ এবং ট্রেনের গতি বাড়ানো ও নিরাপদ চলাচলের প্রকল্পও রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কাজী রফিকুল ইসলাম জানান, রেলকে গতিশীল করতে নতুন রেল লাইন নির্মাণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ১শ’ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলাচল উপযোগী করে নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে রেলওয়েতে লোকবল সংকট রয়েছে। ব্যালাস্ট পাথর কিনতে রাজস্ব বরাদ্দ কম পাওয়া যায়। তারপরও রেলওয়েকে গতিশীল রাখা হচ্ছে। নতুন রেললাইনে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে নির্মাণ করা হচ্ছে। নতুন ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণেরও প্রয়োজন। তারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!