• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গরিবের ডাক্তার ‘মমতাজ’ আপা


এস এম জামাল, কুষ্টিয়া ডিসেম্বর ১৫, ২০১৭, ০৪:৫৩ পিএম
গরিবের ডাক্তার ‘মমতাজ’ আপা

কুষ্টিয়া : প্রত্যন্ত গ্রামের একটি এলাকার সাধারণ মানুষের সুচিকিৎসার পরামর্শে অন্যতম ভরসাস্থল হয়ে উঠেছেন একজন নারী। এলাকায় ‘ডাক্তার আপা' নামে পরিচিত তিনি। প্রত্যন্ত গ্রামে সাধারণ মানুষের সুচিকিৎসার পরামর্শে তার নাম উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘদিন ব্র্যাকের স্বাস্থ্য সেবিকা হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসছেন। এলাকার সাধারণ মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসা, মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যের পরিচর্যা বিষয়ে পরামর্শ প্রদান ছাড়াও বাল্য বিবাহ, তালাক, যৌতুক, স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া মিমাংসাসহ নানা সামাজিক কাজের পাশাপাশি গর্ভবতী মায়েদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতন করে তোলেন তিনি। সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে তিনি নিজেই মায়েদের নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান। একপর্যায়ে তিনি সবার আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। মেয়েলি রোগের সব কথা নিজের আপনজনকেও বলা যায় না। লজ্জা লাগে। ডাক্তার আপাই তাদের ভরসা। তাই দু-এক দিন তাকে না দেখলেই অস্বস্তিতে ভোগেন নারীরা। তার পরামর্শে সবাই লাভবান হয়েছেন।

এতক্ষণ কথা বলছিলাম কুষ্টিয়া সদর উপজেলার জগতি ২নং কলোনি পাড়া গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত দরিদ্র কৃষকের স্ত্রী মমতাজ বেগমকে নিয়ে।

তাকে কেউ ডাকেন ডাক্তার আপা, কেউ খালা, কেউবা প্রিয় ভাবী। একটি এলাকার নারীদের জীবন চলার সঙ্গী এ মানুষটি। তাকে ছাড়া যেন অস্বস্তি গৃহিনীদের। মা ও শিশু স্বাস্থ্যের পরিচর্যা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দানের মাধ্যমে সবার আপনজন হয়ে উঠেছেন তিনি। এসব কারণেই তিনি আজ সমাজে অনেক সুনাম অর্জন করেছে।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার জগতি রেল স্টেশন হতে উত্তর দিকে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে সামনে কিছু দুর এগুলেই রাস্তার ডানের দিকে মমতাজের বাড়ি। ডাক্তার আপা বলতে সবাই এক বাক্যে চেনে মমতাজ আপাকে। তিনি গরীবের ডাক্তার আপা ‘মমতাজ’। ইটের গাথুনির দেয়ালে টিনের ছাউনি বাড়িটি খুবই সুন্দর। বাড়িতে ঢুকতেই দেখা মিললো মমতাজ বেগমের। পঞ্চাশোর্ধ মমতাজ বেগম এখনো কাজকর্মে প্রাণচঞ্চল্য। ব্যস্ততা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি স্বামীকে কাপড়ের দোকান নিয়ে বাজারে যাওয়ার ব্যবস্থা করেই আলাপচারিতায় এলেন তিনি। বললেন তিনি নানান অজানা কথা। বাল্য বিয়ে কি তিনি এতোটা জানা ছিলো না। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় তাকে। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়।

তিনি বলেন, কোনো একদিন ব্র্যাকের কর্মকর্তারা আমাদের বাসায় এসে ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচি নিয়ে অনেক কথা বলছিল। আমার খুব ভালো লাগতো সেসব কথায়। মাঝে মাঝে মনে হতো, ইশ আমিও যদি এমনটা মানুষকে সেবা করতে পারতাম। হঠাৎই আমাকে ব্র্যাকের সেবিকা হিসেবে কাজ করার জন্য অনুরোধ করলেন তারা। স্বামীর সঙ্গে আলাপ করলে তিনিও বাধ সাধেননি। এরপর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলাম। প্রশিক্ষণে অন্যান্যদের থেকে ভালো করার ফলে আমাকে যথেষ্ট খাতির করতেন তারা। প্রশিক্ষণ শেষে গ্রামে ফিরে শুরু করলাম প্রাথমিক চিকিৎসার। ১০টা রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শুরু করতেই পাড়া প্রতিবেশীরা হাসিঠাট্টা শুরু করল। আমি যেন তাদের কাছে হাসির খোরাকে পরিণত হলাম। প্রথম প্রথম আমার খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। সেই কষ্টের কথা আাজও মনে পড়ে যোগ করেন মমতাজ বেগম।

তিনি বলেন, যারা এক সময় আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতো আর আজ তারাই আমাকে নিয়ে ‘ডাক্তার আপা’ ‘ডাক্তার আপা’ বলে উল্লাস প্রকাশ করে থাকেন। কারণ, পাড়া প্রতিবেশীর কোনো অসুখ-বিসুখ হলে আমাকে ডাকলেই ছুটে গেছি প্রাথমিক চিকিৎসার তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমি আমার প্রশিক্ষণালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে রোগ নির্ণয় করতে লাগলাম। না পারলে ঊর্ধ্বতন সেবিকাদের স্মরণাপন্ন হতাম। স্বল্প টাকায় চিকিৎসা দিতে লাগলাম গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের। কখনো দরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করেছি। ৩০ বছর যাবৎ সেবিকা হিসাবে কাজ করতে গিয়ে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার কথাও তাক লাগিয়ে দেয়। গ্রামের মানুষ চিকিৎসা শেষে খরচ বাবদ অনেক সময় চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস উপহার স্বরূপ দিতেন আমাকে। তার আনন্দ একটাই ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবিকা হিসেবে নিজেকে পরিচিতি করে তুলতে পেরেছেন। স্বামী-সন্তান নয় আমার পরিচয়ে তাদের পরিচিতি ব্যাপকভাবে লাভ করছে।

তিনি জানান, দীর্ঘ সময়ে আমি প্রায় আড়াই শ জন যক্ষ্মা (টিবি) রোগীর চিকিৎসা করেছি। একজন এমডিআর রোগীর চিকিৎসা করেছি। যার নাম আরজ আলি। বর্তমানে সে সুস্থ আছে। প্রাথমিক চিকিৎসা করে আমার সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে পেরেছি। দুই সন্তানের জননী মমতাজ বেগম। কাপড়ের ব্যবসা করেন স্বামী। আর বড় ছেলে এমবিএ করে ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরি করছে। আরেক ছেলে গাড়ির চালক হিসেবে কর্মরত। মানুষের সেবা করতে পারলে আমার ভাল লাগে। তাই আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেবা করে যেতে চাই।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!