• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গল্পটি নতুন নয়...


সাদ্দাম সাচী এপ্রিল ৪, ২০১৭, ০৪:২৭ পিএম
গল্পটি নতুন নয়...

বাহিরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। কিছুক্ষণ থেমে আবার অঝোর ধারায় নামতে শুরু করে। ঝরো হাওয়া, বাতাসের শন শন শব্দ মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। বাতাসের আর্দ্রতায় প্রচুর শীতল হাওয়া শরীরে ঢুকে যায়। আঘাতের অনুভূতি বিষাক্ত কাটাঁর মত। শরীরের ভিতর প্রবেশ করা মাত্রই শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গগুলি কাপাকাপি শুরু করে। যেন বিদ্যুৎ স্পর্শ করেছে।

এই ঝর বৃষ্টির মধ্য রাতে এত কিছু ভেদ করে আসাদ ছুটে যাচ্ছে তার গ্রামের বাড়ির উদ্দ্যেশে। তার আজ যেতেই হবে। যত প্রাকৃতিক বা রাষ্ট্রীয় প্রতিকূলতা থাক। বাড়িতে তাকে যেতেই হবে। না হলে তার বাবা মা ও আর সব আত্নীয়স্বজনদের সান্ত্বনা দিবে কে! সে নিজেও অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে তা বোঝা যাচ্ছে তার চুপচাপ ভঙ্গি দেখে। এমনিতেই আসাদ কথা বলে কম। খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া তার ভিতর থেকে কথা বের হয় না, তাইলে বলে ইন্ট্রুভার্ট নয়। মফস্বল শহর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস দিয়ে ঢাকা কলেজে সমাজকর্মে ভর্তি হয়েছে। এখন সে শেষ বর্ষে। কিছুদিন পর তার ফাইনাল পরীক্ষা। এমন একটা সময়ে তার এমন একটা খবর শুনে বাড়ি যেতে হবে সে তা ভাবেনি। তবে এখন সে তার বাবার কথা ভাবছে। এই ব্যাপারে সবচে বেশি তার বাবাই কষ্ট পাবে সে তা জানে।

আঠারো বছর পূর্বের কষ্টটা এভাবে উপস্থিত হবে সে কখনও ভাবেনি। পৃথিবীর মানুষের ভিতর দিনে দিনে এরকম অমানুষিকতা চাষ হবে তা ভাবেনি। এসব কিছুর অনেক উর্ধ্বে সে। তার চিন্তা মানুষকে নিয়ে। মানুষ কিভাবে একটু ভাল হয়ে চলতে পারে, কি পলিসি অবলম্বন করে দারিদ্র্যতা থেকে একটু উঠতে পারে। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে স্বচ্ছ্বলতা আনতে পারে। সামাজিক কল্যাণের দিকেই তার গবেষণা। কিন্তু সমাজের মানুষ তার চিন্তার ধারে কাছে নেই। যাদেরকে নিয়ে সে চিন্তা করে তারাই থাকে তার বিরোধী। এসব মানুষদের জন্য দেশে উন্নয়ন হচ্ছে না। সে জানে তারপরেও সে চেষ্টা করে যাচ্ছে আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। কিছুদিন পূর্বে আসাদ তার গ্রামের লোকদের নিয়ে একটা সমিতি করে। যেখানে সদস্য ছিল গ্রামের ছিন্নমূল পরিবারগুলি। এদেরকে সে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দেয়। যেমন বন্যা হলে তাদের কি করনীয় থাকতে পারে, পশুপালন, কুটিরশিল্প, স্বল্প টাকা খাটিয়ে কিভাবে ব্যবসায় আয় করতে পারে। আর বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনাবোধ জাগানোর চেষ্টা করে। কারণ তার এলাকা নদী প্রধান। ভালো বৃষ্টি হলে অনেকের বাড়িতে পানি উঠে যায়। গ্রামটি খুব একটা বড় না, একপাশে  ঢালু জমি অন্য পাশে একটু উচু। গ্রামের মাঝখান দিয়ে ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার এক পাশে নদী, বিল, হাওর আর অন্য পাশ উচু। সেই উচু পাশে গড়ে উঠেছে বাজার। বাজারের পাশের লোকদের কোন পানির ভয় নেই এখানে বন্যা হলেও পানি আসে না। বন্যার ভয় ঐপাশের লোকদের। বিস্তর জমি, দু'চোখের দৃষ্টি যতটুকু যায় ততটুকু পর্যন্ত বিশাল মাঠের মত দেখা যায়। এক দিকে ধান অন্য দিকে সবজির ফসল। তবে এই ফসল এক সিজন করতে পারে। আর অন্য সময় পানি চলে আসে। তখন শুধু পানি আর পানি। হঠাৎ বন্যা হলে ফসল ডুবে যায়, উচুঁ গাছ গুলিও পানির নিচে চলে যায়। তখন দেখা যায় এপাশের মানুষের অভাব। ঠিক মত বাড়ি থেকে বের হতে পারে না, কাজ করতে পারে না। ঘর থেকে বের হলে কলাগাছের বেলা দিয়ে যায়। তখন দেখা যায় তাদের অভাবের পরিনতি ।

যা আসাদ ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছে। তাদের বাড়িও ঐ সকল অভাবি মানুষদের পাশে। তার বাবা ঐ বাজারে একটা ছোট ব্যবসা করে দেখেই তার পড়াশোনা ঠিক ভাবে চলছে। তার পরিবারে খুব একটা অভাব ঢুকতে পারে না, কারণ তারা সবাই পরিকল্পনা অনুযায়িই চলে। আসাদ যখন বড় হল তখন তার আশেপাশের মানুষদের কথা চিন্তা করতে থাকে। সেই অনুযায়ী তার গ্রামের লোকদের নিয়ে সমিতির কার্যক্রম ভাল ভাবে চালাতে থাকে। সবাই কিছু কিছু উপকার পেতে থাকে। অনেকেই এনজিওগুলি থেকে লোন নিয়ে ছোট করে ব্যবসা শুরু করে, কেউ হাঁস মুরগী পালন করতে থাকে। আসাদ ঢাকা থেকে বাড়িতে গিয়ে সবার কাজকর্ম দেখে। সমিতির কার্যক্রম বাড়াতে থাকে । নতুন করে অনেকেই সদস্য হয়।

আর আসাদের এসব কাজ দেখে এলাকার অনেকেই ঈর্ষা করতে থাকে। বাজারের চায়ের দোকানে আলোচনা হয় -আসাদ এসব থেকে একটা ধান্ধা করছে। আবার অনেকেই বলে- আসাদ যেভাবে মানুষদের সংঘবদ্ধ করছে সে একদিন রাজনীতি করবে। এলাকায় চেয়ারম্যানী ইলেকশন করবে। এসব কথা বাজারে ছড়িয়ে যাওয়ার পর মোড়ল শ্রেণীর লোকদের মাঝে হিংসার সৃষ্টি হয়। তারা আসাদকে কিভাবে থামাবে সে চিন্তায় তাদের ঘুম হারাম। তাদের আচরণে হিংসা, যে প্রকারেই হোক আসাদকে থামাতে হবে। না হলে এই ছোকরার হাতে তাদের ভবিষ্যৎ মোড়লগীরি থাকবে না। তাদের জায়গায় ফকিন্নির পুত এসে যাবে। সেটা হতে দেয়া যাবে না।

একদিন ঐ সকল মোড়লেরা বাজারে আসাদের বাবার দোকানে আসে। অনেক কটু কথা বলে আসাদের ব্যাপারে। আসাদের বাবা চুপ থাকে। এই এলাকায় ওরা যা বলে তাই হয়। কিন্তু আসাদ তো রাজনীতি করে না। তারপরেও এমন কেন হচ্ছে, চারিদিকে এত অনীহা কেন, এত হিংসা! আসাদের বাবাকে এক পর্যায়ে হুমকি দিয়েই বলে- তোমার পোলা যা শুরু করছে তা একদিন চরম পস্তাতে হবে, আর আগে থেকে এসব বাদ না দিলে পরে। শহরে পড়ালেখা করছে তাই ভাল, গ্রামের উন্নয়ন নিয়ে তাকে ভাবতে হবে না। কথাগুলি মনে থাকে যেন। আর আসাদকে বলে দিও এসব সঙ্গ ফঙ্গ বাদ দিয়ে পড়ালেখায় মন দিতে। আর যেন এসব না দেখি। আরেকবার এসব দেখলে তোমার ব্যাবসা হারাবে সাথে ছেলেটাকেও।

আসাদের বাবা সরল মানুষ। এত সব কথা না বুঝলেও শেষের কথা ঠিকই তার মনে ধরেছে। সে চিন্তায় পরে যায়। অনেক চিন্তা নিয়ে বাড়িতে যায়। কিছুই তার ভাল লাগে না। আসাদের মায়ের কাছে আসাদ কোথায় জানতে চায়। আসাদের মা বলে-দক্ষিণ পাড়ায় গেছে, শহর থাইকা লোক আইছে, সেলাই প্রশিক্ষণ দিবে ।

আসাদের বাবার মাথায় আরও চিন্তা বেড়ে যায়। এসব কিছু তো ওদের ভাল লাগবে না। কেন সে এসব করছে। একটা বড় ক্ষতি হয়ে গেলে আমার কি হবে। আসাদের বাবা এসব ভাবছে আর বিছানায় চুপ করে বসে আছে। আসাদের মা বলে-আপনার কি শরীল খারাপ? আসাদের বাবা কিছুই বলে না।

সবাই একসাথে মাদুলি পেতে রাতে খেতে বসেছে। আসাদের বাবা কিভাবে কথাটা শুরু করবে তা ভাবছে। এদিকে আসাদ গ্রামের লোকদের জন্য সামনে কি কি করবে তা একের পর এক বলে যাচ্ছে। তার মাঝে একটা প্রশান্তির ভাব, একে একে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছে। সামনে আরও হবে। তার ভিতর ব্যাপারটা ভাল লাগছে। হঠাৎ আসাদের বাবা হাও-মাও করে কেঁদে উঠেছে আর আসাদকে জড়িয়ে ধরেছে। 

আসাদ অবাক হয়ে বলছে -তোমার কি হয়েছে আব্বা। আসাদের মাও তাই বলছে। আশপাশের ঘরগুলি থেকে আসাদের চাচারা বের হয়ে এসেছে। সবাই অবাক হয়ে আসাদের বাবার কান্না দেখছে।

আসাদের বাবা কেঁদে কেঁদে বলছে - তুমি বাবা আসাদ গ্রামে যা শুরু করছ তা বাদ দাও। কালই ঢাকা চলে যাও। এসব আমাদের মত লোকদের জন্য না, যারা রাজনীতি করে তা খুব উন্নয়ন নিয়ে ভাবুক, তোমার দরকার নাই। আসাদ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে তার বাবার কথার। সে এই গ্রামের ছেলে, এখানেই সে বড় হয়েছে, এই এলাকার রাজনীতি সম্পর্কে সে জানে। তার বাবাকে কেউ শাসিয়েছে তার ব্যাপারে সে নিশ্চিত বোঝে গেছে। তার বাবাকে সে শুধু বলছে-কিছুই হবে না আব্বা।

আসাদের বাবা বলছে- অনেক কিছুই হইতে পারে বাবা, তুমি এসব বাদ দাও, তুমি আমার এক মাত্র সন্তান। আসাদ চুপ হয়ে যায়, কোন কিছু বলার মত কথা পাচ্ছে না। তার বাবাকে ভালো করে সে চিনে। কতটা সরল আর কতটা তাকে ভালোবাসে। অনেক কষ্ট করে তাকে পড়াশোনা করাচ্ছে কিন্তু কোন দিন তার বাবা তার সামনে কষ্ট প্রকাশ করেনি। পড়াশোনা ছেড়ে চাকরি শুরু করে সংসারের কথা ভেবে, তাই যত কষ্ট হোক তার বাবা তার সামনে হাসি মুখেই থাকতো। কোনদিন ভিতরের কষ্টটা বোঝতে দিত না।

কয়েক বছর পূর্বে আসাদের জীবনে এমন ঘটনা ঘটে। যা তাকে অনেকটা পিছিয়ে রেখেছে সে ভাবে। সে ভদ্র অমায়িক তাই তার ভিতর প্রতিবাদ নেই। সে উত্তেজিত হতে পারে না, উত্তেজিত হওয়ার আগ মূহুর্তে সে চিন্তা করে তার বাবার কথা পরিবারের কথা। ছোট একটা বোন আছে বিয়ে দিতে হবে। ভাঙ্গা বাড়িতে থাকে, ভাল একটা বাড়ি করতে হবে। কোথায় বাড়ি করবে সেটাও চিন্তা করে, তাদের যা জমি আছে সব তো নদীর পারে। বর্তমান বাড়িটাও নড়বরে, কখন ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার কোন ঠিক নেই। তার পরিবারের কথা পড়ালেখা শেষ করে একটা ভাল চাকরি করবে এবং টাকা কামিয়ে উচুঁ জায়গায়া কিনে একটা বাড়ি করবে। বোনের বিয়ের জন্য কিছু টাকা জমানো আছে, তাতে কি তা দিয়ে হয় তো বিয়েটা হবে, পরে আত্নীস্বজনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে টাকা কামাতে হবে। কারণ তাদের সবার ইচ্ছে বোনটাকে একটা ভাল পরিবারে বিয়ে দেয়ার। ভাল পরিবার ওয়ালারা অনেক কিছুই দেখে । এত কিছু ভাবনার ভিতরে আসাদ শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবে না, তার আশপাশের মানুষদের নিয়েও চিন্তা করে। কিন্তুু অনেক সময় নীরাশায় ভোগে, কারণ তার আশপাশের মানুষদের নিয়ে এত চিন্তা করে, পরে সর্বশেষে দেখা যায় তার পাশে কেউ থাকে না। তখন তার মন অনেক খারাপ হয়, কাউকে সে কিছুই বলে না। ওরা বোকা, সরল মানুষ, ওদের মাথায় এত বুদ্ধি নেই, তারউপর গ্রামীণ রাজনীতি ওদেরকে তার কাছে থেকে আলাদা করে রাখে, ওরা এখনও মোড়লীয় সাশনে আছে, পৃথিবী দেখার সৌভাগ্য এখনও ওদের হয়নি । এসব ভেবে ভেবে মনের চাপা রাগ গুলি আসাদ কমায়।

আসাদ রেল ইস্টিশনের দিকে আসতেই বৃষ্টির বেগ আরও প্রবল হয়। প্রচন্ড বাতাস। যে দিকে বাতাসের ধাক্কা সে দিকে বৃষ্টির পানি বেকে বেকে পরছে। ইস্টিশনে তেমন মানুষ নেই, একদম ফাঁকা। আসাদ হাত দিয়ে মাথার চুল গুলি ঝারছে, যেন বৃষ্টির পানি মাথায় পুক্ত ভাবে না লাগতে পারে। শরীরও অনেকটা ভিজে গিয়েছে। জিন্স পেন্টের সাথে টি-শার্ট পরেছে, পায়ে সো। সো জোড়ায় কাদা লেগে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে সাথে হাঁটুর নিচে পেন্টে কাদার চিটে লেগে আছে, তার শরীরের নিচের অবস্থা দেখলে কাউকে বলার অপেক্ষা রাখবে না সে যে দৌড়িয়ে এসেছে। তার টি-শার্টের সাথে ব্যাগটাও ভিজে গিয়েছে, ভিতরে তেমন কিছুই নেই তার ব্যবহারের কাপড় চুপর। এসবের দিকে তার কোন নজর নেই, তার চিন্তা কখন বাড়ি যাবে। তার বাবাকে সান্ত্বনা দিবে।
আসাদ ইস্টিশনের টিকিট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায়। এদিক সেদিক দেখে কেউ নেই। সে বোঝতে পারে এ সময় তাদের বাড়ি যাওয়ার কোন ট্রেন নেই, সে এই লাইনে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। তারপরেও সে সব ভুলে গিয়েছে, তার কাছে মনে হচ্ছে এখন একটা ট্রেন আছে । সে স্টেশন মাস্টারের রোমের কাছে যায়, জিজ্ঞাস করে এখন কোন কিশোরগনঞ্জগামী ট্রেন আছে কি না। স্টেশন মাস্টার তাকে তালিকা দেখতে বলে। তালিকার মধ্যে লিখা আছে ঢাকা থেকে ছেরে যাওয়া ট্রেন গুলির সময়। আসাদ নিরব ভাবে কাধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে হেটেঁ যায় তালিকার সামনে। খুব নিখুঁত ভাবে তালিকায় থাকা ট্রেন ও ছারার সময় দেখে। সে আগেই বোঝতে পেরেছিল এখন কোন ট্রেন নেই, তারপরেও তার ভিতরে ভাল লাগছিল না, সে কখন বাড়িত যাবে সেই উত্তেজনা কাজ করছিল। সে এখন নিশ্চিত হল তার ট্রেন ঢাকা থেকে ছারবে আরও তিন ঘন্টা পর।

স্টেশানের এদিকসেদিক কিছুক্ষন ঘুরে। কিছুই ভাল লাগছে না তার। কোন কিছু খাওয়ারও ইচ্ছে হচ্ছে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে শুধু মানুষ দেখে, তেমন মানুষও নেই, যা আছে সবাই ঘুমন্ত। যে যেখানে আছে ঘুমিয়ে আছে, কোন সারা শব্দ নেই। আসাদ ওয়েটিং রোমে যায়, দেখে সবাই গভীর নিদ্রায় আছে, কোন ফাঁকা জায়গা নেই,সে একটু বসবে, কাউকে ডেকে একটু জায়গা চাইবে সে অবস্থা নেই,সবাই অপেক্ষায় ধৈহ্য হারা হয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু আসাদের চোখে ঘুম নেই। আজকের বাড়ি থেকে আসা সংবাদ যেন ঘুমকে মেরে ফেলেছে। তার বর্তমানের সমস্ত পরিকল্পনায় বড় দাগ কেটেছে। সব কিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। যখন এই সংবাদের কথা মনে হয় আসাদের তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়, যেন পৃথিবীতে সে একা, তার পাশে থাকার মত কেউ নেই। পৃথিবীর আলাদা প্রাণী মনে হয়। তখন তার মনে পরে বাবা, মা, বোন ও আর সব আত্নীয় স্বজনের কথা। ওদের এখন কি অবস্থা, কি করছে ওরা।

আঠার বছর পূর্বের কষ্টটা তার থেকে বেশি আহত হবে তার বাবা, মা, চাচা ও ফুপুরা। আসাদের একটাই ফুপু। তাকে বিয়ে দিয়েছে কুমিল্লা। আসাদের বাবা চাচাদের খুব আদরের ছোট বোন। সবার ছোট বলেই ওর প্রতি আদরটা অনেক বেশি। আসাদের বাবা ওকে বেশি আদর করত,  কারণ আসাদের বাবাই সবার বড়। ফুপুর বিয়ের সময় আসাদের বাবা রাজি ছিল না, এত দূর থেকে সম্বন্ধ আনছিল বলে । তার একটা মাত্র বোন তাকে বিয়ে দিবে কাছে কোন জায়গায়, সেটা ছোট বেলা থেকেই বলত আসাদের বাবা। কিন্তুু পরে দূরেই দিতে হল বিয়ে, ভাল সম্বন্ধ আর পাওয়া যাবে না, একটু দূরে হলেই বা কি বরের বিশাল ব্যবসা এখানে যে আসছে সেটাই ভাগ্যের ব্যাপার, এই পানির এলাকায় এই ধরনের মানুষ বিয়ে করতে আসে, যাদের বাড়ি ঘরের কোন নিরাপত্তা নেই, যে কোন সময় পানি বাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে,  তাদের আবার কাছে দূরের পছন্দ। এত আদর দেখিয়ে লাভ কি যেখানে বোনের সুখ সেখানেই বিয়ে দেয়া উচিৎ। এমন সব কথা বলে পরশির লোকেরা আসাদের বাবাকে রাজি করিয়ে ছিল। তারপর বিয়ে দেয় সুখ হয়, কিন্তুু বাপের বাড়িতে তেমন আসতে পারে না। সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে যায়। আসাদের সাথে ফোনে যোগাযোগ হয়, মাঝে মধ্যে টাকা দেয়। আসাদ নিতে চায় না, না নিলে ফুপু রাগ করে।

এখন আসাদ তার ফুপুর কথা ভাবছে, বাড়ির এমন একটা সংবাদ তার ফুপুকে অনেকটা কষ্ট দিবে। যে কষ্টটা আঠার বছর পূর্বে তার ফুপুসহ বাড়ির সবাই পেয়েছিল। আবার সেই কষ্টের দিনটা পুনরায় সবাইকে মনে করিয়ে দিবে এবং কষ্টের পাল্লাটা সবার বেরে যাবে। বাবা মারা যাওয়ার পরে যে দুঃখ কষ্ট চারিদিকে এসে যায় তা আসাদ এখনও পায়নি, সেটা তার বাবা, চাচা ও ফুপু পেয়েছে। সেই কষ্টটাই পুনরায় তাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে । এত বছর পর তারা কেউ কল্পনাও করেনি এমন একটা দিন তাদের সামনে এসে উপস্থিত জানাবে।
 
 বন্যার আশঙ্কা খুব বড়। বন্যার সাথে সবার ঘরে অভাব হানা দিবে। কষ্ট শুরু হবে এই পাড়ার মানুষজনদের। বন্যার সাথে অভাব আসবে, রুগ আসবে, আরও কত ঝামেলা। এদিকে অসুস্থ আসাদের দাদা,ঠিক ভাবে চিকিৎসা করতে পারছে না। এসব চিন্তা করে আসাদের বাবা হতভম্ব হয়ে পরে।  আসাদের দাদি মারা যায় অনেক আগেই, সেই থেকে তার দাদাকে তার ফুপুই বেশি দেখাশোনা করত। আসাদের দাদা মৃত্যুর পূর্বে বিছানায় পরে ছিল এক বছর। তখন সময়ে বাড়ির বউয়েরা আসাদের দাদার তেমন কাছে যায়নি, বাহিরের কাজ গুলি করে দিত, দাদার ঘরের কাজ করত না। যেমন আসাদের দাদা বিছানা থেকে উঠতে পারতো না, সব কিছু বিছানায় থেকে করত। খাওয়া থেকে শুরু করে পায়খানা করা সবই বিছানয় ছিল তার স্থান। আর এসব সব করত আসাদের ফুপু। মুখে খাবর তুলে দেওয়া, হাতে ধরে ধরে প্রসাব পায়খানা করানো, পরে সেটা পরিষ্কার করা।  কোন অনীহা ছিল না, কোন প্রতিবাদ ছিল না কারও প্রতি, কোন ঘৃনা ছিল না, কোন ক্লান্তি ছিল না। সব করত। তারপরেও তার ফুপু চেয়েছিল আরও কিছুদিন বেচে থাক তার বাবা । তারপর কিছুদিন পরেই আসাদের দাদা মারা যায়। মৃত্যুর দিনের কথা আসাদের কিছু কিছু মনে আছে। দূর থেকে দাড়িঁয়ে সবার কান্না দেখছিল। সে বোঝতে পেরেছিল দাদা মারা গিয়েছে, আর কোন দিন ফিরে আসবে না। আর কোন দিন সেই ভাঙ্গা ঘরের পুরনো চকিতে শুয়ে তাকে ডাকবে না। হাতে ধরে নিয়ে যাবে না ক্ষেত দেখতে। এসব বোঝার বয়স ছিল তার। তাকে জড়িয়ে ধরে তার ফুপু চিৎকার করে কেদেছে। তখন সেও কেদেছে তার ফুপুর কান্না দেখে। তার ফুপুর মনেই বেশি কষ্ট লেগেছিল বাবা হারানোর বেদনায়। তখন তার ফুপুকে সান্ত্বনা দিতে পারেনি, তখন তার সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা জানা ছিল না। এখন সে বড় হয়েছে তার ফুপুকে সান্ত্বনা দিতে পারবে, বোঝাতে পারবে অনেক কিছুই। কিন্তু এখনও সে চুপ, চাপা কান্নায় তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ভিতরের সব ভাষা বোবা হয়ে গিয়েছে, কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে না। এতক্ষনে হয়তো তার ফুপু রওনা হয়ে গিয়েছে।

ইস্টিশনের টাইলস করা বেঞ্চিতে বসে আছে আসাদ। চারিদিকের অন্ধকার ভোরের আগমনে পালিয়ে যাচ্ছে। ফজরের আযানের ধ্বণি ভেসে আসছে। বৃষ্টি নেই তবে ঠান্ডা বাতাস আছে। সারা ইস্টিশন জুড়ে উষ্ণতা । একটু দূরে কুয়াশা ডেকে রেখেছে চায়ের টং দোকান গুলিকে। সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যেদিক দিয়ে ট্রেন আসবে সেই দিকে কুয়াশার বড় পর্দা দেখা যাচ্ছে। আসাদ তাকিয়ে আছে, কখন ট্রেন আসবে। কখন বাড়িত যাবে। তার কিছুই ভাল লাগছে না। সে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বিভিন্ন কিছুই দেখছে, যেন ভিতরের কষ্টটা পাতলা হয়। স্টেশনের ল্যাম্পপোষ্টের উপরে তিনটা কাক বসে আছে। একটা কাক একটা কমলা খাচ্ছে আর দুটা কাক তা দেখছে । কিছুক্ষন দেখার পর দুইটা কাক খাদক কাককে আক্রমন করে। খাদক কাকটি উড়াল দিয়ে চলে যায়। পিছনে দুইটা কাক তাঁরা করে। একটু দূরে একজন বৃদ্ধ চায়ের দোকানদার গরম পানিতে চা পাতা ঢালে আর কেটলি থেকে বাষ্প উপরের দিকে উঠতে থাকে । বৃদ্ধা কেটলির মুখ বন্ধ করে দেয়।

যখন রাতে ফোন আসে আসাদের কাছে তখন ওপাশ থেকে তার বাবার মৃদু কান্নার আওয়াজ আসে। কান্নায় জড়জরিত ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় তার বাবার মুখে কষ্টের খবর শোনে আসাদ। আসাদ চুপ করে থাকে কিছুক্ষন, পরে বলতে শুরু করে। সে যা বলেছে তাতে তার বাবা কিছুটা সান্ত্বনা পেয়েছে, কিন্তু যে খবর দিয়েছে তা যে একটা ঘটনা হবেই তা সে নিশ্চিত। অনেক চেষ্টা করেছে আসাদ, তাতে কোন লাভ হয়নি। অমানুষেরা তা যে করবে তা আসাদ জানে। তবে এতটা নিচে নেমে যাবে তা কখনও কল্পনা করেনি । আজ গ্রামীণ রাজনীতির পৈশ্চাশিক চাকার নিচে এভাবে পিষ্ট হবে তা কখনও ভাবেনি। আঠার বছর পূর্বের দুঃখটা ওরা দিবে তার পরিবারকে আর সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে এইটা ভাবতেই নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছে। আর নিজের প্রতি আরও খারাপ লাগছে গ্রামের ঐসকল লোকদের জন্য, যাদের জন্য সে উন্নত চিন্তা করে তারা কেউ আজ তার পাশে নেই। সবাই দূরে গিয়ে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কাউকে তার পাশে পায়নি।

মাস কয়েক আগে আসাদ তার বাবাকে নিয়ে এলাকার চেয়ারম্যানের কাছে যায়। চেয়ারম্যানের সাথে এই বিষয়ে  কিছুক্ষন কথা বলার পর চেয়ারম্যান সাহেব সাফ না করে দেয় এই বিষয়ে সে কিছুই করতে পারবে না, সে অনেক বোঝিয়েছে ওরা কথা শোনেনি। কথা শোনার মত চেয়ারম্যান কোন প্রকার বল প্রয়োগ করেনি, কারণ সরকার বাড়িতে অনেক ভোট যা তাকে সবসময় দিয়ে আসছে। তার আওতায় এতগুলি মানুষ, সে ওদের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবে না। আর ঐ এলাকার প্রায় সবাই ওদের কথায় চলে কেন ওদের বিরুদ্ধে রাজনীতি নিয়ে এত মাতামাতি করার দরকার ছিল। এসব কথা যখন চেয়ারম্যান বলতে শুরু করে তখন আসাদ বোঝতে পেরেছে ঘটনা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে আর হয় তো কিছুই করার নেই।

আসাদের ছোট কাকা জসিমের রাগ একটু বেশি । তবে মানুষ হিসেবে এতটা খারাপ না। সেও ঐ বাজারে মুদির দোকানদার। তার ব্যাবসা আসাদের বাবার থেকে ভাল। আর আসাদের বাবার মত কাউকে পরোয়া করে চলে না। একটু ক্ষ্যাপাটে আর নির্বোধ প্রকৃতির মানুষ। ধৈর্য কম আর চিন্তাশক্তিতে পুষ্ট না। কার সাথে কিভাবে চলতে হবে সে জ্ঞান কম।

কিছুদিন পূর্বে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়। সরকার বাড়ি থেকে আলিম সরকার মেম্বার পদপার্থী ইলেকশন করে। সরকার বাড়ির লোকজন হচ্ছে এই এলাকার সবচে উন্নত ও সম্পদশালী। অনেক ধানের ক্ষেত ওদের, এই এলাকার অনেকেই ওদের ক্ষেত চাষ বাস করে খায়। তবে ওদের আচারন হচ্ছে মোড়লদের মত। আর আলিম সরকার হচ্ছে সরকার বাড়ির কর্তা। সে অনেকবার ইলেকশনে দাড়িয়েছে কিন্তু পাস করতে পারে না। এবারের ইলেকশন সে খুব জাকজঁমক ভাবে করেছে, অনেক টাকা মাঠে ছিটিয়েছে। কিন্তু পাস করতে পারেনি, আবারও সে পরাজিত হয়েছে । তার আক্ষ্যাপ এই এলাকা সে সাশন করে কিন্তুপরিষদের সদস্য হতে পারে না।

আর আলিম সরকারের পরাজিত হওয়ার সব দোষ পরেছে আসাদের চাচার উপর। সে আলিম সরকারের নির্বাচন করেনি। আর সে যার ইলেকশন করেছে সেও পাস করতে পারেনি। 

ট্রেন চলে যাচ্ছে তার গতিতে। হর্ন দিচ্ছে। আসাদের গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। আসাদ বসে আছে জানালার পাশে। খুব গম্ভীর হয়ে আছে তার শরীর, মন ও চিন্তায় তার প্রতিচ্ছবিরা তার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। অসহায়ত্বের এক স্তম্ব বহন করে বাড়িতে যাচ্ছে সে। তার ভিতরে বাহিরে সব কিছু ফ্যাকাসে আর শূন্যতা। চারিদিক সম্পর্কে সে আর কিছুই ভাবতে পারছে না। আর কিছুক্ষন পরেই তার সামনে পুরাতন মৃত্যুর নতুন কষ্টের জন্ম হবে। সে কষ্ট তাকে যতটা দুঃখ দিবে তার থেকে বেশি আহত হবে তার বাবা ও ফুপু। এতক্ষনে হয় তো ফুপু চলে এসেছে। আর পৈশাচিক কান্ড দেখার জন্য হাজারও লোকজন উপস্থিত হয়েছে।

আসাদ ট্রেন থেকে নেমে জনাকীর্ণ লোকজনের ভিতর থেকে নিস্তব্ধ হেটে আসছে । তার চোখের কিনারে এখনও পানি আসেনি। মুখে বিষাক্ত রাগ আর অসহায়ত্বের অবয়ব।

চারপাশে অনেক লোকজন ভিড় করে আছে। ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে দূর দূরান্ত থেকে লোকজন জমায়েত হয়েছে। উচু ভিটার চারপাশে মানুষের ঢল। এই ভিটার এক পাশে সরকার বাড়ির ঘন কবরস্থান। এই কবরস্থান থেকে আঠার বছর পূর্বে কবর দেয়া একটি লাশ উঠানো হচ্ছে। আঠার বছর পূর্বে এই লাশ মালিকের বাড়িতে বন্যার পানি এসে ছিল, কবর দেওয়ার মত কোন জায়গা খালি ছিল না, সব জায়গা পানির নিচে ডুবে ছিল। তখন সরকার বাড়ির কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। কবরস্থান থেকে একটু দূরে বসে আলিম সরকার পান চিবাচ্ছে। তার আশেপাশে দর্শক শ্রেনীর অনেক লোকজন জমায়েত হয়েছে। আলপথ ধরে সারি বেধে মানুষ আসছে। হিন্দু বাড়ি থেকে সিঁদুর শাঁখা দিয়ে দেবর জাঁ এর সাথে অনেক বৌ জিরা উপস্থিত হয়েছে। হাজার মানুষের ঢল। চারিদিকে হই-হুল্লোর আর কৌতূহল। একেঅপরের মাঝে কানাকানি। উপজেলা প্রতিনিধি সাংবাদিকদের ছুটাছুটি।

আসাদের বাবা বাচ্চাদের মত কাদছে। আসাদের ফুপুকে কেউ শামাল দিতে পারছে না। কষ্টের পুনরাবৃত্তি কতটা কষ্টদায়ক পৃথিবীতে তারায় এখন তা উপলদ্ধি করছে। আসাদ দূরে দাড়িঁয়ে আছে। তার চোখ দিয়ে অঝরে পানি বের হচ্ছে ।

Wordbridge School
Link copied!