• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গেল বছর নারী ও শিশুর ওপর নৃশংসতা মাত্রা ছাড়িয়েছে


বিশেষ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬, ১২:১১ পিএম
গেল বছর নারী ও শিশুর ওপর নৃশংসতা মাত্রা ছাড়িয়েছে

বছরের শুরুতেই হবিগঞ্জে চার শিশুকে শ্বাসরোধে ও পাঁজর ভেঙে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এর কিছুদিন পর কুমিল্লায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু, রাজধানীর কলাবাগানে জুলহাজ-তনয় হত্যা ও চট্টগ্রামে তৎকালীন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ড বছরজুড়েই ছিল আলোচিত ঘটনা। 

অক্টোবরে সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে বখাটে ছাত্রলীগ নেতার চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিল দেশ-বিদেশের লাখো মানুষ। রাবির ছাত্র-শিক্ষক হত্যা, ঢাকায় স্কুলছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা এবং মাদারীপুরে বখাটের হাতে মিতু মন্ডলের খুন ছিল বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা।

বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল নৃশংস এসব হত্যাকাণ্ড। ঘরে-বাইরে খুন হয়েছে মানুষ। রাজপথে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ঘরে ঢুকে কমান্ডো স্টাইলে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে হত্যার ঘটনায় আলোচিত ছিল সারা বছর। 

একটি খুনের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি হত্যাকাণ্ড আলোচনায় এসেছে। তবে গেল বছর নারী ও শিশুর ওপর সবচেয়ে বেশি নৃশংসতার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর মগবাজারের পাবনা কলোনিতে নিজবাসায় খুন হয়েছেন রং ও কাপড় ব্যবসায়ী আবদুস সাত্তার।

পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, গেল বছরের ১১ মাসেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৩ হাজার ৩০ জন। রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ১৭৭ জন এবং আহত সাড়ে ১১ হাজার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ ও হেফাজতে মারা গেছেন ১৭৩ জন। 

একই সময় ৪ হাজার ৫২৬ জন নারী নির্যাতিত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৭১ জনকে ধর্ষণ, গণধর্ষণের শিকার ১৮৩ এবং ধর্ষণের পর ৩৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। অ্যাসিড নিক্ষেপে ঝলসে গেছে ৩৫ জনের মুখ ও শরীর। 

এসব আলোচিত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বছরজুড়েই গুম-গুপ্তহত্যা ঘটনা ছিল অহরহ। নদী, ডোবা, সড়কের পাশ ও ডাস্টবিন থেকে লাশ উদ্ধারের ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলার অসহায় অবস্থা তুলে ধরেছে।

মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, অপরাধ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা। আবার সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়ের কারণেও অপরাধ বাড়ছে। 

তবে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেছেন, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই ছিল। শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি বিবেচনা করা যাবে না। হত্যাকাণ্ডসহ বেশির ভাগ অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়েছে। অনেক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। যে হত্যা মামলাগুলো পেন্ডিং আছে, তা পরিপূর্ণভাবে ডিটেকশন করতে যে তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন, সেগুলো নানা কারণে সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১১ মাসে সারা দেশে মোট ৩ হাজার ২২টি খুন হয়েছে। ২০১৫ সালে খুন ছিল ৪ হাজার ৩৫টি। ২০১৪ সালে সারা দেশে ৪ হাজার ৫১৪টি হত্যা মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৩ সালে সারা দেশে হত্যা মামলার সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৩৯৩। পরিসংখ্যান বিচারে খুনের হার কমলেও নৃশংসতা বেড়েছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের খুন করা হয়েছে পৈশাচিক কায়দায়।

তনুর খুনিরা অধরা : কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের মেধাবী ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের ৯ মাস পার হলেও রহস্যের উদ্ঘাটন হয়নি। হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে দেশের সব শ্রেণির মানুষ রাস্তায় নামে। 

এরপরও তনুর খুনিরা ধরা পড়েনি। হত্যার বিচার নিয়ে শঙ্কিত পরিবার। ঘাতকদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে আজ কুমিল্লার পূবালী চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ করবে গণজাগরণ মঞ্চ। গত ২০ মার্চ তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি জঙ্গলে লাশ ফেলে রাখে ঘাতকরা।

চার্জশিট হয়নি জুলহাস-তনয় হত্যার : ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানের বাসায় ইউএসএআইডির সাবেক কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। জুলহাজ বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার প্রটোকল কর্মকর্তা ছিলেন। সমকামীদের অধিকারবিষয়ক সাময়িকী ‘রূপবান’-এর সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। তনয় মঞ্চ নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ ঘটনায় রাশিদুল নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার হলেও হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া কাউকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

মিতু হত্যাকাণ্ড রহস্যাবৃত : ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসির মোড়ে সন্তানের সামনে নৃশংসভাবে খুন হন বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে বাবুল আক্তার নিজে এই খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানিয়েছিল পুলিশ। এর জেরে ২৪ জুন রাতে বাবুল আক্তারকে ঢাকার গোয়েন্দা কার্যালয়ে ১৫ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই সময় তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন। দেশজুড়ে আলোচিত মিতু হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল পুলিশ বাহিনী থেকে অব্যাহতি নেন। তবে এ হত্যাকাণ্ডটি এখনো রহস্যাবৃতই থেকে গেছে।

ব্লগার নাজিমউদ্দিন হত্যাকাণ্ড : ৬ এপ্রিল পুরান ঢাকায় লক্ষ্মীবাজারের একরামপুরে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমউদ্দিন সামাদকে। হত্যার ৭ মাস পর রাশেদুন্নবী নামে একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নাজিমউদ্দিন অনলাইনে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডটিও রহস্যঘেরা।

রাবির ছাত্র-শিক্ষক হত্যা : ২৩ এপ্রিল রাজশাহী মহানগরীর শালবাগান এলাকায় সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। পুলিশের দাবি—মুনতাসিরুল আলম অনিন্দ্য ও শরিফুলসহ সাতজনের একটি জঙ্গি গ্রুপ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত। এদিকে ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আবদুল লতিফ হলের ডাইনিংয়ের পাশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোতালেব হোসেন লিপুর লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে তার রুমমেট মনিরুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

রিশা-নিতুর হত্যার নৃশংসতা : প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় রাজধানীর কাকরাইলে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে। প্রধান আসামি ওবায়দুল খানকে অভিযুক্ত করে গত ১৪ নভেম্বর চার্জশিট দেয় পুলিশ। অন্যদিকে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মাদারীপুরের কালকিনির ডাসার থানার আলিসারকান্দি গ্রামে স্কুলছাত্রী নিতু মন্ডলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর খুনি মিলন মন্ডলকে আটক করে পুলিশে দেয় স্থানীয় লোকজন। এরপর ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও চার্জশিট দিতে পারেনি পুলিশ।

হবিগঞ্জে চাঞ্চল্যকর চার শিশু হত্যা : ১২ ফেব্রুয়ারি মাঠে খেলা দেখতে গিয়ে নিখোঁজ হয় হবিগঞ্জের বাহুবলের সুন্দাটিকি গ্রামের জাকারিয়া শুভ (৮), মনির (৭), তাজেল (১০) ও ইসমাইল (১০)। ১৭ ফেব্রুয়ারি বাড়ির অদূরে একটি বালুর ছড়া থেকে মাটিচাপা দেওয়া অবস্থায় এ চার শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে জানা যায়, চার শিশুকে বুকের পাঁজর ভেঙে ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। মামলার তদন্ত শেষে আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!