• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গ্যাস লাইন নয়, যেন মৃত্যুফাঁদ


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৭, ১২:২৫ এএম
গ্যাস লাইন নয়, যেন মৃত্যুফাঁদ

নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষণ, মনিটরিং আর সচেতনতার অভাবে গ্যাস লাইনগুলো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। প্রায়ই ত্রুটিপূর্ণ এসব লাইন থেকে বড় ধরনের দূর্ঘটনায় প্রাণহািনর ঘটনা ঘটলেও এখনো উদাসীন কর্তৃপক্ষ। শুধু কলকারখানাতেই নয়, বাসা-বাড়িতেও গ্যাস লিকেজ হয়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে।

রাজধানীর গুলশান, উত্তরা, আজিমপুর, রামপুরা, কলাবাগ, চকবাজার, লালবাগ, ওয়ারী, ফতুল্লাহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিগত কয়েক বছরে গ্যাসের চুলা থেকে বড় ধরনের বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটে। গত দুই মাসের মধ্যে সাভারে দুটি কারখানায় বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মারা যায় ৩৫ জন। ঘটনার পর কয়েকদিন হৈ-চৈ হয়। সাময়িক টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহনের কথা উচ্চারিত হয়। কিন্তু এরপর সব কিছু থেমে যায়।

সূত্র জানায়, গত দেড় বছরে গ্যাস লাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় শুধু রাজধানীতেই শতাধিক ব্যক্তি দগ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেকেই মারা গেছেন। দগ্ধদের মধ্যে বনানীতে ২০ জন, হাজারীবাগের গজমহলে গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণে দগ্ধ হন ৩ জন, মিরপুরে টিনসেড বাড়িতে ৬ জন, আজিমপুর স্টাফ কোয়াটারে ৩ জন, কলাবাগান লেকসার্কাস রোডের এক বাসায় ৭ জন দগ্ধ হন। ওয়ারীতে ৩ জন, রামপুরায় ২ জন চকবাজারে ৪জন দগ্ধ হন। আর উত্তরায় একই পরিবারের ৫ জন দগ্ধ হন। ফতুল্লায় ৫ জন। 

মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) সাভারে একটি গ্যাস লাইটার তৈরীর কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় এক জন নিহত ও ১৯ জন গুরুতর আহত হন। ডিইপিজেড-এর ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র ষ্টেশন অফিসার আব্দুল হামিদ জানান, আগুন লাগার প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায়নি। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। তবে এ ধরনের কারখানার জন্য ফায়ার সার্ভিসের যে ধরনের লাইসেন্স প্রয়োজন হয় কারখানা কতৃপক্ষ তা নেয়নি বলে জানান  তিনি।

এর আগে গত ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর টাম্পাকো কারখানায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৩৪ জন দগ্ধ হয়ে মারা যান। অর্ধশত ব্যক্তি দগ্ধ ও আহত হন। এ ঘটনাটিও গ্যাস লাইনের লিকেজের কারণে হয়েছে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।

সূত্র জানায়, দোলাইপাড়, জুরাইন, গেন্ডারিয়া, সাভার, আশুলিয়া, নাায়নগঞ্জ, ফতুল্লাসহ রাজধানী ও পাশ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠা বিভিন্ন কলকারখানা ও ঢালাই লোহা তৈরীর কারখানা অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে চালানো হচ্ছে। সম্পূর্ন অপরিকল্পিতভাবে এসব গ্যাস সংযোগ নেয়া হয়েছে। এসব কারখানার অনেকগুলো আবার আবাসিক এলাকাতেই গড়ে উঠেছে। ফলে যে কোনো সময় বড়ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে।  

তিতাস গ্যাস কোম্পানীর সহকারী প্রকৌশলী সিবেন্দ্রনাথ ঘোষ জানান, বাসা বাড়িতে গ্যাসের লাইন সংযোগ দেওয়ার সময় পুরো বাড়ির চুলা পর্যন্ত ঠিক করে দেওয়া হয়। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে রাস্তায় মাটির নিচের লাইন থেকে  দুই পাইপ এর একটি গ্যাস চুলার দিকে আর একটি বাইরের দিকে অতিরিক্ত গ্যাসের চাপ বের করে দেয়ার জন্য। এই দুটি পাইপ পর্যন্ত আমরা তদারকি করি। 

তার পরও কোন বাসা বাড়ি থেকে অভিযোগ করা হলে আমরা গিয়ে তা ঠিক করে দেই। কিন্ত যে সব দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে, তার অধিকাংশ ভিআইপি রান্না ঘর। যেগুলোতে জানালাগুলো এসি সিস্টেমের। ফলে সেখাতে বাতাস ঢুকতে পারে না। আর গ্যাস লিক থাকলেও তা বের না হয়ে রুমের ভেতরেই থাকে। ফলে সেখানে আগুন জ্বালানোর সাথে সাথেই গ্রেনেড বিস্ফোরণের মতো বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। তিনি আরো জানান, ভুমিকম্পের মতো কোন দুর্ঘটনা ঘটলে গ্যাস লাইনগুলো ভবনের সাথে সাথে ভেঙ্গে বা ফেটে যাবে। এতে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। দুর্ঘটনা রোধে জনগণকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, এসব দুর্ঘটনা বা বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য সকলকে একযোগে কাজ কাজ করতে হবে। 

তিনি আরো জানান, খুব শিগগিরই জনগণকে সচেতন করতে মাঠে নামবো। তার পরও প্রতিটি বাড়ির মালিক ও বাড়ির বাসিন্দাদের উদ্দ্যেগ নিতে হবে। তাদের সচেতন হতে হবে। অনেক সময় গ্যাসের চুলা ও লাইনে লিকেজ থাকে। সেগুলোর ব্যাপারে তাদের সচেতন হতে হবে। এছাড়া, রান্না ঘরের বন্ধ জানালা খুলে রাখা ও ভাল চুলা ব্যবহার করতে হবে বলে জানান তিনি।

কয়েকটি ঘটনা: চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডের ৮ নম্বর ভবনের সপ্তম তলায় গ্যাস লিক হয়ে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় তিন ছেলের মধ্যে দু’ই সন্তান ও স্ত্রীসহ মারা যান প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ। 
 
গত বছরের ১৮ মার্চ রাজধানীর বনানী ২৩ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাড়িতে গ্যাস লাইন বিস্ফোরিত হয়ে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ২০ জন দগ্ধ হন।  আর এতে উড়ে যায় ভবনটির দরজা-জানালা। এর আগে রাজধানীর কলাবাগানের লেক সার্কাস এলাকায় গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণে নারী ও শিশুসহ সাতজন দগ্ধ হন। 

২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর রাজধানীর আজিমপুরে গ্যাসের চুলার পাশে মোবাইল চার্জ দেওয়ার সময় বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান সিটি কলেজের ছাত্রী উম্মে সাদিয়া আতিক লামিয়া। এরপর ১৪ নভেম্বর রথখোলার জয়তুননাথ বসাক লেনের ৯/১০ নম্বর বাসায় গ্যাসের পাইপ বিস্ফোরণে ছয়জন দগ্ধ হন। 

এর আগে রাজধানীর আজিমপুরে গ্যাসের চুলা বিস্ফোরণে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও তার স্ত্রী নিহত হন। ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে গ্যাসের চুলা মেরামতের সময় বিস্ফোরণে মামা-ভাগিনাসহ তিনজন দগ্ধ হন।  

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!