• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গ্যাস সিলিন্ডারে মরণঝুঁকি


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৭, ০১:০১ এএম
গ্যাস সিলিন্ডারে মরণঝুঁকি

গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারগুলো পুনঃপরীক্ষা ছাড়াই ব্যবহার আর মানহীনতার কারণেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। দেশের বহুল ব্যবহৃত এই জ্বালানি তরল পেট্রোলিয়াম (এলপি) বা বোতলজাত গ্যাস সিলিন্ডার এখন আতঙ্কের আরেক নাম। 

সাম্প্রতিক সময়ে বাসা-বাড়ির গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল নিজ বাসগৃহটিও অরক্ষিত হয়ে উঠছে, এই নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডারে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহারের কারণেই এসব দুর্ঘটনা বাড়ছে। ঘটছে প্রাণহানি। ভোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা করা প্রয়োজন। সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তাতে সরকার বা কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ির শেখদিবটতলা গুটিবাড়ি এলাকার একটি টিনশেড বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দুজন নিহত হন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন আরো দুজন। তারা বাসায় বসে বেলুনে গ্যাস ভরছিলেন। সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হলে নিহত দুজনের শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর গত বছরের ১০ জুলাই পাবনার বেড়া উপজেলায় এলপি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক বৃদ্ধা মারা যান। সেই ঘটনায় আহত হন তার স্বামী।

প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। জীবন অনুষঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ এ সরঞ্জামটি ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মুহূর্তেই কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। 

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিমাসে ছোট-বড় মিলিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আহত হয়ে ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকে মারাও যান। এর ফলে একাধিকবার দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত এলপি গ্যাস (তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস) সিলিন্ডার ও বাসাবাড়িতে রান্নার কাজের জন্য সরবরাহকৃত সিলিন্ডার গ্যাসের পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় সরকার। 

তবে সরকারি সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসির পরিচালক (মার্কেটিং) মীর আলী রেজা বলেন, শিগগিরই ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডার শনাক্তে বিশেষ অভিযানে যাচ্ছে বিপিসি। পাঁচ লাখ সিলিন্ডার পরীক্ষা করা রাতারাতি সম্ভব নয়, কিন্তু নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে আমাদের যতটুকু কাজ করার কথা ছিল তা করা হয়নি বলে কাজের গতি বাড়ানো হচ্ছে।

বর্তমানে এলপি গ্যাস বাজারের ৮০ ভাগের নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি খাতের হাতে। অনিয়ন্ত্রিত এ খাতে বাড়ছে পুরোনো ও নিম্নমানের সিলিন্ডারের ব্যবহার। এতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুঝুঁকি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলটরি কমিশন (বিইআরসি) কোনো নিয়ন্ত্রণ তৈরি করতে পারেনি। 

এ বিষয়ে বিইআরসির সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, কয়েক বছর ধরেই ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নিয়ন্ত্রণ তৈরি করা হচ্ছে। এলপি গ্যাস খাত নিয়ন্ত্রণের জন্যও কাজ করছে বিইআরসি। একটি খসড়া তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি চূড়ান্ত হলেই এ খাতকে কড়া নজরদারির মধ্যে আনা যাবে। 

গ্যাস সিলিন্ডার আইন, ১৯৯১-এ সিলিন্ডারের মান যাচাইয়ের জন্য প্রতি পাঁচ বছর পর সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (আইএসও) স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর গ্যাস সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা বাধ্যতামূলক। কিন্তু দেশের বাজারে ২৫ বছরের পুরোনো সিলিন্ডারও ব্যবহার হচ্ছে কোনো পুনঃপরীক্ষা ছাড়াই। এ কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বাড়ছে।

নিয়ন্ত্রণহীন এলপি গ্যাস খাত: ২০০৯ সালের অক্টোবর থেকে সব ধরনের নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ কর দেয় সরকার। সংকটে পড়ে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোয় এলপি গ্যাসের চাহিদা বাড়তে থাকে। এ বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য সরবরাহ ক্ষমতা বাড়ায় এলপি গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো। 

তবে গ্যাস সংযোগ চালু হলেও সংকট থাকার কারণে এলপি গ্যাসের চাহিদা কমছে না। এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এ বাজারের শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে বসুন্ধরা এলপি গ্যাস। যদিও সরবরাহ ক্ষমতা বৃদ্ধির একাধিক প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। এ দুটির পরই বাজারে আছে টোটাল গ্যাস, যমুনা গ্যাস, পট্রিগ্যাস ও ওমেরা এলপি গ্যাস। সব প্রতিষ্ঠান তাদের সরবরাহ ক্ষমতা বাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। ওরিয়ন, সানোয়ারা, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপসহ আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নিয়েছে এলপি গ্যাস ব্যবসার। বর্তমানে বছরে তিন লাখ টন এলপি গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সরবরাহ রয়েছে মাত্র এক লাখ টনের মতো। 

বেসরকারি কোম্পানির মধ্যে শুধু বসুন্ধরা গ্রুপ মাসে ৩০ হাজার সিলিন্ডার, যমুনা ১৫ হাজার ও টিকে গ্রুপ ১০ হাজার সিলিন্ডার তৈরি করছে। অন্যরা আমদানি করছে। দেশে নতুন-পুরোনো মিলে প্রায় ২০ লাখ সিলিন্ডার রয়েছে। এর মধ্যে বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের রয়েছে প্রায় ১০ লাখ, পেট্রিগ্যাসের ২ লাখ, টোটাল গ্যাসের ১ লাখ ও বাকিগুলো অন্যান্য কোম্পানির।

নিম্নমানের সিলিন্ডারে বাজার সয়লাব: গ্যাস সিলিন্ডার ও সিএনজি সংক্রান্ত অনুমোদন বাস্তবায়ন এবং দেখভালের জন্য আছে সরকারের দুটি সংস্থা। যার একটি রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) ও অন্যটি বিস্ফোরক পরিদফতর। অথচ অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের বাইরে রাজধানীর অনেক এলাকায় তুলনামূলক কম খরচে পাওয়া যায় অনুমোদনহীন সিএনজি সিলিন্ডার ও খুচরা যন্ত্রাংশ। 

পুরোনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারকে রং করে তা পুনরায় বিক্রি করা হচ্ছে। রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর ও যাত্রাবাড়ির বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে অবৈধভাবে পুরোনো গ্যাস সিলিন্ডার রং করে তা নতুন করে ব্যবহার উপযোগী করছে একশ্রেণির অসাধু চক্র। এসব কাজ বেআইনি বললেও এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের খোঁজ জানে না সরকারি তদারকি সংস্থাগুলো।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যাত্রী পরিবহনে জনপ্রিয় বাহন লেগুনা। এসব লেগুনায় ব্যবহৃত বেশিরভাগ সিলিন্ডার অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে রূপান্তরিত। এ নিয়ে খুব একটা ভাবনা নেই যাত্রী, চালকসহ সংশ্লিষ্টদের। মৃত্যুঝুঁকিতেই চলছে এসব যানবাহন। যেন দেখার কেউ!

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!