• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঘাড়ব্যথা ও করণীয়


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ২২, ২০১৬, ০২:৩৯ পিএম
ঘাড়ব্যথা ও করণীয়

কোন রকম আঘাত ছাড়াই বিভিন্ন বয়সী বেশির ভাগ মানুষ জীবনের কোন না কোন সময় ঘাড় ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। ঘাড়ের মাংসপেশী, লিগামেন্ট, স্নায়ু, হাড়, জোড়া, তরুণাস্থি বা ডিস্ক বিভিন্ন প্রকার সমস্যার জন্য ঘাড়ব্যথা হয়ে থাকে।

প্রধানকারণসমূহ

* ঘাড়ের অবস্থানগত ত্রুটির জন্য। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজের প্রয়োজনে দীর্ঘক্ষণ অস্বাভাবিক ভাবে ঘাড় বাঁকা করে কোন কাজ করলে  (যেমন: কম্পিউটারে কাজ করা, টেলিভিশন দেখা, লেখালেখি বা গৃহস্থালীর কাজ করা) ঘাড়ের মাংস পেশী, স্নায়ু ও হাঁড়ের উপর বেশি চাপ পড়ে; ফলে ঘাড়ব্যথা হয়। (পজিশনালবাপসচারেল নেক পেইন)।

* ঘাড়ের মাংস পেশী কোন কারণে শক্ত হয়ে ঘাড় এক দিকে কাঁত হওয়া (টরটিকলিস)। আমাদের ঘাড়ের দুইপাশে দুইটি প্রধান মাংস পেশী থাকে। যার নাম স্টারনোক্লেইডোমাস্টয়েড। এই মাংসপেশী আমাদের ঘাড় নড়াচড়া করতে সাহায্য করে। কোন কারণে এই মাংস পেশী শক্ত হয়ে ঘাড় এক দিকে কাঁত হলে ঘাড়ে ব্যথা অনুভূত হয়।
 
* ঘাড়ের মাংশ পেশী বা লিগামেন্ট মচকানো বা আংশিক ছিড়ে যাওয়া (স্প্রেইন/স্ট্রেইন)।

* ঘাড়ে অতিরিক্ত হাঁড় থাকা (সারভাইকেলরিব)। এই অতিরিক্ত হাঁড়ের ফলে ঘাড়ের রক্তনালী ও স্নায়ুতে চাপ পড়ে। ফলে ঘাড়েব্যথা হয়। 

* ঘাড়ের দুই হাড়ের মধ্যবর্তী তরুণাস্থি বা ডিস্ক সরে যাওয়া (ডিস্ক প্রলাপস্)।

* ঘাড়ের হাড়, জোড়া বা ডিস্ক এর ক্ষয় বা বৃদ্ধি (সারভাইকেল স্পনডাইলোসিস)। এটি বয়স জনিত হাঁড়ের ক্ষয় জনিত একটি রোগ। এতে ঘাড়ের দুই হাঁড়ের মধ্যবর্তী স্থান কমে যায় এবং আক্রান্ত হাঁড়ে হুকের মত ছোট ছোট হাঁড় বৃদ্ধি পায় যাকে অস্টিওফাইট বলে যার ফলে ঘাড়ের স্নায়ুতে চাপ পড়ে এবং রোগী ব্যথা অনুভব করে।

* ঘাড়ের তরুণাস্থি বা হাঁড়ের বৃদ্ধির ফলে স্নায়ুর গতিপথ সংকুচিত হওয়া। (সারভাইকেল কেনেল ষ্টেনোসিস)।

* ঘাড় থেকে যে স্নায়ু গুলো কাঁধ, বাহু এবং হাতের দিকে নামে সেগুলোতে চাপ পড়া (সারভাইকেল মাইলোপ্যাথি)।
 
* ঘাড়ের হাঁড় ভেঙ্গে যাওয়া (ফ্রেকচার) বা হাঁড় ভেঙ্গে সরে যাওয়া (ফ্রেকচার-ডিসলোকেশন)।

* ঘাড়ের হাঁড় সরে যাওয়া (স্পনডাইলোলিসথেসিস)।

* ঘাড়ের ইনফেকশন (সেপটিক, যক্ষ্মা)।

* ঘাড়ের তরুণাস্থি বা ডিস্ক এর প্রদাহ জনিত রোগ (ডিস্কাইটিস)। ইহা সাধারণত ডিস্ক অপারেশন পরবর্তী প্রদাহের কারণে হয়ে থাকে। 
ঘাড়ের হাঁড় ক্ষয় প্রাপ্ত হওয়া। এতে হাঁড়ের ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যায়, হাঁড় ছিদ্রযুক্ত হয় এবং হাঁড়ের গঠন নষ্ট হয়ে যায়। হাঁড়ের বোনমাস ডেনসিটি এর অনুপাতের ভারসাম্যতা নষ্ট হয়; ফলে হাঁড় ধীরেধীরে ভঙ্গুর হয়। বয়স্ক পুরুষ বা নারী এবং মেনোপোজ পরবর্তী মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ক্ষয় প্রাপ্ত হাঁড় ঘাড়ব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ। (অস্টিওপোরোসিস)।

* ঘাড়ের হাঁড়ের বিভিন্ন প্রকার প্রদাহ জনিত রোগ (রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস, এনকাইলোজিং স্পনডাইলাইটিস)। 

* ঘাড়ের বিভিন্ন স্নায়বিক সমস্যা, রক্ত বাহী নালীর সমস্যা, টিউমার, ক্যান্সার, ইনফেকশন। 

* উচ্চ রক্তচাপ, চোখের কিছু অসুবিধা এবং দুশ্চিন্তা করা। 

* মাথায় ভারী জিনিস বহন করা। 

* শরীরের ওজন বৃদ্ধি অথবা অপুষ্টিজনিত কারণ।

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে:

* ঘাড়ের দুই পাশের যেকোন বড় মাংস পেশীতে টান খাওয়া (টরটিকলিস)।
* জন্মগত ভাবে ঘাড়ের দুই বা ততোধিক হাঁড় এক হয়ে যাওয়া (ফিউসডভার্টিব্রা)।
* জন্মগত ভাবে ঘাড়ের কোন হাঁড়ের অর্ধেক অংশ তৈরি নাহওয়া (হেমিভার্টিব্রা)।

তরুণদের ক্ষেত্রে:

* ঘাড়ে অতিরিক্ত হাঁড় থাকা (সারভাইকেলরিব)।
* ঘাড়ের দুই হাঁড়ের মধ্যবর্তী ডিস্ক সরে যাওয়া। (ডিস্ক প্রলাপস্)।

বয়স্কদের ক্ষেত্রে:

* ঘাড়ের হাঁড়, জোড়া বা ডিস্কের ক্ষয় বা বৃদ্ধি (স্পনডাইলোসিস)।
* ঘাড়ের হাঁড় ক্ষয় (অস্টিওপোরোসিস)।
* ঘাড়ের তরুণাস্থি  বাহাঁড়ের বৃদ্ধির ফলে স্নায়ুর গতিপথ সংকুচিত হওয়া (সারভাইকেল কেনেল ষ্টেনোসিস)।
* ঘাড়ের ইনফেকশন   (সেপটিক, যক্ষ্মা)।
* ডিস্কাইটিস (ডিস্কের প্রদাহ)।
* ঘাড়ের হাঁড় ও স্নায়ুর টিউমার।

উপসর্গ:
* ঘাড়ব্যথা ঘাড়েই সীমাবদ্ধ থাকা (এক্সিয়াল নেক পেইন, যেমন: ঘাড়ের মাংসপেশী মচকানো)।
* ঘাড়ব্যথা কাঁধ, বাহু, হাত হয়ে আঙ্গুল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। হাত বা হাতের আঙ্গুল অবশ অবশ ভাব অথবা ঝিঝি হতে পারে (রেডিকুলার নেক পেইন যেমন: ঘাড়ের ডিস্ক প্রলাপস্)।
* কাঁধ, বাহু, হাত বা হাতের আঙ্গুল দূর্বল হতে পারে।
* সময় সময় হাঁড় ধরে বা জমে (স্টিফনেস) থাকা এবং আস্তে আস্তে তা বাড়তে পারে। 
* ঘাড়ের নড়াচড়া বা সামনের দিকে ঝুকে কাজ করলে ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। 

পরীক্ষানিরীক্ষা:
* রক্তের কিছু রটিন পরীক্ষা।
* প্রসাব পরীক্ষা
* ব্লাডসুগার, ইউরিক এসিড, আর.এ. ফ্যাক্টর।

ঘাড়ের:
* এক্স-রে
* সিটি স্ক্যান
* এম. আর. আই.

চিকিৎসা
প্রতিরোধমূলকঃ

* প্রথমতঃ ঘাড়ে ব্যথা না হওয়ার জন্য সঠিক জীবন যাত্রার কিছু নিয়ম মেনে চলা-
* নিয়মিত ব্যায়াম করা।
* শুয়ে টিভি না দেখা।
* পড়ালেখা, কম্পিউটারে কাজ করা, গাড়ী চালানো বা অন্য যেকোন কাজের সময় দীর্ঘক্ষণ ঘাড় ঝুঁকিয়ে বা বাঁকিয়ে না রাখা। 
* শরীরের ওজন কমানো। 
* ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করা। 
* ঘাড় সোজা রাখার ব্যাপারে সচেতন হওয়া।
* সামনের দিকে ঝুঁকে কাজ না করা; কাজের মাঝে কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়া।
* একটি মধ্যম সাইজের বালিশে শোয়া যার অর্ধেক মাথা এবং বাকি অর্ধেক ঘাড়ের দিকে থাকবে।
* সুস্থ ব্যক্তিরা একটা ব্যায়াম করতে পারেন। কপালে একটি হাত শক্তভাবে রেখে হাতটিকে মাথা দিয়ে চাপ দেয়া। মাথার চারিদিকে হাত রেখে এভাবে ব্যায়াম করা। প্রতিদিকে ৫ বারের বেশি চাপনা দেয়া। ২-৩ বেলা এ ব্যায়াম করা যেতে পারে।  
* দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকা।
* প্রতিদিন ৬-৮ ঘন্টা ঘুমানো।

সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা

* পরিমিত বিশ্রাম নেওয়া।
* ঘাড়ে গরম সেঁক দিলে উপকার পাওয়া যায়। 
* চিকিৎসকের পরামর্শ মত NSAID, Muscle relaxant, Vitamin, Pregabalin জাতীয় ঔষধ সেবন করা। 
* টরটিকলিস এর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মত Muscle relaxant  জাতীয় ঔষধ সেবন করা। 
* প্রয়োজন অনুসারে (যেমন: দূরে কোথাও যেতে হলে) সারভাইকেল কলার ব্যবহার করা।
* সারভাইকেল ট্রাকসন (সারভাইকেল রেডিকুলোপ্যাথি বাসারভাইকেল  কেনেল স্টেনোসিস অথবা ডিজেনারেটিভ ডিস্ক ডিজিসএর ক্ষেত্রে)
* ফিজিওথেরাপী
* ডিস্কাইটিস হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরিমিত বিশ্রাম ও এন্টিবায়োটিক সেবন করা। 
* পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধ খাবার যেমন: হাঁড়সহ ছোটমাছ, দুধ, ডিম খাওয়া।
* সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন‘ডি’ জাতীয় ঔষধ যেমন: Labcal D সেবন করা যেতে পারে।
* বয়স্ক পুরুষ বা নারী এবং মেনোপোজ পরবর্তী মহিলাদের ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ এর পাশা পাশি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাঁড় ক্ষয় প্রতিরোধকারী ঔষধ যেমন: বিসফসফোনেট, এলেনড্রোনিক এসিড, ইবানড্রোনিক এসিড, জোলেন ড্রোনিক এসিড জাতীয় ঔষধ গ্রহণ করা যেতে পারে। 

কিছুকিছু ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে (যেমন: ঘাড়ের ডিস্ক বেশি পরিমাণে বের হয়ে স্নায়ুতে চাপ দেওয়া, ঘাড়ের হাঁড় ভেঙ্গে বাহু, হাত অবশ হয়ে যাওয়া, ঘাড়ের যক্ষ্মা ইত্যাদি)

ঘাড়ব্যথা দীর্ঘ স্থায়ী ও তীব্র হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা উচিৎ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঘাড়ব্যথার মূলকারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা উচিত।

ডাঃ এ.সি. সাহা
এমবিবিএস, এম.এস. (অর্থো)
কনসালটেন্ট
অর্থোপেডিকসার্জারীবিভাগ
ল্যাবএইড, গুলশান
গুলশান-২, ঢাকা-১২১২।
E-mail: [email protected]

সোনালীনিউজ/ঢাকা/ওএফ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!