• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চাপ মুক্ত সরকারে ফুরফুরে মেজাজ


শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জানুয়ারি ২০, ২০১৮, ১১:০৯ এএম
চাপ মুক্ত সরকারে ফুরফুরে মেজাজ

ফাইল ছবি

ঢাকা : একটানা দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতায় থাকা মহাজোট সরকারের শেষ বছর চলছে। চলতি বছরের শেষের দিকেই অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বচন। তাই শেষ সময়ে সরকারকে বেশ সতর্ক হয়ে চলতে হয়। কিন্তু এই শেষ সময়ে পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষকদেরই বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকটি সংগঠনের দাবির চাপের মুখে পড়তে হয় সরকারকে।

দাবিগুলো এমন সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এসে জড়ো হয়, তাতে সরকারের মধ্যেও অস্বস্তিকর পরিবেশের তৈরি হয়। কারণ দাবি মানলে সরকারকে আগামী বাজেটে বড় অঙ্কের টাকার যোগান দিতে হবে। দু-এক হাজার মানুষের বিষয় হলেও তা সম্ভব ছিল। কিন্তু মানুষের সংখ্যা কয়েক লাখের। শুধু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির দাবি বাস্তবায়ন করতে গেলে বছরে সরকারের লাগবে দুই হাজার কোটি টাকা।

অপরদিকে এই দাবি না মানলে সরকারের ভোট বাক্স থেকে চলে যেতে পারে এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষক ও তাদের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ ভোট। আর এভাবে দাবি মানলে একে একে সবাই রাস্তায় নামবে। তীব্র শীতের মধ্যে শিক্ষকদের খোলা সড়কে শুয়ে থাকা দেখাটিও কষ্টকর। জাতির কারিগরদের এভাবে রাস্তায় শুয়ে থাকাটাও অপমানজনক। এ নিয়ে উভয় সংকটে পড়ে সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিতে আপততো আন্দোলন থেকে সরে গিয়েছেন তারা।

২০১০ সাল থেকে এমপিওভুক্তি বন্ধ থাকলেও নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ওই বছরে এক হাজার ৬২৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি বন্ধ আছে।দেশের পাঁচ হাজার ২৪২টি নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর বেশির ভাগই বিনা বেতনে সেখানে চাকরি করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ২০ লাখের মতো। প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠছে সরকারের স্বীকৃতি নিয়েই। কিন্তু বছরের পর বছর এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি।

এসব দাবির বাইরে আগে থেকেই আলোচনায় ছিল সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের দাবির কথা। প্রেসক্লাবের সামনে সর্বপ্রথম অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে তারা জানান, আগের বেতন স্কেলগুলোয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করা হতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের একধাপ নিচের গ্রেডে। কিন্তু ২০১৫ সালের বেতন কাঠামোয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের সঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের গ্রেডের ব্যবধান দাঁড়ায় চার ধাপ।

এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকরা ১৪তম গ্রেডে (মূল বেতন ১০ হাজার ২০০) বেতন পাচ্ছেন। আর প্রধান শিক্ষকরা পাচ্ছেন দশম গ্রেডে (মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা)। এ বৈষম্য নিরসনে প্রধান শিক্ষকদের একধাপ নিচে একাদশ গ্রেডে (মূল বেতন ১২ হাজার ৫০০) বেতন পরিশোধের দাবি তুলেছেন তারা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের এ দাবিতে আন্দোলন চালায় বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক মহাজোটের আওতাধীন ১০টি সংগঠন। পরে সরকারের আশ্বাসে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান।

এর পরেই রাস্তায় নামেন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। সারা দেশ থেকে তারাও হাজির হন প্রেসক্লাবের সামনে। তাদের দাবি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্ত করতে হবে। কতোদিন আর অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে সংসার চালাবেন। দীর্ঘদিন আন্দোলনের পরে সরকার তাদেরও বুঝিয়ে বাড়ি পাঠান।

এর পরে আন্দোলনে নামেন বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকরা। তাদেরও দাবি এমপিওভুক্তি ও সরকারি করতে হবে। এখানেও বেগ পেতে হয় সরকারকে তাদের বুঝাতে।

সর্বশেষ নিজেদের স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠান জাতীয় করণের দাবি নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী শিক্ষকরা। তারা জানিয়েছেন, গত ৩৫ বছর ধরে কোনো প্রকার বেতন ছাড়াই চাকরি করে আসছেন তারা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া হতো না তেমন কিছুই। এজন্য ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলো জাতীয়করণের দাবিতে গত ১ জানুয়ারি থেকে রাজধানীতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষকরা।

এক পর্যায়ে তারা আমরণ অনশনে নামেন। কুষ্টিয়ার এক শিক্ষক মারাও যান অনশন করতে গিয়ে। পরে ১৬ তারিখ দুপুরে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলীর সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসের পর অনশন ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষক নেতারা। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের অনশনস্থলে এসে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর দাবি মেনে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে শিক্ষকদের অনশন ভাঙান।

তখন শিক্ষাসচিব বলেন, অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আপনাদের দাবিদাওয়া নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর কথা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দাবিদাওয়া সংক্রান্ত ও অন্যান্য তথ্য দেয়ার জন্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই সংক্রান্ত তথ্য প্রস্তুত করছে। দুই-একদিনের মধ্যে আপনাদের সকল তথ্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আপনাদের প্রতি সরকার সহানুভূতিশীল। অনশন ভেঙে যার যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে যান।

এরপর শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কর্মসূচি স্থগিতের কথা জানান স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি কাজী রুহুল আমিন চৌধুরী। সরকারের সাথে আমরা একমত। উনারা যা করার করবেন। আমরা আশা করি দাবি-দাওয়া মেনে নেবেন। এখানেই আমাদের কর্মসূচি স্থগিত করলাম। অনশন ভেঙে আমরা নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে যাব।

১ জানুয়ারি থেকে জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান শুরুর আটদিন পর আমরণ অনশনে রূপ নিয়েছিল স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী শিক্ষক সমিতির এই আন্দোলন। টানা দুই সপ্তাহের আন্দোলনের পর তাদের দাবির বিষয়টি যায় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। সেখান থেকে ইঙ্গিত পেয়ে কথা বলেন মন্ত্রী।

এরপরে গত ১৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেন, আগামী বাজেটে অর্থ্যাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সময়ে এমপিওভুক্তির বিষয়ে সিদ্বান্ত নেয়া হবে।

গত অর্থ-বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তাদের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারেনি। পরবর্তীতে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষকদের এই দাবি মেটাতে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে খরচ হবে দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে। এখন এই টাকা যোগান দেয়া কতোটুকু সম্বভ হবে তা আগামী বাজেটের সময়েই বুঝা যাবে।

সবচেয়ে বড় কথা এই সমস্যা গত দশ থেকে পনের বছর ধরে হলেও সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে ক্ষমতার শেষের বছরটিতে। এ আন্দোলনে বড় কোনো দুর্ঘটনা না হলেও এক শিক্ষক মারা গিয়েছেন। তবুও, তার পরিবার এই ভেবে শান্তি পাবে যেজন্য আন্দোলন তা পূরণ হতে চলেছে। সরকারও সবাইকে বুঝিয়ে বাড়ি ফেরাতে পেরেছে।

প্রতিদিন সংবাদের শিরোনাম, টেলিভিশনের টক-শো ও অন-লাইন নিউজ পোর্টালদের ২৪ ঘণ্টার হালনাগদ সংবাদ পরিবেশন হয় তাদের নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও হয় আলোচনা। সব মিলিয়ে পুরো সমাজ তাকিয়ে ছিল সরকারের দিকে। এখানে ভুল করলে ফলাফল পাওয়া যেত আগামী সংসদ নির্বাচনে।

চাপ মুক্ত হয়ে সরকারের মনে এক প্রশান্তি এসেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে কোনো কথা বলেনি। ফলে সরকারের শান্তির পরশ ছুয়ে গিয়েছে ঢাকার মানুষের মনেও। শত হলেও শিক্ষকদের রাস্তায় দেখতে চায়না কেউ।

সোনালীনিউজ/তালেব/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!