• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি

চার্জ গঠনের পরও ঝুলে আছে বিচার!


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ২৪, ২০১৭, ১২:২৯ পিএম
চার্জ গঠনের পরও ঝুলে আছে বিচার!

ঢাকা : মাহমুদুল হাসান হৃদয় (২৮)। কাজ করতেন ধসে যাওয়া রানা প্লাজার আটতলায়, নিউ ওয়েভস্টাইল পোশাক কারখানায়। ভবন ধসে পড়ার মাত্র তিন দিন আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি। তার পরের ইতিহাস তো কেবলই হারানোর।

জীবনটা কোনোমতে ফিরে পেলেও ডান পা হারিয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে সাক্ষী হতে হয় বিশ্ব কাঁপানো এই ট্র্যাজেডির। ইট-সুরকি আর কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে ঠাঁই পান হাসপাতালে। বাড়ি ফিরেই জানতে পারেন স্ত্রী চলে গেছেন। পঙ্গু স্বামীর সঙ্গে সংসার করা সম্ভব নয়-তাই চলে গেছেন। গেল চারটি বছর ক্র্যাচে ভর করেই চলছে মাহমুদুলের জীবন।

একই পোশাক কারখানার শ্রমিক মমতা। দুর্ঘটনার পর সবাই ধরে নিয়েছিলে মমতা মারাই গেছে। টানা চার দিন পর গুরুতর অবস্থায় কংক্রিটের মধ্য থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে। বিনিময়ে হারাতে হয় হাত ও পায়ের শক্তি। দীর্ঘ চিকিৎসার পর অনেকটা সুস্থ তিনি। নিজেই নিজের কাজ করতে পারছেন।

শুধু মাহমুদুল কিংবা মমতা নন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দুই হাজারেরও বেশি শ্রমিক এভাবেই বেঁচে আছেন। কারো হাত আছে তো পা নেই। কারো পা আছে তো হাত নেই। তবু নতুন করে প্রতিনিয়ত বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন কেউ কেউ। এখনো বিছানায় পড়ে আছেন অনেক শ্রমিক। আবার অনেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে স্বাভাবিক জীবন হারিয়েছেন। তবে স্বাভাবিক জীবনও পেয়েছেন অনেক শ্রমিক।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এক গবেষণা বলছে, ক্ষতিপূরণ না দেওয়া এবং পুনর্বাসন ঠিকভাবে না হওয়ায় রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের ৪২ দশমিক ২ শতাংশ এখনো চাকরি পাননি। এ ছাড়া আহত শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ার কারণেও তারা কর্মহীন রয়েছেন। আবার নিহত ও আহত শ্রমিকদের পরিবার সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত আর্থিক সহযোগিতায় জীবনযুদ্ধে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছেন। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে আর্থিক বণ্টন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের অভিযোগ -ক্ষতিপূরণ কিংবা সহযোগিতা পাননি তারা।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ২৪০ কোটি টাকা বণ্টন করা হয়েছে। আইএলওর কনভেনশন অনুযায়ী বিভিন্ন হারে এ অর্থ দেওয়া হয়েছে। এদিকে রানা প্লাজার ভবন ধস ট্র্যাজেডি আজ চার বছর পেরিয়ে পাঁচ বছরে পা রাখছে।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সংঘটিত হয় পোশাক কারখানার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এ ট্র্যাজেডি। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া তিনটি মামলার মধ্যে হত্যাসহ ২ মামলার বিচার চার্জগঠনের পর উচ্চ আদালতে নির্দেশ প্রায় এক বছর ধরে নিম্ন আদালতে স্থগিত রয়েছে। ওই কারণে গত এক বছরে নিম্ন আদালত কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেনি।

অন্যদিকে রানা প্লাজার ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অপর মামলায় চার্জ গঠনের শুনানির পর আগামী ৮ মে চার্জগঠনের বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য রয়েছে।

হত্যা মামলা : হত্যা মামলায় ২০১৫ সালের ১ জুন রানা, রানার বাবা-মাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর। এরপর প্রায় এক বছর ধরে মামলাটির পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট এবং পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের পর সম্প্রতি মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তত হওয়ার পর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়।

ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জানান, ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। মামলার ৪১ আসামির মধ্যে শাহ আলম ওরফে মিঠু, আবুল হাসান ও সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনির বিরুদ্ধে আসামি সোহেল রানাকে পলাতে সহযোগিতার জন্য দ-বিধির ২১২ ধারায় এবং অপর ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়।

একই সঙ্গে ওই বছর ১৮ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ঠিক করা হয়। কিন্তু হত্যার ধারায় চার্জ গঠনকৃত ৩৮ আসামির মধ্যে সাতজন আসামি চার্জ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করায় হাইকোর্ট মামলাটির নিম্ন আদালতের কার্যক্রম স্থগিত করে। ফলে ওই কারণে রাষ্ট্রপক্ষ এ পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেনি আদালত।

সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণের ধার্য দিনের একই কারণে সাক্ষ্য গ্রহণ পিছিয়ে আগামী ৭ মে পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন বিচারক। একই সঙ্গে ওই দিন বিচারক ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটরকে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

এ সম্পর্কে পাবলিক প্রসিকিউটর খোন্দকার আবদুুল মান্নান বলেন, মামলার সাতজন আসামি চার্জ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে গিয়েছেন। হাইকোর্ট ওই সাতজনের আবেদনে নিম্ন আদালতের পুরো মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। এ কারণে নিম্ন আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়কে চিঠি দিয়েছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি।

ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা : ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে রানা প্লাজা ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ১৩ জনকে আসামি করে সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায়ও হত্যা মামলার সঙ্গে ২০১৫ সালের ১ জুন পৃথক একটি চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির একই কর্মকর্তা। চার্জশিটে ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটিতে আগামী ১৭ মে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য আছে।

ইমারত নির্মাণে দুর্নীতির মামলা : রানা প্লাজা ভবনে ছয়তলা নির্মাণে অনুমোদন থাকার পরও নয়তলা ভবন নির্মাণ করে দুর্নীতি করায় সাভার থানায় মামলা করে দুদক। মামলায় রানা ছাড়া অপর ১৭ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু তদন্তে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রানার প্রভাব খাটানোর বিষয়টি বেরিয়ে পড়ায় তাকেসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মফিদুল ইসলাম। এ মামলায় গত ১৯ এপ্রিল আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

তিন মামলার আসামিদের অবস্থান : রানা প্লাজার ঘটনায় তিনটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তিন মামলায় এখনো সাতজন আসামি পলাতক রয়েছেন। এরা হলেন-সাভার পৌরসভার সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাভার পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, রেজাউল ইসলাম, নয়ন মিয়া ও সফিকুল ইসলাম। অন্যদিকে কারাগারে রয়েছেন চারজন। ২৯ জন আসামি জামিনে আছেন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা নামক ভবন ধসে এক হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো ১৯ জন মারা যায়। সে হিসাবে নিহত হয় এক হাজার ১৩৬ জন।

নেতিবাচক প্রভাব : বাংলাদেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাকশিল্পে গত চার বছরে এক হাজার ৯৬৫টি কারখানা বন্ধ হয়েছে; চাকরি হারিয়েছেন কয়েক লাখ শ্রমিক।

সোনালীনিউজ/জেডআরসি/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!