• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চাল নিয়ে ‘চালবাজি’ থামাবে কে?


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ১, ২০১৭, ০৩:৫২ পিএম
চাল নিয়ে ‘চালবাজি’ থামাবে কে?

ঢাকা: রাজধানীসহ সারাদেশে দফায় দফায় বেড়ে চলছে চালের দাম। চালের পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও গত আট মাসের মধ্যে প্রতি মাসে কয়েক দফা বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে মোটা চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ চাল কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

দাম বাড়ার কারণ হিসেবে খুচরা বিক্রেতারা ব্যবসায়ীদের কারসাজিকেই দূষছেন। তারা বলেন, প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট চাল মজুদ রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। মিলার পাইকাররা এ সংকট সৃষ্টি করে অতিমাত্রায় মুনাফা লুটে নেয়ার চেষ্টা করছেন।

কখনো মাঠপর্যায়ে ধানের দাম বেশি আবার কখনো সরবরাহ সংকট- এমন নানা অজুহাতে গেল আট মাসের বেশির ভাগ সময়ই ঊর্ধ্বমুখী থেকেছে চালের বাজার। এর মধ্যে মোটা চালের দাম বেড়েছে বেশি। তবে ডিসেম্বরের শুরুতে ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। চালের বাজার স্থিতিশীল থাকার খবরে কিছুটা স্বস্তি এসেছিল ক্রেতাদের মাঝে। কিন্তু গত সপ্তাহের শুরুতে আড়তদাররা জানালেন, আবারও বেড়েছে ধানের দাম।

সরকারি গুদাম, মোকাম ও পাইকারি বাজারে বিপুল পরিমাণ চাল মজুদ রয়েছে। এ অবস্থায় বাজারে চালের দাম কোনোভাবেই বাড়ার কথা নয়। গুটিকয়েক মিল মালিকের কারসাজিতে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠছে- এমন অভিযোগ পাইকারি ব্যবসায়ীদের।

এ প্রসঙ্গে কারওয়ান বাজার চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ রায়হান জগল বলেন, এ সময়ে চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তিনি বলেন, ‘যখনই ধানের সিজন আসে, তখনই মিল মালিকরা কয়েক হাজার মণ ধান সংগ্রহ করে রাখেন। বৈশাখের চাল এখনো আমরা বিক্রি করি।’

দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এটা মূলত মিল মালিকদের কারসাজি। মিল মালিকদের বড় একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া অন্যকোনো কারণ অযৌক্তিক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা যা করছেন, তা মোটেও সমীচীন নয়। কারণ ছাড়া যেভাবে চালের দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে, সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কারণ ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন আগেই খাদ্যমন্ত্রীর কাছে কথা দিয়েছিলেন চালের দাম আর বাড়াবেন না, কারণ পণ্যটির কোনো সংকট নেই।

গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি চালের দাম নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, চাল কল মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ধান-চালের মজুদ রয়েছে। তারা কথা দিয়েছেন বৈশাখে নতুন ধান ওঠার আগে আর চালের দাম বাড়াবেন না। বরং নতুন ধান উঠলে চালের দাম আবার স্বাভাবিক হবে। জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।

রাজধানীর কয়েকটি বাজারে দেখা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে স্বর্ণা, মিনিকেট, বিরি-২৮, পারিজাতসহ প্রায় সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৫-১০ টাকা করে বেড়েছে। আর মোটা চালের দাম ৮-১০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে ৩৮-৪০ টাকা দরে স্বর্ণা, ৪০-৪২ টাকা দরে বিরি ২৮, ৫০-৫৫ টাকা দরে মিনিকেট, ৩৮-৩৯ টাকায় পারিজাত, ৫৩-৫৬ টাকায় নাজিরশাইল, ৫৪-৫৮ টাকায় বাসমতী, ৭০-৭৫ টাকায় কাটারিভোগ এবং ৮৫-৯০ টাকা কেজিতে পোলাও’র চাল বিক্রি হচ্ছে।

এর মধ্যে মোটা গুটি চালের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। কেজিতে ১০-১২ টাকা বেড়ে এ চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকা দরে। রাজধানীর পাইকারি চালের বাজার বাবুবাজার ঘুরে দেখা গেছে, সব ধরনের চালই কেজিতে ৩ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। বিক্রেতারা দাম বাড়ার জন্য দূষছেন চাতাল ও মিল মালিকদের।

কিছু ক্ষেত্রে তারা খুচরা ব্যবসায়ীদেরও দায়ী করছেন। তারা বলছেন, মধ্য সেপ্টেম্বরে চালের দাম যেভাবে বেড়েছিল, এখনো সেই দামই আছে। সামনের আমন মৌসুমে বাজারে ধান না আসা পর্যন্ত চালের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই বলেও জানান তারা।

কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন মান ও জাতের নাজিরশাইল প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) দুই হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা, মিনিকেট দুই হাজার ২৫০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকা, বিআর-২৮ এক হাজার ৯০০ থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গেল দুই সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তের অত্যাবশ্যক এই চাল কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। কারওয়ান বাজারের লাকসাম জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মোশাররফ বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ থেকে অস্বাভাবিকভাবে সব চালের দামই বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মোটা চালের দাম।

গুটি স্বর্ণাখ্যাত মোটা চাল কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গত কয়েক বছরে এ চালের দাম এতটা বেড়েছে বলে জানা নেই। তিনি বলেন, বাজারে মোটা চাল একেবারেই নেই। যাও বিক্রি হচ্ছে তা বেশি দামে। ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষরা এই চাল না পেয়ে বেশি দামে অন্য চাল কিনছেন।

কেন এ অস্বাভাবিক দাম-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, চাতাল মালিকরা বলছেন তারা ধান কিনতে পারছেন না। কৃষকরা বাজারে ধান উঠাতে পারছে না। ধান কম থাকায়, বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই দামও বাড়ছে।

এদিকে খাদ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে এ বছর চালের চাহিদা তিন কোটি ২৮ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৮৬ লাখ টন। উদ্বৃত্ত রয়েছে ৫৮ লাখ টন। সরকার ১০ টাকা কেজি দরে দরিদ্র পরিবারের কাছে নিয়মিত চাল বিক্রি করছে।

অন্যদিকে, শুক্রবার আরেক দফা বেড়েছে চালের দাম। প্রায় সব ধরনের চালের দাম কেজি প্রতি এক থেকে দুই টাকা বেড়েছে। কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, কেজি প্রতি স্বর্ণা চাল ৪১-৪২ টাকা, পারিজা চাল ৪২-৪৩ টাকা, মিনিকেট ৫০-৫৩ টাকা, মিনিকেট নরমাল ৪৮ টাকা, বিআর২৮ ৪২-৪৪ টাকা, নাজিরশাইল ৪৪-৫০ টাকা, বাসমতি ৫৬ টাকা, কাটারিভোগ ৭৪-৭৬ টাকা, হাস্কি নাজির চাল ৪১-৪২ টাকা এবং পোলাও’র চাল ১০০ (পুরাতন), নতুন ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

মিল মালিকরা জানান, দেশে বর্তমানে প্রায় ১৭ হাজার মিল আছে। এসব মিল প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক লাখ টন চাল উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু ধানের সরবরাহ কমায় শত শত মিল বন্ধ রয়েছে। এ কারণে চালের দাম বেশি বলে দাবি করেন মিল মালিকরা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ইরি-বোরো মৌসুমের মধ্যবর্তী সময় চলতে থাকায় বাজারে ধানের সরবরাহ কম। এই সুযোগ নিচ্ছে চাল ব্যবসায়ীদের অসাধু সিন্ডিকেট। তারা চাল ধরে রাখায় দাম বাড়ছে। এ ছাড়া মিলার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ী নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করছেন অতিমাত্রায় মুনাফার। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও তারা চাল নিয়ে কারসাজি করছেন। তারা ইচ্ছামতো চালের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন।

ধান-চালের জেলা হিসেবে পরিচিত দিনাজপুরে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে চালের দাম। মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের চালের দাম ৪-৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। হুট করে চালের এই দাম বৃদ্ধির জন্য মিল মালিকদের দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, মিল মালিকদের অবৈধ মজুদের কারণেই দাম বেড়েছে চালের।

এদিকে, ধানের দাম বেড়ে যাওয়াকে চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে দাবি করছেন মিল মালিকরা।

নওগাঁ জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, মৌসুমের শেষ প্রান্ত হওয়ায় ধানের দাম কিছুটা বেড়েছে। তাই চালেরও দাম বেড়েছে। এর পরও তার হিসাবে ঢাকার বাজারে যে দামে পাইকারি চাল বিক্রি হচ্ছে, তা আরেকটু কমিয়ে রাখলেও ব্যবসায়ীদের লাভ হওয়ার কথা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মিল মালিক ও আতপ ধান-চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মসিউল করিম বাবু জানান, ধানের দাম বাড়ার প্রভাবে পাইকারি বাজারে চালের দাম বেড়েছে। ৮৪ কেজির বস্তা মিনিকেট তিন হাজার ৩০০ থেকে চার হাজার টাকা, আটাশ চাল তিন হাজার ৮০০ থেকে চার হাজার টাকা, লাল স্বর্ণা দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার ১০০ টাকা, গুটি স্বর্ণা দুই হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার ৯০০ টাকা, ছত্রিশ তিন হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!