• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চাল নিয়ে টেনশনে স্বল্প আয়ের মানুষ


শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জুন ১৩, ২০১৭, ১১:০৯ পিএম
চাল নিয়ে টেনশনে স্বল্প আয়ের মানুষ

ঢাকা: রিকশাচালক ফিরোজ কবির থাকেন রাজধানীর সেন্ট্রালরোডে। পাঁচ সদস্যের পরিবার। দশ কেজি চালে তার চলে যায় ১৫ দিন। দেড় মাস আগেও ভাবেননি এমন ধাক্কা খেতে হবে। চালের বাজারে লাগে আগুন তাকেও জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দেড় মাস আগে যে দশ কেজি চাল কিনেছেন ৩০০ টাকায়, আজ তা কিনতে হচ্ছে ৫০০ টাকায়। চালের দাম বাড়ায় প্রতিমাসে তার বাড়তি খরচ হচ্ছে চারশ টাকা। যা দিয়ে তিনি অন্তত ২০ দিনের চাল কিনতে পারতেন। দেড় মাসেই প্রতি কেজি চালে ২২ টাকা করে বেড়ে যাওয়ায় তিনি হতভম্ব হয়ে গেছেন।

জীবনে বহুবার চালের দাম বাড়া দেখেছেন- তাই বলে দেড় মাসের ব্যবধানে গরীবের ৩০ টাকা কেজির মোটা চাল এক লাফে ৫২ টাকা! তার ৫২ বছরের জীবনে এ রকম ঘটনার মুখে দাঁড়াতে হয়নি।

উত্তরের জেলা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বাসিন্দা ফিরোজ সেন্ট্রাল রোডের একটি বহুতল ভবনে নৈশ প্রহরী হিসেবে চাকরি করেন। স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে সেখানেই সিঁড়িঘরে স্থান পেয়েছেন। মেয়েটি পড়ছে ধানমন্ডির ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ওয়ার্ডব্রিজে। ছেলেটি ধানমন্ডির একটি স্কুলে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যয় ও পরিবারের খরচ সামাল দিতে দিনের বেলায় রিকশা চালান। এভাবেই টানতে হচ্ছে সংসারের ঘানি। এখন তার সামনে অতিরিক্ত চারশ টাকা খরচের বোঝা।

এক মাসেই শুধু চাল বাবদ ব্যয় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি বিরাট টেনশনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিরোজ কবির বললেন, খালি কি চালই সব জিনিসের দামও তো বাড়ছে। এখন সংসার সামাল দেয়াই তো কঠিন। এই বয়সে তাই ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক বাইরে আসতেই হয় বাড়তি খরচের যোগান দিতে। এমন ঘটনা শুধু ফিরোজ কবিরের সংসারেই নয়। তার মতো নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে চাল দাম বাড়া আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বাজারে কোনো জিনিসের দাম একবার বাড়লে আর কখনও কমে না। সরকার হাজার চেষ্টা করেও দাম কমাতে পারে না।

এদিকে, চালের দামের পাশাপশি চলতি মাস থেকেই গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করায় বিদ্যুতের দামও বাড়বে। ফলে ফিরোজ কবিরের মতো পাঁচ সদস্যর পরিবার প্রতি অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা খরচ বাড়ছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়বে পরিবহন খরও। যার প্রভাবে সকল পণ্যের দাম বাড়বে বলেই ধরে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষের আয় না বাড়লেও খরচ বেড়েই চলেছে।

সূত্রমতে, নতুন চাল আসা শুরু করলেও বাজারে মোটা চালের দাম গত দেড় মাসে কেজি প্রতি ২২ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় চালের আড়ৎ বাদামতলী ও বাবুবাজারে বিভিন্ন প্রকারের বস্তা প্রতি (৫০ কেজি) মোটা চালের দাম বেড়েছে ১ হাজার টাকা ও সরু চালের দাম বস্তা প্রতি বেড়েছে ১১০০ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায়। বিভিন্ন ব্রান্ডের চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকা কেজি প্রতি।

যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি বলছে, ১৩ জুন মোটা চাল খুচরা পর্যায়ে ৪৬-৪৮ টাকা ও চিকন চাল ৫৮ টাকা কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে টিসিবির উল্লেখ করা দরের চেয়েও চার টাকা বেশি কেজি প্রতি। কারওয়ান বাজারের চালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় এখন মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা দরে। মূলত নিম্ন ও শ্রমজীবী মানুষ এই চালের ওপর নির্ভরশীল। আর চিকন বা মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকা দরে।

পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মারুফ বলেন, চালের দাম সরকার চাইলেই কমাতে পারে। একটা সিন্ডিকেট পুরো দেশের চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে গুদামে মজুদ করেছে। এখন মিলাররা চাল বানাতে ধান পাচ্ছেন না। এ সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে পারলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

এ বিষয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় চাল সরবরাহকারী জেলা নওগাঁ রাইস মিল মালিকদের সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ধানের দাম বেড়েছে। প্রতি হাটে লোক পাঠাচ্ছি বেশি দাম দিলেও ধানের যোগান কম। ৮০০ টাকা মণের ধান এখন ১১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আমরা কেজি প্রতি ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা লাভ করেই চাল ছেড়ে দেই। এখন ধানের দাম বাড়ায় বেশি দামে চাল দিতে হচ্ছে। ধানের দাম কেন বাড়ছে, এর উত্তরে তিনি বলেন, সেটা খাদ্য মন্ত্রণালয় ও সরকার বলতে পারবে।

সরকার আপদকালীন ওএমএস এর মাধ্যমে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করলেও এবার তা করছে না। সরকারের গুদামে চালের পর্যাপ্ত মজুদ না থাকায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে খোলা বাজারে বিক্রি। আগে এই চালের ওপর ভরসা করেই অনেকে চলতো। এখন সেই পথও বন্ধ হয়ে গেল।

চালের দাম বেশি নিয়ে গত ২ জুন বাজেটোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছিলেন, বাজারের খবর আপনারা জানেন। তবে সরকার চাল কেনার জন্য ভিয়েতনামে লোক পাঠিয়েছে। টেন্ডার চালু করা হয়েছে। দ্রুতই আমরা আরো চাল আনতে পারবো।

সরকারের অসহায়ত্বের কথা ফুটে উঠে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর কথায়। তিনি বলেন, আমাদের দেশপ্রেমের ঘাটতি রয়েছে। কিছু ব্যবসায়ী সুযোগ পেলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। এদের বিরুদ্ধে আইন করা দরকার। আমাদের দেশে আইন না থাকলে সরকার কিছুই করতে পারে না।

চালের দাম হঠাৎ করে এতো বেশি কখনোই বাড়েনি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, চালের দাম বাড়ায় সবচেয়ে বেশি কষ্টে ভুগবে মধ্যম আয়ের মানুষ। সরকার হস্তক্ষেপ না করলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা দিন দিন কমে যাবে। দুর্ভোগে পড়বে স্বল্প আয়ের মানুষ।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/তালেব

Wordbridge School
Link copied!