• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চীন বলয়ে ঢুকছে নেপাল: দুশ্চিন্তায় ভারত


শেখ আবু তালেব, সিনিয়র রিপোর্টার মার্চ ১৬, ২০১৭, ০৩:০২ এএম
চীন বলয়ে ঢুকছে নেপাল: দুশ্চিন্তায় ভারত

ঢাকা: হিমালয় কন্যা নেপালের অর্থনীতি চলতি বছরে মন্দার দিকে যাচ্ছে। আর্থিক এ মন্দা কাটাতে রাজধানী কাঠমুন্ডুর সঙ্গে চীনের সরাসরি যোগাযোগের জন্য একটি অর্থনৈতিক মহাসড়ক নির্মাণ শুরু করেছে নেপাল। নেপালের এ উদ্যোগকে ভারতবিরোধী মনোভাব হিসেবে দেখছে মোদী সরকার।

তবে, চীনা পর্যবেক্ষকদের যুক্তি, চীনের দিকে নেপালের হাত বাড়িয়ে দেয়াতে ভারতের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। চীনের সঙ্গে নেপালের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোড়ালো হলে ভারতও লাভবান হবে।

চীনের এই কথায় কিন্তু বেজায় চটেছে ভারত। তারা কোনোমতেই এই সম্পর্ককে ভালোচোখে দেখতে রাজি নয়। অর্থনৈতিক এ সম্পর্ককে মূল্যায়ন করছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। দেশটি মনে করছে, ক্রমান্বয়ে নেপাল ও চীনের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক আরো গাঢ় হচ্ছে। তা এক সময়ে ভারতবিরোধী অবস্থানে রূপ নিবে। এজন্য কাঠমুন্ডুতে চীনের বিনিয়োগকে ভালোভাবে দেখছে না ভারত। অথচ নেপাল সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীনের সঙ্গে কাজ করছে তারা। এখানে বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন হচ্ছে।

নেপালের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক তথ্য বলছে, এবছর দেশটির অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাবে মাত্র ০.৭৭ শতাংশ। যা গত ১৪ বছরের ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন দেশটির নীতিনির্ধারকরা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়নোর জন্য নতুন নতুন খাত ও প্রকল্প খুঁজছেন তারা। এজন্যই চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিচ্ছে নেপাল।

সম্প্রতি চীনের উত্তর অঞ্চলের ঘানসু প্রদেশের ল্যান-ঝু শহরের সঙ্গে কাঠমুন্ডুর সরাসরি যোগাযোগ করতে একটি অর্থনৈতিক মহাসড়ক নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। সড়কটি নির্মাণ শেষ হলে দুটি দেশের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহন সহজ হবে। এই সড়ক নির্মাণ কাজ উদ্বোধনের জন্য চীন সফর করেছেন নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডুর মেয়র রুদ্র সিং তামাং।

চীন-নেপাল বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নকে ভারতের কিছু গণমাধ্যম বেশ গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, এতোদিন নেপালের দাতাগোষ্ঠীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দাতা দেশ হিসেবে ছিল ভারত। সম্প্রতি ভারতকে টপকে গিয়েছে চীন। এখন নেপালের দাতা দেশগুলোর মধ্যে প্রথম অবস্থানে রয়েছে চীন। হিমালয় কন্যা নেপালে নিজের বিনিয়োগ ও সহায়তার পরিমাণ দিন দিন বাড়িয়েই চলেছে চীন।

ভারতীয় বিশ্বেষকরা আশঙ্কা করছেন, চীনের অর্থনীতি ভারতের চেয়ে শক্তিশালী। নেপালের সঙ্গে চীনের রয়েছে সীমান্ত সম্পর্ক। কিছু এলাকা দুর্গম হলেও কয়েক জায়গায় শুধু পাহাড় দিয়ে আড়াল হয়ে আছে দুটি দেশ। অনেক সময়ে এমন উদ্যোগের কথাও শোনা যায়, প্রয়োজনে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে সুরঙ্গ করে সড়ক নির্মাণ হলে যোগাযোগ সহজ হবে। দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে না। ভারতের চেয়ে কম দামে পণ্য পাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে ধীরে ধীরে চীনের ওপর নেপালের নির্ভরতা বাড়বে। কূটনীতিতে নেপালের ওপর কৃর্তৃত্ব কমবে ভারতের। যা ভারতের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিবে। নেপালের ওপর ভর করে এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াবে চীন। এমন কথাই ঘুরে-ফিরে আসছে ভারতীয় পর্যবেক্ষকদের মনে।

নেপালের ট্রেড অ্যান্ড এক্সপোর্ট প্রমোশন সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকেরও কম সমেয়ের ব্যবধানে চীনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য ১৬ গুণ বেড়েছে। সর্বশেষ গেল কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১১ সালে যেখানে বাণিজ্য হতো ৪৬.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৫ সালে তা ১০৩.২১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। যদিও এখনো ভারতের সঙ্গেই বেশি বাণিজ্য হয়। দেশটির অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন, কম দামের পণ্যও কারণে নেপালে চাইনিজ পণ্যের বাজার আরো বাড়বে। এজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো সহজ করার জন্য কাজ করছে দুটি দেশ।

সূত্র বলছে, নেপালের জনগণও চাইছে দেশটির বিভিন্ন খাতে ভারত যেভাবে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে তাতে আগামীতে আরো পিছিয়ে পড়বে তারা। দেশটির জনগণ চাইছে ভারতের বিগ ব্রাদার সুলভ দাদাগিরি আচরণ থেকে বেরিয়ে যেতে। নিজেকে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করতে। এজন্য বিশ্বের কাছে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে সংবিধান পর্যন্ত সংশোধন করেছে তারা। নেপাল যে মূলত হিন্দু রাষ্ট্র নয়, তা নতুন করে চিনিয়ে দিতে চাচ্ছে। এজন্য ভারতমুখি নেপাল এখন কিছুটা চীনমুখি নীতি অবলম্বন শুরু করেছে।

অপরদিকে, বিষয়টি বেশ মজার সঙ্গে উপভোগ করছে চীনা পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে, নেপালের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য বিস্তারের ভারতের দুশ্চিন্তা বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এতে ভারতের ও লাভ হবে। তবে দেশটির কূটনীতিকরা আরো একধাপ এগিয়ে বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, চীনকে শত্রু মনে করা ভারতের উচিত হবে না। ভারত অথবা চীনের মধ্যে একটি রাষ্ট্রকে বেছে নিতে নেপালকে বাধ্য করার এমন কোনো শর্ত দেয়া যাবে না। এটি হবে সংকীর্ণ মানসিকতা। ভারতকে এই সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে হবে। নেপালের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কে ভারতও লাভবান হতে পারে। বিশেষ করে চীনের পরিকল্পনা হচ্ছে, নেপালের হিমালয়ের পাদ দেশ থেকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য বৃদ্ধি। এজন্য সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলংকাতেও বিনিয়োগ বাড়িয়েছে চীন। বাণিজ্যিক সম্পর্কে ভারত যোগ দিলে তারও লাভ হবে। এমন কথাই ভারতকে জানাতে চাচ্ছে চীন।

এ নিয়ে শঙ্কিত ভারতের বিশ্লেষকরা বলছেন, এশিয়ার দেশগুলোতে চীন বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে মূলত ভারতের প্রভাবকে ক্ষুণ্ণ করতে। এজন্য ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন দেশের সঙ্গে চীন বাণিজ্যের আড়ালে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোড়ালো করছে। যা এক সময়ে এশিয়ায় ভারতের প্রভাবকে কমিয়ে দেবে।

তবে, বিষয়টিকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। তাদের মতে, চীন ও ভারতের মধ্যে কিছু বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব যেমন আছে, ঠিক তেমনি ভারতকে মনে রাখতে হবে চীনের তুলনায় তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি দুর্বল। এজন্য নেপাল, চীন ও ভারত এই তিনদেশ তাদের বাণিজ্যের বিভিন্ন ইস্যুতে একত্রে কাজ করতে পারে। তাহলে পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক পর্যায়ে অন্যান্য দ্বন্দ্বগুলোও তারা কমিয়ে আনতে পারবে। তার আগ পর্যন্ত এই ইস্যুকে আলাদা রেখেই বহুমাত্রিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে দেশ তিনটিকে।

নেপালকে সামনে রেখেই ভারত এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে। নইলে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা নেপালের জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধিতা দানা বাঁধবে। যা ভারতের জন্য মোটেও সুখকর হবে না বলেই মনে করছেন তারা।

সোনালীনিউজ/আতা/এন

Wordbridge School
Link copied!