• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভয় আছে সরকারের!


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ৮, ২০১৭, ০৯:৫৮ পিএম
ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভয় আছে সরকারের!

ঢাকা: আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের কোথাও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন নেই ২৭ বছর হলো।

একই সময় ধরে নির্বাচন হয় না গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্য সূতিকাগার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চাকসু) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাকসু)। আর ২৫ বছর ধরে নিষ্ক্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু)। এক বছর পরপর নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও এই চার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গত দুদশক ধরেই নির্বাচন নেই দেশের কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এর আগেও জাতীয় সংকটে বারবার ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ এসেছে। আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু আমলে নেয়নি কোনো সরকারই। উদ্যোগী হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় আচার্য মো. আবদুল হামিদ ডাকসু নির্বাচনের তাগাদা দিলে নতুন করে আলোচনায় আসে বিষয়টি। সেদিন রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ অ্যা মাস্ট। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।’

রাষ্ট্রপতির এই আহ্বানের পর পরই আড়াই যুগেরও বেশি সময় ধরে আটকে থাকা ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি বিভিন্ন মহলেও আলোচিত হচ্ছে বিষয়টি। কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সরকারের মধ্যেও এক ধরনের আলোচনা শুরু হয়েছে।

অবশ্য এর আগে গত জানুয়ারির শুরুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়ার তাগাদা দিয়েছিলেন। অনুরূপ তাগাদা এসেছিল শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পক্ষ থেকেও।

এরপর নির্বাচনের পক্ষ নিলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু কোনোবারই এই তাগাদা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি সংশ্লিষ্টদের। ফলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। কী করবে এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? নির্বাচন কি আদৌ হবে; নাকি অন্য সময়ের মতো কেবল তাগাদাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে বিষয়টি? নাকি সরকার সত্যি সত্যিই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবে?

এসব প্রশ্নের উত্তরে সাবেক ও বর্তমান ছাত্রনেতা এবং শিক্ষাবিদরা বলেন, দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ থাকায় ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বের বিকাশ, গণতন্ত্র ও সংস্কৃতিচর্চায় ব্যাঘাত ঘটছে। এমনকি শিক্ষার মান বৃদ্ধি, গবেষণা, উন্নত খাবার, আবাসন সমস্যাসহ শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নিয়েই কথা বলার কেউ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি থাকার নিয়ম থাকলেও ছাত্র সংসদ না থাকায় তা শূন্যই পড়ে থাকছে বছরের পর বছর।

এসব ছাত্রনেতা ও শিক্ষাবিদরা বিভিন্ন সময় ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাওয়াকে ‘কথার কথা’ বলে মত দেন। তারা বলেন, সবাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন চায়। কিন্তু এই চাওয়া শুধু কথার কথা, মুখে মুখে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ঘৃণ্য দলবাজি-দলীয়করণ চালিয়েছে।

তারা প্রকৃত ছাত্র রাজনীতিকে হত্যা করে জ্ঞান-মেধা-যুক্তিতর্কের পরিবর্তে অস্ত্রের রাজত্ব কায়েম করেছে। আর এই রাজত্ব যাতে হুমকির মুখে না পড়ে, তাই কোনো রাজনৈতিক দলই মন থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চায় না। তারা কিছুতেই চায় না ছাত্রদের সুসংগঠিত ও কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াক। সেজন্য নির্বাচন দেয় না।

শেষ কবে নির্বাচন : ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। ওই নির্বাচনে আমান উল্লাহ আমান সহসভাপতি ও খায়রুল কবির খোকন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, ১৯৯৪ সালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেও তা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৬ সালে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী অন্তত ছয়বার ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমা জানালেও শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে ব্যর্থ হন। পরে ১৯৯৮ সালের ২৭ মে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় ডাকসু ভেঙে দেয়া হয়।

সে সময় ডাকসুর জন্য গঠিত নতুন সংশোধিত গঠনতন্ত্রে ডাকসু ভাঙার চার মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হলেও এক যুগেও তা আর সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে ডাকসু নির্বাচন দেয়ার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তব রূপ পায়নি। সর্বশেষ গত শনিবার রাষ্ট্রপতি ডাকসু নির্বাচনের তাগাদা দিলে এবারও উপাচার্য নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদেরও (জাকসু) সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯২ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ বিদায়ী উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন জাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। তবে সবচেয়ে বেশি সময় ২৮ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু)। রাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। এর ঠিক এক বছর আগে ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয়। পরে শিবির ক্যাডারদের হাতে ছাত্রঐক্য নেতা ফারুকুজ্জামান খুন হওয়ায় ছাত্র সংসদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ।

কেন নির্বাচন হচ্ছে না : ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশে বিরাজনীতিকরণের একটি ধাপ হচ্ছে এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া। এটি ছাত্রসমাজের একটি অধিকার হরণ ছাড়া আর কিছু নয়। বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার সঙ্গে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে জড়িয়ে ফেলার কারণেই এ নির্বাচন হচ্ছে না।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নির্বাচন না হওয়ার কারণ যারা ক্ষমতায় থাকে তারা কখনোই নির্বাচন চায় না। সরকারি দল সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। সরকারের আশঙ্কা নির্বাচন হলে ফলাফল তাদের বিপক্ষে যাবে, আর এতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে।

ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ক্ষমতাসীন সরকারগুলো মনে করে নির্বাচন দিলে তাদের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলো হেরে যাবে। এই আশঙ্কা সত্য। কারণ ডাকসুতে বরাবরই ক্ষমতার বিপরীতে থাকা ছাত্র সংগঠনগুলো জয়লাভ করেছে। সরকার বেকায়দায় পড়বে।

ক্ষমতার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। তাই নির্বাচন দিতে ভয় পায়। অন্য কারণ হলো সরকারগুলো অর্থনীতিতে লুটপাটের ধারা অব্যাহত রাখতে ছাত্র ও শ্রমিক নেতৃত্বকে সংগঠিত হতে দিতে চায় না। তাদের চেষ্টাই থাকে ছাত্র ও শ্রমিক নেতা ও নেতৃত্বকে অচল ও অসংগঠিত করে রাখার। সুতরাং কোনো সরকারই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আগ্রহী নয়।

ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি তুহিন কান্তি দাস বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একনায়কতান্ত্রিক চরিত্রের একটি প্রতিফলন হচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া। কারণ ছাত্র সংসদ সচল হলে এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ওপর যেভাবে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় সেটা সম্ভব হবে না, প্রশাসনের ক্ষমতা খর্ব হবে। এজন্যই নির্বাচন হয় না। নির্বাচনের জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের সচেতন হতে হবে এবং নির্বাচনের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যাতে প্রশাসন নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ছাত্ররা কিছুতেই সংঘবদ্ধ হচ্ছে না। কারণ তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা জাগানো যাচ্ছে না। এর কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই। স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক চর্চা না থাকায় সাংস্কৃতিক চর্চাও মুখ থুবড়ে পড়েছে।

অন্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের লালনভূমি, এই লালন শ্রেণিকক্ষে হয় না। এজন্য চাই ছাত্র সংসদ, যাতে শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবন গঠনের সুযোগ পায়। ছাত্র সংসদ না থাকায় দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগৎ নেতৃত্বশূন্য হচ্ছে।

ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, লাঠিপেটা করে যে শিক্ষা দেয়া হয় সে শিক্ষা কখনোই একজন মানুষকে প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না। একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে হবে, তাদের সহপাঠ্য কার্যক্রমকে উন্নত করতে হবে। আর সেজন্যই ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাই। ছাত্রদের কেন্দ্রীভূত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র নেতৃত্ব যেমন প্রতিষ্ঠা পাবে; তেমনি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বও তৈরি হবে।

ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ বলেন, বর্তমানে দেশে ছাত্র রাজনীতি অনুপস্থিত। ফলে দেশের ও জাতীয় স্বার্থে সেই ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭০, ৭১ ও ৯০-এর মতো ঐক্যবদ্ধভাবে জেগে উঠতে পারছে না। ঐক্যবদ্ধ ছাত্র নেতৃত্বের জন্য ছাত্র সংসদ দরকার। আমার বিশ্বাস মুক্ত রাজনীতি চর্চার পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে জঙ্গিবাদসহ দুর্নীতি ও সন্ত্রাস এবং মুক্তি সংগ্রামের চেতনা বিরোধী শক্তির পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!