• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছিটকে পড়ছেন আ.লীগের শতাধিক এমপি!


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ২, ২০১৭, ০৩:৩৫ পিএম
ছিটকে পড়ছেন আ.লীগের শতাধিক এমপি!

ঢাকা: নানা কর্মকান্ডে বিতর্কিত সংসদ সদস্যরা আগামি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই জয় ছিনিয়ে আনতে যাদের প্রভাব বেশি থাকবে এবং দলীয় কোন্দল ও ক্লিন ইমেজের প্রার্থীদেরই প্রতিদ্বন্ধিতায় নামাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

এ লক্ষ্যে বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে এক থেকে দেড়শ জন এবার দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছেন। নিজেদের বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণেই দল থেকে ছিটকে পড়ছেন তারা। দলের হাইকমান্ড থেকে এমন বার্তাই তৃণমূলে পৌছে দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজার-টেকনাফের বিতর্কিত সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে এবার আর মনোনয়ন দেয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সম্প্রতি কক্সবাজারে ঘূর্ণিঝড় মোরায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এ কথা সাফ জানিয়ে দেন সরকারদলীয় ওই এমপিকে। এলাকার রাস্তাঘাটের করুণ অবস্থা দেখে দলের সাধারণ সম্পাদক এ কথা জানিয়ে দিলেও তার পেছনে রয়েছে বদির দুর্নীতি ও ইয়াবা চোরাচালানের অভিযোগ।

এভাবে আগামী নির্বাচনে দলের টিকিট হারানোর আতঙ্কে রয়েছেন আওয়ামী লীগের শতাধিক সংসদ সদস্য। হত্যা, খুন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মাদক ব্যবসায়, স্বজনপ্রীতিসহ নানা ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মনোনয়ন হারাতে পারেন জনবিচ্ছিন্ন এসব এমপি। তবে শেষ মুহূর্তে জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে পারলে কেউ কেউ দলের টিকিট পেয়েও যেতে পারেন।

দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্রগুলো জানায়, গোয়েন্দাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এলাকায় এমপিদের অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে। এতে বেশ কিছু সংসদ সদস্যের দুর্নীতি, তাদের পরিবারের সদস্যদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড, তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে দূরত্ব, চর ও সম্পত্তি দখল, বিরোধী নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নানা তথ্য উঠে এসেছে। কোনো কোনো এমপির বিরুদ্ধে নিজ দলীয় নেতাকর্মী হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগও আছে।

বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল, ভোলা, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, ফেনী, কক্সবাজার, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাইবান্ধা, যশোর, খুলনা, রাজশাহী জেলার বেশ কিছু এমপির বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই খোঁজখবর নিয়েছেন।

দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, নানা সময় গণমাধ্যমে যেসব এমপির বিতর্কিত কাজে জড়িত থাকার কথা এসেছে এবার তাদের মনোনয়ন নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে। এ তালিকায় অন্যতম হচ্ছেন কক্সবাজার-টেকনাফের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। দলের নেতা হত্যা মামলায় টাঙ্গাইলের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান এখন কারাগারে।

সম্প্রতি ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি বজলুল হক হারুনের মালিকানাধীন হোটেল ‘রেইনট্রিতে’ তরুণী ধর্ষণের ঘটনা দেশ-বিদেশে আলোড়ন তুলেছে। লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগর আসনের এমপি আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে রয়েছে এলাকায় চর দখল ও বিরোধী নেতাকর্মী পুনর্বাসনের অভিযোগ। এলাকায় তার মনোনীত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে উঠেছে ধর্ষণের অভিযোগ।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর-পতেঙ্গা আসনের এমপি এম এ লতিফ, ঢাকা-১৪ আসনের আসলামুল হক আসলাম, ঢাকা-১৯ আসনের এমপি ডা: এনামুর রহমান এনাম, খুলনা-১ আসনের এমপি ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ননী গোপাল মণ্ডল, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, বরগুনা-২ আসনের এমপি শওকত হাছানুর রহমান রিমন, খুলনা-৫ আসনের এমপি নারায়ণচন্দ্র চন্দ, পিরোজপুর-১ আসনের এ কে এম এ আউয়াল, যশোর-১ আসনের শেখ আফিল উদ্দিন, যশোর-৪ আসনের রণজিৎ কুমার রায়,

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের গোলাম রব্বানী, রাজশাহী-৪ আসনের মো: এনামুল হক, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের এমপি দবিরুল ইসলামসহ দিনাজপুর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জের একাধিক এমপির বিরুদ্ধে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ জমা পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, বর্তমান দশম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমপি রয়েছেন ২৩৪ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ২১৬ এবং নারী ১৮ জন। বিভিন্ন সংস্থা ও আওয়ামী লীগের পে পরিচালিত একাধিক জরিপে দেখা গেছে, এই ২৩৪ এমপির মধ্যে কম বেশি ১৫০ জনের সবাই বিতর্কিত। তাদের মধ্যে কেউ জনবিচ্ছিন্ন, কেউ আত্মীয়করণে জড়িত, কেউ দুর্নীতিবাজ, কেউ টিআর-কাবিখার অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, কেউ চাকরি দেয়ার নাম করে অর্থ লুটে নিয়েছেন। কেউ আবার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদকব্যবসায় এবং দখলবাণিজ্যে জড়িত।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে জানা গেছে, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছে। এ নির্বাচনে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি এবং আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের। দলটি ধারাবাহিকভাবে দুই মেয়াদে মতায় থাকায় মন্ত্রী-এমপি-দলীয় নেতাকর্মী এবং তাদের আত্মীয়স্বজনের বিরূপ আচরণে সাধারণ মানুষের সমর্থন কমেছে।

আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জরিপগুলোতেও দেখা গেছে, ব্যক্তি শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বহুগুণ বাড়লেও দলের জনপ্রিয়তার পারদ বেশ নিম্নগামী। এ ছাড়া ২০০৮-এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পে যে জনজোয়ার ছিল নানা কারণে এখন তাতে রয়েছে ভাটার টান। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার একপেশে নির্বাচনও এবার হওয়ার সম্ভাবনা কম।

সব মিলিয়ে একাদশ নির্বাচন নিয়ে বেশ চিন্তিত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল। সে জন্য নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে প্রার্থী পরিবর্তনকেই উপায় হিসেবে ভাবছে দলটি। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা একাধিকবার আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের এ ব্যাপারে হুঁশিয়ার করেছেন।

তিনি বলে দিয়েছেন, ‘মুখ দেখে আর মনোনয়ন দেয়া হবে না। এবারের নির্বাচন বেশ কঠিন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। নির্বাচনী জরিপে যাদের অবস্থান ভালো, জিতে আসতে পারবে তারাই দলীয় মনোনয়ন পাবেন।’ তিনি এটাও বলেছেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আমি অনেকের দায়িত্ব নিয়েছি। এবার কারো দায়িত্ব নিতে পারব না।’ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ শীর্ষ নেতারা বলছেন, এবারের নির্বাচনে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ প্রার্থী বদল হতে পারে।

দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে সবার আমলনামা রয়েছে, এমন খবরের পরই টেনশনে পড়েছেন বিতর্কিত এমপিরা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি দলীয় ফোরামসহ একাধিক অনুষ্ঠানে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনে জনবিচ্ছিন্ন ও বিতর্কিত কোনো নেতা বা এমপিকে আর মনোনয়ন দেয়া হবে না। এ অবস্থায় দলীয় মনোনয়ন পাওয়া বেশ কঠিন হবে বলে ভাবছেন আওয়ামী লীগের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাও।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, দশম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না বলে এমপি মনোনয়নে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এবারের নির্বাচনটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে। তাই বিতর্কিত ও কম জনপ্রিয় নেতা বা মন্ত্রী এমপিদের মনোনয়ন না দেয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। জনপ্রিয়, সৎ ও ত্যাগী নেতাদের মনোনয়ন দিয়ে তিনি আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করতে চান।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!