• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে ব্যাংকিং খাতের বিশেষ উদ্যোগ


সোনালীনিউজ রিপোর্ট মে ৭, ২০১৬, ০২:২৬ পিএম
জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে ব্যাংকিং খাতের বিশেষ উদ্যোগ

দেশে উগ্রপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠিগুলো তৎপরতা চালাতে নানা কৌশলে অর্থ সংগ্রহ করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন উপায়ে বিদেশ থেকেও জঙ্গিদের কাছে আসছে মোটা অঙ্কের অর্থ। আবার দেশেও সমমনা ব্যক্তিদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা তুলে জঙ্গিদের ফান্ড গঠন করা হচ্ছে। তাছাড়া বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক ডাকাতি এবং ছিনতাই করেও টাকা সংগ্রহ করে জঙ্গিরা তাদের উগ্রপন্থি কর্মকান্ডে খরচ করছে।

সম্প্রতি জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীল এমন কিছু ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব নম্বরে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। যা দেখে গোয়েন্দাদের ধারণা─ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে সংক্ষুব্ধ কোনো রাজনৈতিক মহল জঙ্গিদের অর্থায়ন করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে কর্মরত ব্যাংকগুলোকে জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে বিশেষ উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকিং খাত ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জঙ্গিরা নিজেদেও অর্থ ব্যবহার করে ইতিমধ্যে দেশে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। পাশাপাশি উগ্রপন্থিরা সম্প্রতি যে ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে অপারেশন চালাচ্ছে তাতেও বেশ বড় ধরনের অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়েছে। কারণ প্রায় প্রতিটি অপারেশনেই জঙ্গিদের হেফাজতে একাধিক বিদেশি অস্ত্র, বোমা থাকে। এসব সংগ্রহ করতে মোটা অঙ্কের টাকা প্রয়োজন।

এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে উগ্রপন্থিদের গ্রেফতারের পাশাপাশি তাদের আর্থিক নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করাও জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) দীর্ঘদিন ধরেই ডাকাতি ও ছিনতাই করে ফান্ড গঠন করে আসছে। ২০১৪ সালে সাভারে ব্যাংক ডাকাতিতে জেএমবির একটি সশস্ত্র দল অংশ নেয়। 

তাছাড়া গত দু’বছরে অন্তত ৩০টি বড় ধরনের ডাকাতি ও ছিনতাইয়েও জেএমবির জড়িত থাকার তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে রয়েছে। তবে সম্প্রতি জেএমবি অর্থ সংগ্রহে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের কৌশল থেকে কিছুটা সরে সংক্ষুব্ধ রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে ফান্ড সংগ্রহের দিকে বেশি ঝুঁকছে। কেউ কেউ বিদেশ থেকে বোমা তৈরির কাঁচামাল কিনতে জঙ্গিদের সাহায্যও করছে।

সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিং ও জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় সব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনলাইন সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। সেটি কার্যকর হলে ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেন ও মানি লন্ডারিংয়ে জড়িতদের শনাক্ত করা সহজ হবে। ওই জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সে সংক্রান্ত কার্যক্রমও প্রায় শেষ পর্যায়ে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (রাজনৈতিক) নেতৃত্বাধীন এই সংক্রান্ত পাঁচ সদস্যের কমিটি ইতিমধ্যে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। কমিটিতে রয়েছেন বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইউনিটের (বিএফইউ) মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিনিধি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রতিনিধি, বিটিআরসির প্রতিনিধি এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের প্রতিনিধি। সরকারের সিদ্ধান্ত মতে, বড় ধরনের লেনদেন করতে হলে নতুন কোনো ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেও রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে।

এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) প্রতিনিধি দল গতবছর ঢাকা সফর করে। তারা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পররাষ্ট্র, আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করে। ওই সময় অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশের সক্ষমতার কিছু অভাব রয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও জেএমবির সদস্যরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে না। তাদের বাসা ভাড়া ও খাওয়া-দাওয়ার খরচ সংগঠনের নেতৃস্থানীয়রা বহন করে। আর যারা নতুনভাবে ওসব সংগঠনের যুক্ত হন তাদের বলা হয় সুধী। অনেক ক্ষেত্রে সুধীদের কাছ থেকেও মাসিক চাঁদা নেয়া হয়। তার অঙ্ক ছোট হলেও উগ্রপন্থিরা মনে করে নিয়মিত চাঁদা তোলা হলে সংগঠনের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পায়।

ইতিমধ্যে উগ্রপন্থিদের কেউ কেউ নিজেদের জায়গা বিক্রি করেও সংগঠনের ফান্ডে টাকা দিয়েছে। তাছাড়া এর আগেও নামে-বেনামে জঙ্গিদের অর্থ-সম্পদের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে গুলি করে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর জেএমবির কয়েকজন নেতার বাড়ি-গাড়ির তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। 

এমনকি রাহাত ও আজমীর নামে জেএমবির দুই নেতার রাজধানীর কল্যাণপুরে পোশাক কারখানা ছিল। ওই ঘটনার পরই জঙ্গি অর্থায়নের ব্যাপারে সতর্ক থাকে গোয়েন্দা পুলিশ। সফটওয়্যার কোম্পানির আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গিদের অর্থায়ন করে আসছে বাংলাদেশভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইব্যাকস লিমিটেড। ওই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বিদেশ থেকে অবৈধ চ্যানেলে বাংলাদেশে টাকা পাঠায়। 

ইতিমধ্যে দুটি চালান কয়েকটি উগ্রপন্থির হাতে চলে গেছে। কিন্তু সর্বশেষ গতবছরের ডিসেম্বরে আসা ৩৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকার আরেকটি চালান জঙ্গিদের হাতে পৌঁছার আগেই গোয়েন্দারা তা জানতে পারে। তারপরই ওই চালানটি জব্দ করে সোনালী ব্যাংকে মামলার আলামত হিসাবে জব্দ রাখে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

এদিকে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক (এফএটিএ)-এর ২ নম্বর সুপারিশক্রমে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০০২-এর ধারা ২৩(২), ২৪(২) ও (৩) প্রয়োগ হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সঙ্গতি রেখে দেশের সব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইন সংযোগ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক (এফএটিএ) সাথেও ওই অনলাইনের যোগাযোগ থাকবে। অনলাইনে অবৈধ লেনদেনকারী হিসাবে চিহ্নিত হলে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করবে। পাশাপাশি দেশে জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধান কার্যক্রমও আরো জোরদার ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্স কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

তা হচ্ছে─বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স কোনো জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা তার ওপর নজরদারি বাড়ানো, কোনো ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের অস্বাভাবিক লেনদেনের ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাকে অবগত করা, বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, কোচিং সেন্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এনজিও, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে জঙ্গি তৎপরতা এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে কিনা তার ওপর নজরদারি বাড়ানো, সীমান্তে অবৈধ লেনদেন, আদান-প্রদান, চলাচল ও স্থানান্তরের বিষয়ে কঠোর নজরদারি, কুরিয়ার সার্ভিস, মোবাইল ব্যাংকিং ও বিকাশের মাধ্যমে অস্বাভাবিক অর্থ আদান-প্রদান হচ্ছে কিনা তার খোঁজ নেয়া, সুদমুক্ত আমানতকারীদের সুদ বা লভ্যাংশের কতো টাকা এই পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকে জমা হয়েছে এবং ওই অর্থ কোথায় ব্যয় হয়েছে তার হিসাব নেয়া, সন্দেহভাজন টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে জঙ্গি অর্থায়ন হচ্ছে কিনা তার ওপর নজরদারি অব্যাহত ও শরিয়াভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক পরিচালনার জন্য পৃথক আইন না থাকায় সাধারণ ব্যাংকিং আইনে কোনো বিধান সংযোজন করে বিদ্যমান আইনের সংশোধন করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

তাছাড়া চট্টগ্রামভিত্তিক বেশ কিছু এনজিও বিদেশ থেকে অনেক অর্থ পায়। ওসব অর্থ কীভাবে খরচ হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা অনেকেই জরুরি বলে মনে করেন। পাশাপাশি তারা জঙ্গি অর্থায়নের পেছনে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও নিবিড়ভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন। কারণ জঙ্গি অর্থায়নের শেকড় অনেক গভীরে। টিএফআইতে বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে উগ্রপন্থিদের অর্থায়নের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার হাফেজ সালাহুল ইসলামকে বিভিন্ন দফায় টিএফআইতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। 

সেখানে তিনি জানিয়েছেন কক্সবাজারে মাদ্রাসার নামে অনুদানের কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে অর্থ আনা হয়। ওই অর্থের কিছু উগ্রপন্থিদের হাতে গেছে। রংপুরে জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও হত্যার পর গোয়েন্দারা জানতে পারেন স্থানীয় এক ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব নম্বরে প্রায় ৯০ লাখ টাকার মতো লেনদেন হয়েছে। যা তার পূর্ববর্তী বছরের ব্যাংক লেনদেনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। এর পর ওই হিসাব নম্বরের সূত্র ধরে হোশি কোনিওর খুনিদের ব্যাপারে গোয়েন্দারা অনেক তথ্য পান।

অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের মতে- বিশ্বের অধিকাংশ দেশেবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে অন্যান্য ব্যাংকের কানেক্টিভিটি থাকায় অবৈধ লেনদেনকারীদের শনাক্ত করা সহজ হয়। তবে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় এই পদ্ধতি না থাকায় বিদেশ থেকে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতায় অর্থায়ন করা সহজ হচ্ছে। এই সুযোগে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠী ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে অর্থ এনে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কাজে ব্যয়ও করছে। এমনকি সরকারবিরোধী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় সংগঠন, বিভিন্ন এনজিও ও অসাধু ব্যবসায়ীরাও এই সুযোগ নিচ্ছে। আর অনেক ক্ষেত্রেই ওসব লেনদেনকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় ব্যাংক-বীমার মধ্যে অনলাইন সংযোজন স্থাপন করে যে কোনো লেনদেন তদারক করলে মানি লন্ডারিং ও অস্বাভাবিক লেনদেনকারীদের শনাক্ত করা সহজ হবে। কারা দেশ থেকে অর্থ পাচার বা কী পরিমাণ অর্থ লেনদেন করছে তাও শনাক্ত করা যাবে। 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আমা

Wordbridge School
Link copied!