• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গিদের অস্ত্র-বিস্ফোরকের উৎস জানা নেই পুলিশের!


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ১, ২০১৭, ০৩:২৮ পিএম
জঙ্গিদের অস্ত্র-বিস্ফোরকের উৎস জানা নেই পুলিশের!

ঢাকা: দেশে হঠাৎ করে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ঘুম নেই। একের পর এক জঙ্গি আস্তানার পেছনে ছুটছেন তারা। গুলশানের অপারেশন থান্ডারবোল্ট থেকে মৌলভীবাজারের হিটব্যাক পর্যন্ত প্রতিটি অপারেশনে জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দীর্ঘদিন কোণঠাসা হয়ে পড়া জঙ্গিরা আরও ভয়ংকর রূপে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। একের পর এক আত্মঘাতী বিস্ফোরণে তাদের ভয়ংকর রূপ দেখাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

এদিকে জঙ্গিদের হাতে বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ শক্তিশালী বোমা ও বিস্ফোরক কোথা থেকে আসছে, এসবের উৎস কোথায় এবং অর্থের জোগানদাতাদের বিষয়ে এখনো অন্ধকারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জঙ্গি আস্তানার সন্ধানে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে র‌্যাব-পুলিশের একাধিক দল। সম্প্রতি জঙ্গি আস্তানার খোঁজে দেশের সব পুলিশ সুপারদের বিশেষ সতর্কতা এবং অভিযানের নির্দেশ দেয়া হয় পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে। সেই নির্দেশের পর জঙ্গিদের সন্ধানে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন জেলাপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। এরপর থেকে একের পর এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মিলছে। আবার এমনও হয়েছে, জঙ্গি আস্তানার তথ্য পেয়ে অভিযান চালিয়েও সেখানে কোনো আলামতই মেলেনি। দেশব্যাপী এখন পুলিশের ব্লক রেইড চলছে।

গত বছরের ১ জুলাই দেশের মানুষকে অবাক করে দিয়ে রাজধানীর গুলশানে একটি অভিজাত হোটেলে হামলা করে জঙ্গিরা। ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গিদের হঠাৎ এমন হামলায় হতবাক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ দেশবাসী। বিদেশি ওই রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ নিহত হন ২৫ জন। হামলাকারী পাঁচ সশস্ত্র জঙ্গিও কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়। রচিত হয় দেশের ইতিহাসে জঘন্যতম অধ্যায়ের।

এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতকে টার্গেট করে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। দুটি ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুরু হয় জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযান। এরপর একে একে সন্ধান মেলে অন্তত একডজন জঙ্গি আস্তানার। একের পর এক তছনছ হতে থাকে জঙ্গি আস্তানা ও তাদের নেটওয়ার্ক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন তৎপরতায় আরো ভয়ংকর হয়ে আত্মঘাতীরূপে ফিরছে জঙ্গিরা।

সম্প্রতি জঙ্গি হামলার ধরনে পরিবর্তন এসেছে। এখন ভিন্নমতাদর্শীদের হত্যার পর বিদেশি নাগরিক হত্যা, স্থাপনায় ও পুলিশ চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে হত্যা এবং প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করছে জঙ্গিরা। প্রথমদিকে অভিযানের সময় আত্মহত্যা করলেও এখন তারা শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হচ্ছে।

জঙ্গিদের এমন আচরণ পরিবর্তনের বিষয়ে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, একের পর এক অভিযান আর কড়া নজরদারির কারণে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়া জঙ্গি ও তাদের মদদদাতারা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে এবং এ দেশে ‘জঙ্গি আছে’ প্রমাণ করতেই এখন আত্মঘাতী হামলার কৌশল নিয়েছে। আগে হামলায় ব্যবহৃত হ্যান্ড গ্রেনেডগুলোর চেয়ে বড় ও শক্তিশালী বোমা এখন সুইসাইডাল ভেস্টে ব্যবহার করছে জঙ্গিরা।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়া নব্য জেএমবির জঙ্গিরা ঘর ছেড়ে বিভিন্ন গোপন আস্তানায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু গোয়েন্দা নজরদারির কারণে হামলা চালাতে বাইরেও আসতে পারছে না। গুলশান হামলার পর বিভিন্ন অভিযানে নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিহত ও গ্রেপ্তারের ফলে তাদের নেটওয়ার্কও ভেঙে গেছে। তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের সীমান্ত এলাকা, যশোর, কুমিল্লা ও ঝিনাইদহে অনেক আস্তানা আছে জঙ্গিদের।

কুমিল্লায় দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর চট্টগ্রামে জঙ্গিদের তিনটি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। এরপর সিলেট, মৌলভীবাজার একং কুমিল্লায় মিলেছে আরো জঙ্গি আস্তানার। সিলেটে নারীসহ চার জঙ্গির লাশ উদ্ধার হয়। আর মৌলভীবাজারের আস্তানায় মিলেছে ৭-৮ জন জঙ্গির লাশ। এসব আস্তানায় কমান্ডো বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলি ও বোমা মেরে পাল্টা হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা। এদের কেউ আত্মঘাতী বিস্ফোরণ আবার কেউবা কমান্ডো বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে।

প্রতিটি আস্তানায় অভিযান শেষে প্রাপ্ত আলামত ঘেঁটে দেখা গেছে, জঙ্গিরা এসব আস্তানায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ করেছিল। ভাড়াবাসায় বসেই শক্তিশালী বোমা তৈরি করছে তারা। নব্য জেএমবির স্লিপার সেলে প্রশিক্ষিত বোমার কারিগরও রয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে জঙ্গিরা এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ করছে, সে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে গোয়েন্দাদের।

শক্তিশালী বোমাসহ কয়েকজন জঙ্গির আত্মগোপনে থাকার তথ্যও পেয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি নব্য জেএমবির বোমা ও অস্ত্র সরবরাহকারী বড় মিজান গ্রেপ্তার হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য মিলেছে-হাদীসুর রহমান সাগর, আবদুস সামাদ মামু ওরফে আরিফ, ছোট মিজান, সোহেল মাহফুজসহ কয়েকজন অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী আছে নব্য জেএমবির। দীর্ঘদিন ধরে তারা ভারত থেকে এসব অস্ত্র ও উপাদান নিয়ে আসছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গি ইমতিয়াজ অমি ওরফে আজওয়াদ ও মাহমুদ হাসান তদন্তসংশ্লিষ্টদের জানিয়েছে, গ্রেপ্তারের আগেই তারা দুই দফায় ১২টি শক্তিশালী বোমা ঢাকায় পৌঁছে দিয়েছিল। তাদের বেশির ভাগই রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় আস্তানা গেড়েছে। ইতোমধ্যে আশকোনায় র‌্যাবের স্থাপনা ও বিমানবন্দর সড়কে পুলিশ চেকপোস্ট লক্ষ্য করে দুটি আত্মঘাতী হামলায় এ ধরনের শক্তিশালী বোমা ব্যবহৃত হয়েছে। আরো অন্তত ১০টি শক্তিশালী বোমা অবিস্ফোরিত অবস্থায় জঙ্গিদের হাতে রয়েছে।

বোমাগুলো এতটাই শক্তিশালী, একটি বোমা দিয়ে অনায়সেই পুরো ভবন গুঁড়িয়ে দেয়া সম্ভব। অন্যদিকে এসব বোমা যদি কোনো জনসমাবেশে বিস্ফোরণ ঘটানো যায়, তবে কয়েক সেকেন্ডেই কয়েকশ’ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। আর তাই শক্তিশালী এই বোমাগুলো নিয়ে হামলার আগেই জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করতে চাইছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জঙ্গিদের মধ্যে আত্মঘাতী হামলা চালানোর প্রবণতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। জঙ্গিরা পুলিশকে ‘তাগুত শক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে টার্গেট করছে। র‌্যাব-পুলিশকে টার্গেট করে তিন তিনটি হামলার ঘটনা তারই প্রমাণ করে। হামলাকারীরা আত্মঘাতী হওয়ার কারণে ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি।

কারণ সন্দেহভাজন কারো শরীর তল্লাশি করতে গিয়ে যদি বিস্ফোরণ ঘটে, তাহলে পুলিশ সদস্যরা হতাহত হতে পারেন। এ কারণে বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে সন্দেহভাজনদের গান-পয়েন্টে রেখে তল্লাশি করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কাউন্টার টেররিজমের ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার এবং বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের প্রধান ছানোয়ার হোসেন বলেন, চট্টগ্রামে এক জঙ্গি চার-পাঁচ কেজি ওজনের একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মারা যায়। প্রযুক্তি এক হলেও এ ধরনের বোমা আগে দেখা যায়নি। এগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী। মনে হয়েছে, দক্ষ কোনো কারিগর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, অস্ত্র-বিস্ফোরকের উৎস বন্ধ করতে না পারলে জঙ্গিদের আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। ফলে বড় হামলার শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। এ কারণে জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্ত্র-বিস্ফোরকের নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয়ারও তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, সম্প্র্রতি আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য বা পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও আত্মঘাতী জঙ্গি আছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, জঙ্গিদের এই আত্মঘাতী হয়ে ওঠা এটা প্রমাণ করে যে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের পক্ষে পুরনো সদস্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। নতুন জঙ্গি সংগ্রহ করতেও পারছে না। তাই আত্মহননের মাধ্যমে কর্মকাণ্ড দেখাতে চাইছে।

একই বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, ধর্মের অপপ্রচার করে নাশকতা চালানো হচ্ছে। এসব ঘটনায় আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এসব মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছেন।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!