• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জনস্রোতে ঢুকছে রোহিঙ্গারা, ঝুঁকিতে জননিরাপত্তা


বিশেষ প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৭, ০৩:১৮ পিএম
জনস্রোতে ঢুকছে রোহিঙ্গারা, ঝুঁকিতে জননিরাপত্তা

ঢাকা: মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা করছে। তাদের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি নির্যাতনের মুখে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছে। তাদের সবাইকে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালীর বনভূমিতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

চেহারা ও ভাষায় মিল থাকায় তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব রোহিঙ্গা যাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সরকার। বায়েমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনের আওতায় আনতে কাজ শুরু করেছে সরকার। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ফেনী, সুনামগঞ্জ, যশোর, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ। পরে তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরে।

ধারণা করা হচ্ছে, রোহিঙ্গা নিবন্ধন কার্যক্রম জোরালো না হলে এবং তাদের আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রিত এলাকায় রাখা না গেলে তারা ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে, মিশে যেতে পারে দেশের মূল জনস্রোতের সঙ্গে। আর এতে করে ভয়াবহ নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সামান্য কিছু টাকার লোভে রোহিঙ্গাদের এভাবে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে কক্সবাজারের স্থানীয় দালাল চক্র।

চক্রটি রোহিঙ্গাদের নিকটাত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন কর্মব্যস্ত শহরে শ্রমজীবী মানুষের ভিড়ে মিশিয়ে দেওয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গারা এভাবে কক্সবাজারের বাইরে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ রোহিঙ্গাদের নিয়ে অসাধু চক্র নাশকতা ও তাদের বিভিন্ন দেশে পাচারেরও চেষ্টা করতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা নারীদের দিয়ে অবৈধ ব্যবসারও আশঙ্কা আছে।

যদিও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বেশ সতর্ক পুলিশ প্রশাসন। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যাতে আশ্রয় শিবির ছেড়ে বাইরে যেতে পারে, সেজন্য কড়া নজরদারির পাশাপাশি চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের কালুরঘাট ও শাহ আমানত সেতুতে চেকপোস্টের মাধ্যমে নজরদারি শুরু হয়েছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকাসহ অন্য বিভাগীয় শহরগুলোর প্রবেশমুখেও একাধিক তল্লাশি চৌকি বসানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গারা যাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে না পারে, সে ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে সতর্ক করা হয়েছে। এদিকে রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ এবং তা নিয়ে বিভিন্ন দেশে গিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এবার কোনো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দিলে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বিবেচনায় রয়েছে।

সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবাধে চলাফেরা করছে। এখন নতুন করে যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারাও মিশে যাচ্ছে সারা দেশে।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের ভাষা, চেহারা, পোশাক, চলাফেরা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিল থাকায় সাধারণ জনস্রোতে মিশতে তাদের মোটেও সমস্যা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে পুরনো শরণার্থীরাও তাদের সহায়তা করছে। ইতোমধ্যে রাজধানীতে রোহিঙ্গাদের দেখতে পাওয়া গেছে। রাজধানীতে রোহিঙ্গা দেখেছেন এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শী হলেন সিনিয়র সাংবাদিক কুদ্দুস আফ্রাদ।

তিনি জানিয়েছেন, গত সোমবার বাসাবো টেম্পোস্ট্যান্ড থেকে গুলিস্তানে যাচ্ছিলেন। সেই টেম্পোতে তিনজন রোহিঙ্গাও ছিল। টেম্পোর সহকারী তাদের কাছে ভাড়া চাচ্ছিলেন। কিন্তু তারা অনেকক্ষণ ধরে কোনো কথাই বলছিল না। একপর্যায়ে তিনি নিজে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তাদের ভাড়া দেওয়ার অনুরোধ করেন। পরে ওই তিন রোহিঙ্গার একজন শুধু বললেন, ‘অ্যাঁর কাছে টিঁয়া নাই’।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, নিজ দেশের সেনাবাহিনীর অত্যাচার আর বর্বরতার মুখে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারি চলছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেউ যাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, এজন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা রয়েছে।

একই বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, বর্তমানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখার জন্য বাংলাদেশে যে ক্যাম্প তৈরি হয়েছে সেখানে যদি পর্যাপ্ত ত্রাণসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করা যায় তাহলে তারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে না। কিন্তু সরকার যদি সেই ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণে ব্যর্থ হয়, তাহলে তারা বেঁচে থাকার তাগিদে ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্র কাজ খোঁজার চেষ্টা করবে।

বর্তমানে শরণার্থীরা যে এলাকায় অবস্থান করছে, সেখানে কাজের চেয়ে তাদের সংখ্যা বেশি। তিনি আরো বলেন, দেশে কৃষিশ্রমিকের অভাব আছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাজে লাগিয়ে সেই অভাব পূরণ করা সম্ভব। তবে আশঙ্কার বিষয় এই যে, তারা অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। সে বিষয়ে সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে।

আটক রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে ফেরত : এদিকে গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ৩১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। পরে দুপুর আড়াইটার দিকে তাদের উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়। এ নিয়ে গত কয়েক দিনে শুধু লোহাগাড়া থেকেই ৬৩ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। অন্যদিকে সুনামগঞ্জে পরিচয় গোপন রেখে নাগরিক সনদ নিতে গিয়ে ধরা পড়ল ১২ রোহিঙ্গা। গত বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলার বড়দল ইউনিয়নের গুটিলা গ্রামের তোতা মিয়ার বাড়ি থেকে তাদের আটক করা হয়। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নাগরিক সনদ ও তিনজনকে জন্মসনদ দেওয়া হয়েছিল।

এর আগে গত বুধবার মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রাম থেকে তিন রোহিঙ্গা পরিবারের ২০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ১১ শিশু, ছয় নারী ও তিনজন পুরুষ রয়েছেন। তাদের সবাইকে টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

একই দিন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করার সময় চার রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবি। আর বুধবার ভোরে বেনাপোল সীমান্ত থেকে দুই পরিবারের আট রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবি। তাছাড়া হাটহাজারী উপজেলার ফটিকা ইউনিয়ন থেকে ১৯, সীতাকু- উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ঘোড়ামারা থেকে ১৮, পতেঙ্গা থেকে ১৪, চান্দগাঁও থেকে ১১ ও বাকলিয়া থেকে পাঁচজনকে টেকনাফে ফেরত পাঠানো হয়েছে।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!