• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মদিনের ‘উপহার’ মৃত্যুদণ্ডের আদেশ


আদালত প্রতিবেদক অক্টোবর ১০, ২০১৮, ০৮:১৫ পিএম
জন্মদিনের ‘উপহার’ মৃত্যুদণ্ডের আদেশ

ঢাকা : বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের মন্ত্রিসভায় যে কয়েকজন খুব দ্রুত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। তারেক রহমানের সাথে ঘনিষ্ঠতাই ছিল তার ক্ষমতাবান হয়ে উঠার মূল ভিত্তি। ক্ষমতার দাপটে অল্পসময়েই সারাদেশ তুমুল আলোচিত হয়ে ওঠা লুৎফুজ্জামান বাবর প্রায় ১১ বছর কারাগারে আছেন। ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে, জন্মদিনে তাকে শুনতে হলো মৃত্যুদণ্ডের আদেশ।

এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করা লুৎফুজ্জামান বাবরের জন্ম ১৯৫৮ সালের ১০ অক্টোবর নেত্রকোনা জেলায়। সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত তথ্য সম্বলিত ‘প্রামান্য সংসদ’ সংকলনে এটি উল্লেখ আছে। সেই হিসেবে আজ (বুধবার) ছিল সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর ৬০ তম জন্মদিন। ক্ষমতায় থাকাকালীন অপকর্ম তার জীবনের এমনই ট্র্যাজিডি নিয়ে এলো যে, জন্মদিনের উপহার হিসেবে পেলেন মৃত্যুদণ্ডের আদেশ।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মতিঝিল থানায় দায়ের করা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবনের আদেশ দেয়া হয়েছে।

বিএনপির প্রভাভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন লুৎফুজ্জামান বাবর। তার সময়ের অনেক কিছুই ভুলে যাওয়ার কথা নয়। চলনে-বলনেও তিনি ছিলেন আলাদা। র‌্যাবের প্রতিষ্ঠার পেছনে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়েই র‌্যাব ‘ক্রসফায়ারের’ নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু করে। ১৯৯১ সালে নেত্রকোনা-৪ (মদন-মোহনগঞ্জ-খালিয়াজুরী) থেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও পরাজিত হন। ২০০১ সালে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে লুৎফুজ্জামান বাবর দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন।

ওই বছর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে বাবর প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন। মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আলতাফ হোসেন চৌধুরী। কিন্তু ক্ষমতা প্রয়োগের মানদণ্ডে বাবর ছাপিয়ে যান মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীকে। মন্ত্রিসভায় হাওয়া ভবনের প্রতিনিধি হিসেব তিনি এতোটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন যে, একটা সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

কিন্তু সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আর কোন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী নিয়োগ দেয়নি সরকার, ফলে বাবর অনেকটা একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিপতি হয়ে যান। কিন্তু কথায় আছে ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। এটা প্রমানিত হলো, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বাবর মৃত্যুদণ্ড পাওয়ায়। এর আগে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

নেত্রকোনায় বাবরের গ্রামের বাড়ি হলেও তিনি বেড়ে উঠেছিলেন ঢাকার মগবাজারে। এইএসসিতে ভর্তি হলেও পাাশ করতে পারেননি। তখন থেকেই তার বিরুদ্ধে নানাবিধ অপকর্মে জড়ানোর অভিযোগ ওঠে। এরশাদ সরকারের আমলের শেষভাগে ঢাকা বিমানবন্দর কেন্দ্রিক চোরাচালান ব্যবসায় জড়িত হয়ে তিনি বিত্তশালী হয়ে ওঠেন বলে বাবরের ঘণিষ্ঠজনরাই জানিয়েছেন।

১৯৯৯ সালে রাজধানীর বনানীতে বিএনপি চেয়ারপারসেনর রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ‘হাওয়া ভবন’ নামে একটি বাড়ি ভাড়া নেয়া হয়। ওই ভবন থেকেই ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং এর পরবর্তী বিভিন্ন দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। পরে সেটি খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান নিজেই ব্যবহার করতে থাকেন।

 ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এই হাওয়া ভবন হয়ে ওঠে ক্ষমতার কেন্দ্র। শুরুতে হাওয়া ভবনে যে বিভিন্ন প্রোগ্রাম হতো সেগুলোর ইভেন্ট আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হতো লুৎফুজ্জামান বাবরকে। সেসব দায়িত্ব তিনি ঠিক মতো পালন করতেন। এভাবে তারেক রহমানের সাথে তার বিশেষ সখ্য গড়ে উঠে। একসময় বাবর হয়ে ওঠেন তৎকালীন মন্ত্রিসভায় হাওয়া ভবন তথা তারেক রহমানের প্রতিনিধি।

লুৎফুজ্জামান বাবর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দা থাকাকালীন বাংলাদেশে বেশ কিছু বোমা হামলার ঘটনা ঘটে এবং জঙ্গি কার্যক্রমের উত্থান ঘটে। জেএমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান এবং সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের উত্থান হয়েছিল ওই সময়েই। প্রতিমন্ত্রী হলেও এককভাবে তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের দায়িত্ব পালনকালেই।আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর সিলেটে গ্রেনেড হামলা, দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা এবং সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল।

২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হবার বাবর গ্রেফতার হন। এরপর আর তিনি মুক্ত হতে পারেননি।। একের পর এক মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন তিনি। গত প্রায় ১১ বছর ধরে লুৎফুজ্জামান বাবর কারাগারেই আছেন।

মৃত্যুদণ্ডের রায় শুনে আদালতে যা বলেছেন বাবর : বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে বুধবার (১০ অক্টোবর)। রাজধানীর নাজিমুদ্দিন রোডে পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আজ বুধবার এ রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের ফাঁসি ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

রায় ঘোষণার পর লুৎফুজ্জামান বাবর আদালতে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ এর বিচার করবেন। আমাকে বার বার রিমান্ডে নিয়ে তারেক রহমানকে এ ঘটনায় জড়িত বলে স্বীকারোক্তি নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মুফতি হান্নানের কথিত স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে এ রায় দেয়া হয়েছে।’

এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর মামলার যুক্তিতর্ক ও শুনানি শেষে বিচারক রায় ঘোষণার জন্য এ দিন ধার্য করেন। ওই দিন রায়ের তারিখ ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষ সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি এবং আসামিদের পক্ষ থেকে বেকসুর খালাস দাবি করে।

মামলাটি প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষে ৫১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জনকে আদালতে উত্থাপন করা হয়। ২১ আগস্ট গেনেড হামলা মামলার মোট আসামি ছিলেন ৫২ জন। বিচারকালে আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলার মামলায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান ও শরিফ শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় তাদের এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বর্তমানে মামলা দু’টিতে মোট আসামির সংখ্যা ৪৯।

এ মামলায় জামিন বাতিল হওয়া আটজনসহ ৩১ আসামি কারাগারে আছেন, বাকি ১৮ জন পলাতক। এ মামলায় রায়ের দিন নির্ধারণ করার আগে জামিনে থাকা আট আসামির জামিন বাতিল করে কারাগারে আটক রাখার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২২ জন নিহত হন। প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েক শ’ নেতাকর্মী।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই এ সংক্রান্ত হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার বিচার শুরু হয়। ৬১ জনের সাক্ষ্য নেয়ার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এর অধিকতর তদন্ত করে। এরপর বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে নতুন করে আসামি করে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এরপর দুই অভিযোগপত্রের মোট ৫২ আসামির মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। অন্য মামলায় তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৪৯।

মৃত্যুদণ্ডের রায়ে বাবরের এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের মৃত্যুদণ্ডের আদেশে তার নিজ এলাকা নেত্রকোনার মদন উপজেলার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কদ্দুছ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ রায়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে রায় বন্ধ করে দিয়েছিল সে রায় আবারও পুনরায় শেখ হাসিনা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জনগণ এ রায়ে খুশি হয়েছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার খান এখলাছ বলেন, এ রায়ে বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। তবে আমি আরও খুশি হতাম তারেক রহমানের মৃত্যুদণ্ড হলে।

জেলা পরিষদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এ কে এম সাইফুল ইসলাম হান্নান বলেন, এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে আমরা চাই এ রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক।

বিএনপি নেতাদের মধ্যে দলের উপজেলা সভাপতি এন আলম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এ রায়ে সুবিচার পাননি।

জেলা যুবদলের সদস্য ও মদন সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বদরুজ্জামান শেখ মানিক বলেন, গণভবনের নির্দেশিত এ অবৈধ রায় জনগণ মানে না।

এদিকে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায়ের পর লুৎফুজ্জামান বাবরের এলাকায় কোনো বিক্ষোভ মিছিল বা সমাবেশ হয়নি।

মদন থানার ওসি মো. রমিজুল হক জানান, উপজেলার সবকটি পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বাবরের বাড়িতেও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি আছে। অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা সংঘটিত হয়নি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!