• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
ভাবতেই সময় গেল তিন বছর

জলে তেল অপসারণ উপযোগী জাহাজ কেনার উদ্যোগ


সোনালী বিশেষ জানুয়ারি ২০, ২০১৮, ১২:২২ পিএম
জলে তেল অপসারণ উপযোগী জাহাজ কেনার উদ্যোগ

ঢাকা : সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ট্যাঙ্কারডুবি ঘটে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। ওই ঘটনায় সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে প্রাণী ও পরিবেশের জন্য চরম ঝুঁকি সৃষ্টি করে। তখন সরকারের প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা উঠেছিল। তবে ওই ঘটনার তিন বছর পর জলে নিঃসৃত তেল অপসারণ উপযোগী জাহাজ (স্পিলড অয়েল রিমুভ ভেসেল) কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

সংসদীয় একটি কমিটিকে এ তথ্য জানিয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান দাবি করেছেন, এ ধরনের জাহাজের অভাবেই তখন সুন্দরবনে তেল ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যায়নি। এর আগে অন্য এক সংসদীয় কমিটিও দাবি করেছিল, এ ধরনের দুর্ঘটনার পর তেল অপসারণের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বা মোংলাবন্দর কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত ছিল না।

সম্প্রতি সংসদ ভবনে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সুন্দরবনে ট্যাঙ্কারডুবির ঘটনাটি ফের আলোচনায় আসে। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পরপর দুটি বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে কমিটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। অন্য একটি সূত্র বলছে, ট্যাঙ্কারডুবির দুর্ঘটনার দিন ১৩ ঘণ্টা পর খবরটি জেনেছিলেন মন্ত্রী শাজাহান। এই ঘটনায় আলোচনায় থাকা মোংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলের খনন কাজও সম্পন্ন হয়ে গেছে বলে সম্প্রতি কমিটি জানতে পেরেছে।

সংসদীয় নথির মতে, গত ২৩ নভেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির ৪৮তম বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সদস্য এম আবদুল লতিফ বলেন, দেশে বিদ্যমান ক্লিনার ভেসেল শ্যালা নদীতে ভাসমান তেল অপসরণ করতে সক্ষম হয়নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী বলেন, সুন্দরবনে তেলবাহী জাহাজের নিঃসরিত তেল নদীতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিদ্যমান ক্লিনার দিয়ে তা অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। নদীর ভাসমান তেল অপসারণ সাধারণ ক্লিনার ভেসেল দিয়ে সম্ভব নয়। এর জন্য ভাসমান তেল অপসারণ উপযোগী ভেসেল প্রয়োজন। তাই স্পিলড অয়েল অপসারণযোগ্য নৌযান সংগ্রহের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিষ্কার কাজে যুক্ত হওয়া নৌযানটি যাতে পরিবেশবান্ধব হয়, বৈঠকে সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে খেয়াল রাখতে বলেছেন কমিটির সভাপতি ও সদস্যরা।

কমিটির ২১ ডিসেম্বরের ৪৯তম বৈঠকে বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে। এদিন মোংলাবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর ফারুক হাসান কমিটিকে জানান, তাদের বন্দরের জন্য নিঃসৃত তেল অপসারণকারী জলযান সংগ্রহের প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে। এ জলযানটি আসলে কোনো তেলবাহী ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনায় পড়ে নদীতে তেল নিঃসরণ করলে তা অপসারণ করা সম্ভব হবে। বন্দরে সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের কথাও জানান চেয়ারম্যান।

সরকারের তেল অপসারণকারী জলযান কেনার উদ্যোগের বিষয়ে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘এর সঙ্গে সমস্যা সমাধানের কোনো সম্পর্ক নাই। কেনাকাটার ব্যাপারে এমনিতেই সরকারের মধ্যে নানা রকম গোষ্ঠী খুব আগ্রহী। এখন তারা তৎপর হয়েছে জাহাজ কেনা বাণিজ্যটা করার জন্য। এখানে কমিশন একটু ভালো পাওয়া যাবে বা অন্য কিছু। তাই জাহাজটা কিনতে হবে। এটা হলো কেনাকাটার বাণিজ্য, আর কিছু না। বেচাকেনার কিছু লোক বসে আছে। ওই কেনাবেচার সমঝোতা করতে এখন একটা যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘ওখানে (শ্যালা নদী) যে তেল পড়েছিল তা অপসারণে সরকারের কোনো উদ্যোগ ছিল না। কমপক্ষে ১০ বছর আগে এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) বহু কোটি টাকার একটি প্রজেক্টে অনেক সুপারিশ ছিল। সুন্দরবনে এ ধরনের দুর্ঘটনা হলে কী কী করতে হবে-তাও সেখানে উল্লেক ছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কিছুই করা হয়নি। ওই প্রজেক্টের নামে তখন অনেক কনসালট্যান্ট ও আমলা সরকারি পয়সায় বিদেশ সফর করেছেন। তবে কোনো কাজ হয়নি।’

এর তিন বছর আগেই সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী এবং এ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. হাছান মাহমুদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ভাসমান তেল অপসারণের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে একটি বিশেষ জাহাজ ছিল। কিন্তু সুন্দরবনের দুর্ঘটনায় এ জাহাজটিকে ঘটনাস্থলে আনা হয়নি। পরে কমিটি জানতে পেরেছে জাহাজটিকে ঘটনাস্থলে আনতে হলে সমুদ্রপথে আনতে হবে। কিন্তু এ জাহাজটিরও সমুদ্রপথে চলাচলের ছাড়পত্র নেই।

২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বরে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যাওয়া ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ নামের ট্যাঙ্কারটি দেখে এসে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ডুবে যাওয়া জাহাজের তেলে সুন্দরবনের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। এরই ধারাবাহিকতায় আলোচ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং মোংলা-রামপাল সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য তালুকদার আবদুল খালেকও দাবি করেন, এ ঘটনায় পরিবেশের যতটা ক্ষতি হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, ততটা হবে না। তবে বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির একাধিক বৈঠকের আলোচনা ও সুপারিশ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে ট্যাঙ্কারডুবির ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রীসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যদের উদ্বেগ কখনোই কম ছিল না।
 
এদিকে মোংলা-ঘাষিয়াখালী নৌপথে পলি জমার কারণে জাহাজগুলো ৯০ কিলোমিটার ঘুরে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচল করে। দুই দিক থেকেই পানি প্রবেশ করার কারণে মোংলা-ঘাষিয়াখালী নৌপথের মাঝামাঝি স্থানে স্রোত কমে যাওয়ায় পলি জমে। এই নৌপথ খননের পর রক্ষণাবেক্ষণ দরকার ছিল।

কিন্তু গত ৪৩ বছরেও তা করা হয়নি। এতে ২০০৩ সালেই এটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। সংসদীয় কমিটি এরই মধ্যে জানতে পেরেছে এ নৌরুটের খনন কাজ শুরু হয়েছে। কমিটির নভেম্বরের বৈঠকে বিআইডব্লিউটিএর বর্তমান চেয়ারম্যান কমোডর মোজাম্মেল হক জানান, মোংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলের খনন কাজও সম্পন্ন হয়েছে।

এর আগে ২০১১ সালে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে তেলবাহী ট্যাঙ্কারসহ অন্যান্য নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার সুপারিশ করে নবম সংসদের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। তারাও তখন সুন্দরবনের বিকল্প হিসেবে মোংলা-ঘাষিয়াখালী-মোরেলগঞ্জ চ্যানেল পুনঃখনন করে এ পথে নৌ-চলাচলের নির্দেশনা দেয়।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এ সুপারিশের আলোকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় তখন জানিয়েছিল, ২০১৪ সালের মধ্যে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করা হবে। মূলত এরই জেরে দশম সংসদের একই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এত বড় দুর্ঘটনার পরও যদি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের টনক না নড়ে তাহলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।

এই কমিটির বৈঠকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় দাবি করেছিল, ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কারের ৩ লাখ ৫৭ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েলের মধ্যে স্থানীয় পদ্ধতিতে মাত্র ৬০ হাজার লিটার সংগ্রহ করা হয়েছে। সুন্দরবনের ৩০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল পর্যন্ত তেল ছড়িয়ে পড়েছে। নদী থেকে এই তেল অপসারণে নৌ-মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা মুখ্য হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তারা সে ভূমিকা রাখেনি। বৈঠকের পরে কমিটির সভাপতি ড. হাছান মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, এ ধরনের দুর্ঘটনার পর তেল অপসারণের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বা মোংলাবন্দর কর্তৃপক্ষের পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। অবশেষে ঘটনার তিন বছর পর সেই প্রস্তুতি সম্পন্ন হচ্ছে।

কমিটির গত ডিসেম্বরের বৈঠকে মোংলাবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণাধীন ১ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াটের তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহে পশুর চ্যানেলের ১৩ কিলোমিটার এলাকায় ৩৮.৮১ লাখ ঘনমিটার মাটি ড্রেজিং করা হবে। এই কাজ শেষ হলে বাংলদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড নির্বিঘ্নে বছরে ৪৫ লাখ টন কয়লা আনতে পারবে।

এই প্রতিবেদককে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, সুন্দরবনে ড্রেজিংয়ের একটা ইনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (পরিবেশগত প্রভাব যাচাই) হওয়ার কথা। ড্রেজিংয়ের কারণে বনের আরো ক্ষতি হবে। কারণ ইতোমধ্যে ড্রেজিংয়ের কারণে দাকোপসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। শুধু সুন্দরবন নয়, সর্বত্রই ড্রেজিং সমস্যা সৃষ্টি করে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!