• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা


যুবায়ের আহমাদ জুন ২৬, ২০১৬, ০১:৫৬ পিএম
জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা

জাকাত তো অনুদান নয়। জাকাত ফরজ হতেই ধনীরা যেন গরিবদের কাছে ঋণী হয়ে গেল। ঋণের ক্ষেত্রে তার পাওনাদারকে খুঁজে বের করে অথবা তার বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসা তার কর্তব্য; তা দিয়ে না আসা পর্যন্ত সে যেমন দায়মুক্ত হয় না, তেমনি জাকাত দাতাও এর হকদারের কাছে ঋণী। জাকাতের হকদারকে খুঁজে বের করে তাদের হাতে তা পৌঁছে না দেয়া পর্যন্ত সে দায়মুক্ত নয়। মাথাব্যথাটা তো জাকাত দাতার।
আমাদের দেশে জাকাত দাতার পরিমাণ কম নয়। কিন্তু এর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা নেই। জাকাত আনতে গিয়ে দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ৩ শতাধিক লোক মারা গেছেন জাকাত আনতে গিয়ে। গেল বছর ময়মনসিংহে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল জাকাত আনতে গিয়ে। স্বাধীনতার পর থেকে ৩০০ পরিবারকে কি দারিদ্র্যমুক্ত করা গেছে এই অপ্রাতিষ্ঠানিক জাকাত ব্যবস্থা থেকে? ‘জাকাতের শাড়ি’ বণ্টন করার জন্য বেছে নেয়া হয় সরু জায়গা। ঠেলাঠেলিতে যত আহত-নিহত তত নাম! শাড়ি দিয়ে গরিবের উপকার করার সদিচ্ছা থাকলে ঢাকঢোল পেটানোর কী প্রয়োজন? একটি এলাকার গরিবদের তালিকা করে তাদের ঘরে পৌঁছে দেয়া দুরূহ নয় নিশ্চয়ই। ‘জাকাতের শাড়ি’ কতটা উপকারে আসে? দেখা যায়, একেকজন গ্রহীতা ১০টির মতো কাপড় পাচ্ছেন। জাকাতদাতা হয়তো অর্ডার দিয়ে ২০০ টাকায় নিম্নমানের কাপড় কিনছেন আর গ্রহীতা তা ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি করছেন। এর চেয়ে ২০০ টাকা দিয়ে দিলেই তো ভালো ছিল। না, তাতে তো ‘দানবীর’ হিসেবে প্রচারটা কম হয়ে যায়। শ’খানেক কাপড় দিয়েই যদি ‘দানবীর’ হিসেবে পরিচিত হওয়া যায় তাতে ক্ষতি কী! এ তো জাকাত নয়। তা হলো ধনাঢ্যদের আত্মপ্রচারের মাধ্যম। জাকাতের কাপড় না দিয়ে জাকাতের গাড়ি, রিকশা, জাকাতের সেলাই মেশিন,  জাকাতের ঠেলাগাড়ি হলে কি সমস্যা? ব্যক্তিগতভাবে জাকাত দিয়ে সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের উন্নয়নে বিশেষ কিছু করা যায় না। তাই জাকাতের মূল লক্ষ্যকে সফল করতে প্রয়োজন সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা।
মালয়েশিয়ায় জাকাত আদায় ও বিতরণের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান হলো ‘লেমবাগা জাকাত সেলাঙ্গর’। সংস্থাটি ‘সেলাঙ্গর ইসলামিক রিলিজিয়াস কাউন্সিল’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৪ সালে। ২০০৬ সালে এর নাম হয় ‘লেমবাগা জাকাত সেলাঙ্গর’ (এলজেডএস)। ২০০২ সাল থেকে ই-জাকাত ব্যবস্থাপনা (ইন্টারনেটে জাকাত প্রদান ও গ্রহণ) চালু করে সংস্থাটি। এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ২ বিলিয়ন রিঙ্গিটেরও বেশি জাকাতের অর্থ বিতরণ করেছে। তালিকাভুক্ত ২৬ হাজার ৬৯টি নিঃস্ব পরিবারকে কেন্দ্র করেই তাদের এ কাজ। মজার বিষয় হলো, এর ৪১ শতাংশই তারা ব্যয় করেছে শিক্ষা খাতে। জাকাত দাতার পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ। অথচ দেশটির জনসংখ্যাই ৩ কোটির মতো। প্রতি বছর জাকাত দাতার পরিমাণ বাড়ছে গড়ে প্রায় ২১ শতাংশ। জাকাত দাতার হার যেভাবে বাড়ছে তাতেই বোঝা যায়, কতজন লোক প্রতি বছর দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাচ্ছে। প্রতি বছর জাকাত আদায় বাড়ছে গড়ে ১৫ শতাংশ। জাকাত বেড়ে যাওয়াই তো প্রমাণ করে যে, দেশের সম্পদও বাড়ছে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে কি জাকাতে দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব? সুদভিত্তিক গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামের সুফিয়া বেগমকে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে। চরম দুঃখের বিষয় হলো, গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার বিজয় করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই সুফিয়ার দারিদ্র্যকে জয় করতে পারেনি। ভিক্ষাই ছিল তার জীবনের শেষ পরিণতি। তার একমাত্র শনের ঘরটিতেও টিন উঠাতে পারেনি হতভাগ্য সুফিয়া। অপরপক্ষে বাংলাদেশে জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় ঈর্শনীয় সাফল্য দেখিয়েছে সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গির নামে খুচরা জাকাত না দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানমূলক খাতে ব্যবহার করে অল্প সময়ের ব্যবধানেই ৫ হাজার পরিবারকে স্বাবলম্বিতার মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত করেছে। (দৈনিক মানবজমিন : ১১-০৬-২০১৬)। জাকাতের টাকার কোনো সুদ তো দূরের কথা আসল টাকাও ফেরত দিতে হয় না। নেই কোনো কিস্তির চিন্তা। কর্মসংস্থানের পর মনিটরিং করলে সহজেই দারিদ্র্যকে জয় করা যায়। সিজেডএমের এ কৃতিত্ব জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় রোল মডেল হতে পারে।    
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। (জনকণ্ঠ : ১৯-০৫-২০১৬)। ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ১৫ লাখ ৮ হাজার ৮৭৬। (দৈনিক ইত্তেফাক : ১৭-১১-২০১৪)। এ ১৬ লাখ (প্রায়) পরিবারের দারিদ্র্যের বিপরীতে আদায়যোগ্য জাকাতের পরিমাণ কত? ইসলামী ব্যাংক কনসালটেটিভ ফোরামের (আইবিসিএফ) এর তথ্য মতে, শুধু শুধু ব্যাংক ডিপোজিট থেকেই বছরে ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জাকাত আদায় করা সম্ভব। (দৈনিক কালের কণ্ঠ : ১২-০৭-২০১৫)। এ তো শুধু ব্যাংকে জমাকৃত টাকা থেকে আদায়যোগ্য জাকাতের পরিমাণ। ব্যাংকের বাইরে মানুষের যে সম্পদ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তা থেকে যদি জাকাত আদায় করা হয় তাহলে এর পরিমাণ কী দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। ‘সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট’ (সিজেডএম) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে জাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকা। এর থেকে আড়াই শতাংশ হারে জাকাত আদায় করলে ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব, যা বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৪০ শতাংশ। (আলোকিত বাংলাদেশ : ২৮-০৫-২০১৬)। একবার কি চিন্তা করে দেখেছেন, এ দিয়ে কী করা সম্ভব! এ ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করলে ২৫ লাখ পরিবারকে দেয়া যেত এক লাখ টাকা করে। এবার যে ২৫ লাখ পরিবারকে দেয়া হলো ১ লাখ টাকা করে তাদের কি আগামী বছর জাকাত দেয়ার প্রয়োজন হবে? না। আগামী বছর অন্য ২৫ লাখ পরিবারকে দেয়া যাবে ১ লাখ করে। পরবর্তী বছর জাকাতের পরিমাণও বাড়বে। প্রথম বছর যে ২৫ লাখ জনকে দেয়া হলো তৃতীয় বছরে এসে তাদের সিংহভাগই অল্প হলেও জাকাত দিতে পারবে। তাদের জাকাতও যোগ হবে জাকাত তহবিলে। গ্রহীতা কমছে।  কিন্তু এ ২৫ হাজার কোটি টাকা, যাদের সম্পদ থেকে আদায় করা হবে তাদের কি কোনো ক্ষতি হবে? কিছুতেই না। কারণ তা আদায় করা হবে জীবনজীবিকার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থেকে। যাদের ভোগের পেয়ালা উপচে পড়ছে তাদের উপচেপড়া অতিরিক্ত সম্পদটুকু গরিবের শূন্য হাঁড়িতে ঢেলে দিলে ধনীর তো কোনো সমস্যাই হতো না, কিন্তু শূন্য হাঁড়িগুলো প্রাণ ফিরে পাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে আদায়যোগ্য ২৫ হাজার কোটি টাকা প্রথম বছর যদি ভূমিহীন ১৫ লাখ পরিবারকে বণ্টন করা হয় তবুও তো প্রতি পরিবারকে দেয়া যাবে দেড় লাখ টাকারও বেশি করে।
জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় গণমানুষের আস্থাসম্পন্ন বিশেষ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জাকাত সংগ্রহ করে তার সুপরিকল্পিত বণ্টন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। যাদের থাকবে জাকাত সংগ্রহের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মসূচি মূল্যায়ন ও মনিটরিং করা হবে কঠোরভাবে। জাকাতভিত্তিক দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচির সঙ্গে সরকারি কর্মসূচির সফল সংযোগ স্থাপন করে এক বছরে কতজনকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেয়া গেল তার তথ্য জাতির সামনে তুলে ধরলে মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক জাকাতে আগ্রহী হবে। জানগণকে জাকাতে উৎসাহিত করতে সর্বোচ্চ করদাতাদের যেভাবে পুরস্কৃত করা হয় সেভাবে সর্বোচ্চ জাকাতদাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। সে ব্যক্তির মোট আয়করের পরিমাণ থেকে পরিশোধিত জাকাতের অঙ্কের অর্ধেক যদি কমিয়ে দেয়া হয় তাহলেও বাড়বে জাকাতদাতার পরিমাণ। আমাদের বিশ্বাস, দারিদ্র্য বিমোচনে বিদেশি ঋণের সুদের বোঝা না টেনে দেশের এ অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সুপরিকল্পিত জাকাত ব্যবস্থাপনায় ৫ বছরেরও কম সময়ে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। 

লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ
বোর্ড বাজার, গাজীপুর

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এএম

Wordbridge School
Link copied!