• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
কয়েদখানা থেকে স্মৃতির ইতিহাস

জাতির জনকের ‘সেকেন্ড হোমে’


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ১৫, ২০১৭, ১২:৫৪ এএম
জাতির জনকের ‘সেকেন্ড হোমে’

ঢাকা : সেমিপাকা বড় একটি ঘর। ওপরে টিন। পরিপাটি এই ঘরটি লম্বায় ৩০ ফুট আর প্রস্থে ১৮ ফিটের কম নয়। ঘরের ভেতরটাও বেশ গোছালো। ঘরের ভেতরে চকি, টেবিল, খাবার থালাসহ নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র থরে থরে সাজানো। পশ্চিম দিকে রান্নাঘর। পাশেই গোসলখানা। ঘরটির চারপাশে গাছপালায় ভরপুর। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দফায় দফায় গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি ছিলেন। এই ঘরটিতেই বন্দি থাকতেন বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এই ঘরটির সামনে এখন স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তি। সামনে বড় কয়েকটি গাছ। আছে ফুলের বাগানও। বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের স্মৃতি বিজরিত এই ঘরটিই এখন ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারা স্মৃতি জাদুঘর’। তার স্মৃতি রক্ষার্থে সদ্য সাবেক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ‘দেওয়ানি সেল’কে বঙ্গবন্ধু কারা স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে।

সেলটির বাইরে পর্যাপ্ত জায়গা থাকলেও সেলের ভেতরে তেমন জায়গা নেই। জাদুঘরটিতে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহার্য জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। এসব জিনিসের গায়ে লেবেল দিয়ে ব্যবহারের সময় উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বন্দিজীবনের ইতিহাস জানতে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি গ্রন্থাগার। জাদুঘর প্রাঙ্গণে ৬টি স্তম্ভে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ছয় দফা তুলে ধরা হয়েছে।

সেলের সামনে জাদুঘর প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লাগানো একটি কামিনী ফুলগাছ ও একটি সফেদা গাছ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাছ দুটি এখন অনেক বড় হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ গাছ দুটিকে সযতনে রেখেছে। পাখি রাখার একটি খাঁচাও আছে বঙ্গবন্ধুর সেই সেলে। যে কক্ষে বঙ্গবন্ধু গোসল করতেন সেটিও সংরক্ষণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত চেয়ার-টেবিল, খাট, পাতিলসহ নানা জিনিস কাচ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। সেখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত চায়ের কাপ, কেটলি, রান্নার হাঁড়ি-পাতিলও।

বঙ্গবন্ধু কারা স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্যে আছে নামাজের চৌকি, জায়নামাজ, অজু করার ঘটি, ময়না পাখির খাঁচা, বিছানাপত্র, খাবারের টিনের থালা, হাঁড়ি-পাতিল, কাপ-পিরিচ, পড়াশোনার ছোট্ট কাঠের টেবিল, কাঠের চেয়ার, কিছু পুরনো কাপড়-চোপড় এবং চুলা। পুরনো ঢাকার এই জেলখানাজুড়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার সংগ্রামী জীবনের বহু স্মৃতিচিহ্ন। বঙ্গবন্ধুর যে দীর্ঘ কারাভোগের ইতিহাস, তা অন্য কোনো রাজবন্দির ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি। তিনি স্কুলজীবন থেকে শুরু করে ৫৫ বছর পর্যন্ত অন্তত ২৩ দফায় ৮ বছর ২ দিন কারাগারে থেকেছেন। তাই তার স্মৃতি রক্ষায় ২০১০ সালের ৮ মে এই দেওয়ানি সেলটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে তা উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

একনজরে বঙ্গবন্ধুর কারা জীবনের দিনলিপি: ১৯৩৮ সালে ৭ দিন, ১৯৪৮- মার্চ ১১ থেকে মার্চ ১৫- ৫ দিন, ১৯৪৮-১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২১ জানুয়ারি ১৯৪৯- ৫ মাস, ১৯৪৯- ১৯ এপ্রিল থেকে জুলাই ৪ মাস, ১৯৪৯ সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর ৪ মাস, ১৯৫০-১৯৫২ জানুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রæয়ারি ১৯৫২- ২ বছর ২ মাস, ১৯৫৪- মে থেকে ২৩ ডিসেম্বর- ৮ মাস, ১৯৫৮-১৯৬১ সালের ১১ অক্টোবর থেকে ৭ ডিসেম্বর ১৯৬১ - ৩ বছর ৩ মাস, ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ১৮ জুন ৬ মাস, ১৯৬৪- মার্চ ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ ডিসেম্বরে ১ বছর ১০ মাস, ১৯৬৬ সালে ৮ বার গ্রেফতারে ৩ মাস, ১৯৬৬-১৯৬৯ সালে মে ৮ থেকে ২২ ফেব্রæয়ারি ১৯৬৯ সালে ২ বছর ১০ মাস, ১৯৭১- মার্চ ২৫ থেকে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ১১ মাস তিনি কারাবাস করেন। সবমিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে প্রায় তিন হাজার দিন কারাবন্দি ছিলেন। যা এই উপমহাদেশের ইতিহাসে আর কোনো রাজনীতিকের জীবনে ঘটেনি!

আছে বঙ্গবন্ধুর রোপিত সেই কামিনী গাছটিও: যার নেতৃত্বে বিশ্ব মানচিত্রে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের পর বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, সেই অমর নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছেন কারাগারে। নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়ে গেছে তার অসংখ্য স্মৃতি। তার এই দীর্ঘ কারা জীবনকে অনেকে ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবেও অভিহিত করেন।

কারাগার সূত্র জানিয়েছে, ৬০-এর দশকে বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে তার ‘দেওয়ানি সেলের’ সামনে একটি কামিনী গাছের চারা লাগিয়েছিলেন। তিনি হয়ত সাধারণ খেয়ালেই কিংবা কয়েদি হিসেবেই গাছটি লাগিয়েছিলেন। কিন্তু, নিতান্তই চারা থেকে সেই গাছ এখন মহীরুহ। চারপাশে ডালপালা ছড়িয়ে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করছে সগৌরবে। অর্ধ শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে থাকা এই গাছটি যেন বঙ্গবন্ধুর জীবন্ত স্মৃতি।

এদিকে গত বছরের ২৯ জুলাই পর্যন্ত পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দৃশ্যটা এমন ছিল না। এ দিনের পর থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারকে কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে স্থানান্তর করা হয়। আর পুরনো কারাগারকে বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করার পরিকল্পনা করছে সরকার। বিনোদনের জন্য পার্ক, জাদুঘর, উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চসহ থাকবে নানা আয়োজন।

এছাড়া সম্প্রতি টাকা বিনিময়ে জেলের স্বাদ নিতে ‘ফিল দ্য প্রিজন’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। তবে গত বছরের ২ নভেম্বর সীমিত সময়ের জন্য সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। মাত্র ১০০ টাকায় পুরনো সেই কারাগার দেখেছিলেন লাখো মানুষ। এর আগে কখনও কারাগারের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ ছিল না সাধারণের জন্য।

দেশের সবচেয়ে পুরনো এ জেলখানার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি, দুঃখগাথা। অপরাধীরা তো বটেই, বিভিন্ন সময়ের শাসক, বিদ্রোহী প্রজা কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিবিদ এমনকি এই তো কয়েক বছর হলো বিচার শুরু হওয়া স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদেরও অন্যতম সাক্ষী দেশের প্রথম এই জেলখানা। ১৭৮৮ সালে মাত্র একটি অপরাধ ওয়ার্ডের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের আমলে এই জেলখানার যাত্রা শুরু হয়।

২২৮ বছরের ইতিহাসে অনেক ঘটনা প্রবাহ আবর্তিত হয়েছে এখানে। ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বহু অপরাধীর। শুধু স্বাধীন বাংলায় ৪৩৩ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে দিয়ে এই জেলখানায় ফাঁসির সূচনা হয়। যার শেষ হয় যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির মধ্য দিয়ে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার দেশের প্রাচীনতম এবং সর্ববৃহৎ কারাগার। মুঘল সুবেদার ইব্রাহিম খান ঢাকার চকবাজারে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। পরবর্তী সময়ে দুর্গটি ঢাকার নায়েবে নাজিমের আবাসস্থল ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে ১৭৮৮ সালে ৩৮ একর জমির ওপর গড়ে তোলা দুর্গের ভেতরে একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তথা কারা বিভাগের যাত্রা শুরু হয়।

পরবর্তীকালে ১৮১৮ সালে রাজবন্দিদের আটক রাখতে বেঙ্গল বিধি জারি করা হয়। ১৮৩৬ সালে জেলা ও তৎকালীন মহকুমা সদর ঢাকা, রাজশাহী, যশোর ও কুমিল্লায় কারাগার নির্মাণ করা হয়। ১৯২৯ সালে ঢাকা ও রাজশাহী কারাগারকে কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।

সোনালীনিউজ/জেডআরসি/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!