• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই যুগ পূর্তি : কী পেয়েছি, কী পাইনি


ড. ফজলুল হক সৈকত অক্টোবর ১৫, ২০১৬, ০৪:১৩ পিএম
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই যুগ পূর্তি : কী পেয়েছি, কী পাইনি

২১ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২ যুগ পূর্ণ হচ্ছে। এই উপলক্ষে, গাজীপুরে কেন্দ্রীয় ক্যাম্পাসসহ দেশের অন্যান্য ৭টি প্রশাসনিক বিভাগে ১টি করে মনোনীত কলেজে বিশেষভাবে এই দিবসটি উদযাপনের জন্য ‘একাডেমিক কার্যক্রমের উন্নয়ন ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভা/ সেমিনার আয়োজন করা যেতে পারে।

সকল অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানও অনুরূপ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারে। শিক্ষক-কর্মকর্তা-শিক্ষার্থী-অভিভাবক, সাংবাদিক-সমাজকর্মী-উন্নয়নকর্মী, লেখক-গবেষক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন স্তরের লোকের উপস্থিতিতে মত-বিনিময় সভা পরিচালিত হতে পারে। দিবসটি পালন করার জন্য সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে নোটিশ কিংবা প্রজ্ঞাপন জারি করা যেতে পারে।

সকল অধিভুক্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষদেরকে ই-মেইলের মাধ্যমেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ যুগ পূর্তি অনুষ্ঠান এবং আলোচনা সভা/ সেমিনার আয়োজনের জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে। এমনটি করা গেলে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও একাডেমিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রচলিত কার্যাবলী, সমস্যা এবং সম্ভাবনা সম্বন্ধে পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা পাওয়া যাবে।

প্রান্তিক পর্যায়ে সংশ্লিষ্টদের প্রাসঙ্গিক মতামত ও চিন্তা গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির অগ্রযাত্রার ধারা আরো গতিশীল হবে। এছাড়া, বাৎসরিক কার্যক্রমের বিবরণী ও অগ্রগতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ক্যাম্পাসে বা জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রেস ব্রিফিং-এর আয়োজন করা যেতে পারে।

১৯৯২ সালে প্রধানত সারাদেশে কলেজশিক্ষার মান-উন্নয়ন এবং শিক্ষক-প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে যাত্রা শুরু কওে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ২ যুগ পূর্তির দ্বারপ্রান্তে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ২৪ বছরে কাজের পরিধি বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ। দেশের উচ্চশিক্ষার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পরিচালিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রায় ২৩০০ কলেজ ও ইনস্টিটিউটে। তবে, গত কয়েক বছরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল সেশনজট।

৪ বছরের কোর্স শেষ করতে সময় লেগে যেত ৭ থেকে ৮ বছর। বর্তমানে সে-সংকট থেকে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় মুক্ত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে সেশনজট মুক্ত করার জন্য দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানি ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ-এর উদ্যোগে বর্তমান প্রশাসন গৃহীত ক্র্যাশ-প্রোগ্রাম সাফল্যের সাথে এগিয়ে চলেছে। ২০১৮ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ সেশনজট মুক্ত হবে। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ‘শিক্ষার মান-উন্নয়ন’। ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান-উন্নয়নে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় এবং সরকারের অর্থায়নে প্রায় ১০০০ (এক হাজার) কোটি টাকার প্রকল্পও চালু হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চুক্তি-স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে। এগিয়ে চলেছে প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ। মাননীয় ভিসির নেতৃত্বে প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর (একাডেমিক) প্রফেসর ড. হাফিজ মো. হাসান বাবু এই প্রকল্পে তাঁর বিশেষজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের ধারায় নতুনমাত্রা যোগ করতে পারবেন বলে আশা করা যায়। আর সঙ্গে আছেন প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর (প্রশাসন) প্রফেসর ড. আসলাম ভূঁইয়া, ট্রেজারার অধ্যাপক নোমান রশীদ এবং রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মোল্লা মাহফুজ আল হোসেনের মতো দক্ষ শিক্ষা-প্রশাসকবৃন্দ।

গত সাড়ে তিন বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়েছে বহুগুণ। প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছে কলেজ র‌্যাংকিং। জাতীয়-বিভাগীয়-জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সেরা কলেজকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। আলাদাভাবে সরকারি-বেসরকারি এবং মহিলা কলেজগুলোকে র‌্যাংকিং করা হয়েছে। শিক্ষার মান পরিবর্তনে এই র‌্যাংকিং বিরাট অবদান রাখবে। অন-ক্যম্পাস মাস্টার্স প্রোগ্রাম এমএএস (মাস্টার্স ইন অ্যাডভান্স স্টাডিজ), ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম চালু এবং এমফিল-পিএইচডি প্রোগ্রাম সম্প্রসারণে বর্তমান প্রশাসনের যে সফল উদ্যোগ, তা সব মহলে প্রশংসা পেয়েছে।

আঞ্চলিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাকে বিকেন্দ্রীকরণের সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে অধ্যক্ষদের সাথে মত-বিনিময় করেছেন ভাইস-চ্যান্সেলর। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে ১০০০ কলেজের অধ্যক্ষকে নিয়ে শুরু হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশেষ কর্মশালা। শিক্ষার মান-উন্নয়নে একাডেমিক মনিটরিং হচ্ছে দেশব্যাপী। সহশিক্ষা কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার জন্য আয়োজিত হয়েছে আন্তঃকলেজ সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। টিএমআইএস (টিচার্স ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) প্রতিষ্ঠা করে পরীক্ষক প্যানেল তৈরি করা হয়েছে।

সারাদেশের প্রায় ৭০ হাজার কলেজ শিক্ষকের পরীক্ষা-সংক্রান্ত সম্মানী অন লাইনে সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রদানের জন্য চালু হয়েছে সেনালী ব্যাংকের সাথে যৌথ সেবা প্রকল্প ‘সোনালী সেবা’। শুরু হয়েছে পাঠপুস্তক ও রেফারেন্স গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশনার কাজ। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টসহ ৬টি আধুনিক ও সময়-উপযোগী নতুন বিষয় চালু হয়েছে অধিভুক্ত কলেজে। ইনকোর্স পদ্ধতির মাধ্যমে কলেজশিক্ষাকে বিশ্বমানে পৌঁছানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

আগামী জানুয়ারি ২০১৭ তে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রথমবারের মতো সমাবর্তন। সমাবর্তনে অংশগ্রহণের জন্য গ্র্যাজুয়েটদের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। আয়োজক কমিটির প্রস্তুতি চলছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণে আধুনিকতার প্রয়োগ এবং ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কলেজশিক্ষকগণ কেন্দ্রীয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত লেকচার শুনতে পাচ্ছেন। প্রশিক্ষণার্থীদের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ডটমেটরি আধুনিকায়ন ও সংস্কারের কাজ চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থায় আনা হয়েছে আমূল পরিবর্তন।

ভাড়ায় চালিত গাড়ির স্থলে পরিবহন পুলে যুক্ত হয়েছে নিজস্ব গাড়ি। আঞ্চলিক কেন্দ্রের জন্যও পরিবহন সুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। পরিবহন সুবিধা পুরোপুরি নিশ্চিত করা গেলে আঞ্চলিক কেন্দ্রের মাধ্যমে কলেজগুলোর মনিটরিং আরো সহজ হয়ে উঠবে। ওয়ানস্টপ সেন্টার তৈরি করে শিক্ষার্থীদেরকে দেওয়া হচ্ছে গতিশীল সেবা। অনলাইনে ভর্তিসহ সকল প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারছে কলেজ ও শিক্ষার্থী। চালু হয়েছে ই-ফাইলিং। মূল কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো কার্যক্রমে গত সাড়ে তিন বছরে যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, যে গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর ও আনন্দদায়ক।

তবে, উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে, বিরাজমান সমস্যা দূর করে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে হলে এবং চলমান কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করার জন্য কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনায় নিতে হবে বলে আমি মনে করি। প্রথমত, বর্তমানে অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রাসঙ্গিক সকল তথ্য প্রদানের পাশাপাশি নতুন করে যে সকল প্রতিষ্ঠানে অধিভুক্তি এবং বিশেষ করে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে পাঠদানের অনুমতি প্রদান করা হবে, সে সব প্রতিষ্ঠানের অধিভুক্তি ও পাঠদান অনুমতির বিস্তারিত প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি এবং পিএসসিকে অবহিত করা যেতে পারে।

কলেজে বিষয়ভিত্তিক আসনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিও ওইসব প্রতিষ্ঠানকে জানাতে হবে। কেননা, শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রমোশন ও বদলি, বেতন-ভাতা প্রদান প্রভৃতি বিষয়ে ওই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। প্রয়োজনে, সরকারের পরিকল্পনা এবং বাৎসরিক বাজেট বিবেচনায় নিয়ে অধিভুক্তি, পাঠদানের অনুমতি ও আসনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

যে সব কলেজে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানো হয়, সেখানে প্রত্যেকটি বিষয়ে ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করার ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। ৩ থেকে ১২ জন শিক্ষক দিয়ে শত শত শিক্ষার্থীর শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কলেজে শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষককে অন্তত ১০টি কলেজের গভর্নিং বডিতে ভাইস-চ্যান্সেলর মনোনীত বিদ্যোৎসাহী সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেয়া যেতে পারে। এতে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবার পাশাপাশি একাডেমিক ও প্রশাসনিক মনিটরিং-এর ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপিত হবে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশের সকল অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানে এইভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব, মনিটরিং ও দ্বিপাক্ষিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব কোনো সিলেবাস ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ না থাকায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে দেখা যায়, অনেকক্ষেত্রে দায়সারা গোছের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। দেশের এই ব্যতিক্রমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কারিকুলাম উন্নয়ন ও মূল্যায়ন কেন্দ্র’ রয়েছে। কিন্তু কোনো বিশেষজ্ঞ না থাকায় সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না কেন্দ্রটি। বিশেষ করে কেন্দ্রটির ডীন এবং পরিচালক পদে স্কিল্ড লোক নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রায়শই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশ্নপত্রে ভুল পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে বানান ও ভাষা-বিষয়ক ভুল সাধারণের চোখে পড়ে। প্রশ্নপত্রে ভুল রেখে শিক্ষার মান-উন্নয়ন কী করে সম্ভব? তাই, ভাষাবিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা গেলে কাজের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শতাধিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ অধিভুক্ত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ে মাত্র ১ জন শিক্ষক রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ‘শিক্ষা’ ডিসিপ্লিনকে আলাদাভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে গৃহীত শিক্ষার মান-উন্নয়ন বিষয়ক সকল কর্মকাণ্ডকে গতিশীল ও বাস্তবমুখি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘একাডেমিক কমিটি, শিক্ষা’ নামে আলাদা ডিসিপ্লিন সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অভিজ্ঞ ও স্কিল্ড শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষণ-পদ্ধতি ও শিক্ষার সামাজিক গুরুত্ব বিষয়ে নিয়মিত সেমিনার এবং জার্নাল প্রকাশও হতে পরে এই কমিটির অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অনেকাংশে গাইড-নোট নির্ভর হয়ে পড়েছে। বিষয় বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত বিষয়ভিত্তিক টেক্সট ও রেফারেন্স বই অধিভুক্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা গেলে গাইড-নোট নির্ভরতা কমে আসবে। অথবা প্রস্তুতকৃত তালিকা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহকে বই ক্রয়ের জন্য নির্দেশনাও দেওয়া যেতে পারে। মানসম্মত গ্রন্থের তালিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ‘পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন’ সংক্রান্ত যে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, তা আরো সম্প্রসারণ ও গতিশীল করতে হবে। টেক্সট ও রেফারেন্স প্রকাশনার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করলে অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান উপকৃত হবে। এই খাতে আর্থিক বিনিয়োগ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও লাভজনক হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে একাডেমিক মনিটরিং বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ২০০৭ সালে একবার ৪১টি কলেজে মনিটরিং হওয়ার দীর্ঘদিন পর আপনার উদ্যোগে বর্তমান প্রশাসন আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে পুনরায় মনিটরিং চালু করেছে। এই কার্যক্রম যেন স্থবির না হয়ে পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যায়ক্রমে সারাবছর সব প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি মনিটরিং-এর আওতায় আনতে হবে। মনিটরিং-এর পর নিয়মিত ফলোআপও করতে হবে। অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে একাডেমিক মনিটরিং চলছে, তার মূল্যায়ন পর্য়ালোচনা শেষে সার্বিক দিক-নির্দেশনা এবং করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।

বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানে বিশেষ কোনো দুর্বলতা থাকলে পরবর্তী সেশনে কোর্স বা অধিভুক্তি নবায়নের পূর্বে মনিটরিং-এর ফলোআপ রিপোর্ট বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। এতে শিক্ষার মান ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে। প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষার বাস্তব পরিস্থিতি ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় শিক্ষা-প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন। জেলা পর্যায়ে শিক্ষা-প্রশাসক সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের সাথে মত-বিনিময় ও সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করা যেতে পারে। এই বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথসভাও করা যেতে পারে।

শিক্ষক প্রশিক্ষণের মান-উন্নয়ন এবং ইউনিফর্মিটির জন্য প্রথমত বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষকদের তালিকা প্রণয়ন করা যেতে পারে। অতঃপর তাদেরকে নিয়ে নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন এবং অনুসরণের জন্য নির্দেশনামালাও তৈরি করা যেতে পারে। প্রত্যেক প্রশিক্ষককে লেকচারের বিষয়ে অন্তত ১০ (দশ) পৃষ্ঠা লিখিত শিক্ষা-উপাদান বা মেটেরিয়ালস জমা প্রদানের নির্দেশনা হতে পারে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

একেকটি বিষয়ের প্রত্যেক ব্যাচের সকল লিখিত মেটেরিয়ালস একত্র করে প্রকাশ করা যেতে পারে বিশেষ প্রকাশনা। এইসব প্রকাশনা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে। অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের যে সকল শিক্ষক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন, তারা প্রশিক্ষণ-পরবর্তী সময়ে পাঠদানে ও ক্লাসরুম ব্যবস্থাপনায় নিজেদের কতোটা উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছেন, এই সম্বন্ধে নিয়মিতভাবে মনিটরিং হতে পারে। এতে একধরনের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হবে। তা না হলে ট্রেনিং থেকে যাবে দায়সারা গোছের কোনো মিলমেলা মাত্র।

নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অধিভুক্ত সকল প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কল্যাণ/ অধিকার পরিষদ ও শিক্ষার্থী কল্যাণ/ অধিকার পরিষদ গঠন করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এই ধরনের সংগঠনের কার্যক্রম শিক্ষার মান-উন্নয়নে সরাসরি সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারবে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তা প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অগ্রগতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে।

গবেষণা ও লেখালেখি না করলে শিক্ষকের মান-উন্নয়ন সম্ভব নয়। শুধু বছর গুণে প্রমোশন প্রদান করা একটি সনাতনী পদ্ধতি। সময়ের সাথে সাথে আমাদের চিন্তা এবং কর্মসূচিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পাবলিকেশন ছাড়া প্রমোশন পান না। যেহেতু অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানকারী কলেজের শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সিলেবাস পাঠদানের সাথে সম্পৃক্ত, তাই তাদের গবেষণা ও প্রকাশনার বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়ে সরাসরি কার্যকরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তা না হলে, কেবল প্রশিক্ষণ প্রদান করে শিক্ষার মান-উন্নয়ন সম্ভব হবে না।

প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কাজ করতে গিয়ে বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। দেখা দেবে নতুন নতুন সমস্যা। সমাধানের জন্যও তাই গ্রহণ করতে হবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং পরিকল্পনা। তাৎক্ষণিক ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি নিশ্চিত করা কঠিন হবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একদিন হয়তো বিশ্বের শিক্ষা ভুবনে হয়ে উঠবে একটি পরিচিত নাম ও অনুকরণীয় প্রতিষ্ঠান।

লেখক : শিক্ষা-গবেষক ও প্রাবন্ধিক। সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি; প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ। ই-মেইল : [email protected] 

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!