• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া কতদূর?


জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিশেষ প্রতিনিধি মে ১১, ২০১৬, ০৪:০১ পিএম
জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া কতদূর?

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় বেশ কয়েক বছর ধরে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবি উঠে দেশের সর্বমহল থেকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৩ সালে ১ আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় উচ্চ আদালত। তবে আইনি জটিলতা দেখিয়ে জামায়াতকে এখনও নিষিদ্ধ দল হিসেবে ঘোষণা করতে পারছে না সরকার। জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়াটি ঝুলিয়ে রেখে সরকার তাদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে বলেও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে।

জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়ার পর জনমনে কিছুটা সন্দেহ তৈরি হয়। সরকারের সঙ্গে জামায়াতের ‘আঁতাত’ হয়েছে বলেও গুঞ্জন উঠে চারদিকে। আর জনমনের এই সন্দেহ দূর করতেই জামায়াতে ইসলামীকে যুদ্ধাপরাধে জড়িত দল হিসেবে বিচারের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।

এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির (ঘাদানিক) নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, সরকারের টম অ্যান্ড জেরি কার্টুন দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সরকার একবার জামায়াতকে ধরছে আর ছাড়ছে। আর বিচার হচ্ছে-হবে বলে যাচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে বলতে বলতে ক্লান্ত, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ।

আর জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে মামলা আপিলে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ আদালতে মামলাটি ঝুলে থাকার কারণ জামায়াতের নিবন্ধন সংক্রান্ত, দলটির চার্টার অর্থাৎ দলটির গঠনতন্ত্র এ দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মামলা। কিন্তু সরকার যেহেতু আইন সংশোধনীর কথা তুলেছেন, আমরা এখনও অপেক্ষা করছি।

এদিকে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হওয়া সময়ের ব্যাপার বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে এক ব্রিফিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতাদের বিচার হয়েছে এবং হচ্ছে। ওই রায়েই যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের কথা বলা হয়েছে। এখন পর্যায়ক্রমে এই প্রক্রিয়া শুরু হবে।

গত মঙ্গলবার দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে একে একে জামায়াতের শীর্ষ চার নেতার অধ্যায় শেষ হলো। বলা যায়, এতে জামায়াতের ‘রাজনৈতিক গুরুর’ একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে যার নাম আসে সবার আগে, সেই গোলাম আযম যুদ্ধাপরাধের সাজা ভোগের মধ্যেই জেলহাজতেই মারা গেলেন। আর একে একে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির দন্ড কার্যকর করা হয়। 

উচ্চ আদালত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে রায় দেয়ার পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী দশম জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের বৈধতা হারায় দলটি। যদিও আওয়ামী লীগ ছাড়া বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রুল জারির পর (হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক রিট পিটিশন নং ৬৩০/২০০৯) ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুইবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুইবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয় জামায়াত। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত হলে, কোনো নামেই সংগঠিত হতে পারবে না দলটি। 

সংগঠন হিসেবে জামায়াত দোষী সাব্যস্ত হয়ে নিষিদ্ধ হলে অন্য কোনো নামে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এই বিধান রেখে খুব শিগগিরই আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে সংশোধনী আসছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ওই নামে বা অন্য কোনো নামে কার্যক্রম চালাতে পারবে না। গত ডিসেম্বরে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, চলতি মাসেই খসড়া আইনটি মন্ত্রিসভায় উঠবে। এর পর জানুয়ারিতে মন্ত্রী জানালেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই আইনটির খসড়া মন্ত্রিসভায় উঠবে। মন্ত্রীর কথার কোনো যোগসূত্র এখনও মেলেনি। অজানা কারণে সেই আইনের খসড়া এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেয়া হয়েছে। আইনটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপনের পর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে বিল আকারে সংসদে তোলা হবে। চূড়ান্ত খসড়ায় এই আইনের কার্যকারিতার কথা বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে। চতুর্থ দফায় আইনটির বিদ্যমান ১০টি ধারায় সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি ধারায় ব্যক্তি শব্দের পাশাপাশি সংগঠন শব্দটি রয়েছে। এতে যুদ্ধাপরাধে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের নিষিদ্ধ করা যাবে। নিষিদ্ধ ব্যক্তি বা সংগঠন নামে-বেনামে কোনো কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এতে বলা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ওই নামে বা অন্য কোনও নামে কার্যক্রম চালাতে পারবে না।

এর আগে ট্রাইব্যুনালস আইন তিন দফা সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ হয়েছে ২০১৩ সালে। ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। তখন কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মুখে ট্রাইব্যুনালস আইনের তৃতীয় সংশোধনী সংসদে পাস করা হয়। এতে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষের আপিলের সমান সুযোগ রাখা হয়। এই সংশোধনীতে সংগঠনের বিচারের সুযোগ তৈরি করা হলেও দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তি কী হবে, তা নির্ধারণ করা হয়নি।

খসড়া অনুমোদন হলে বিদ্যমান ট্রাইব্যুনালস আইনের ২০ (২) ধারায় যোগ হবে, ট্রাইব্যুনাল দোষী সাব্যস্ত সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবেন এবং এই নামে বা অন্য কোনো নামে সংগঠনটির ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। পাশাপাশি মামলার বিষয়বস্তু সাপেক্ষে সংগঠনটির সদস্যদেরও ট্রাইব্যুনাল সাজা দিতে পারবেন। বর্তমানে এ ধারায় শুধু ব্যক্তির সাজার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া আইনের ৪ ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, কোনো সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটি অথবা কেন্দ্রীয়, আঞ্চলিক বা স্থানীয় কমিটির সদস্য যদি অপরাধ করেন, তাহলে ওই অপরাধের জন্য সদস্যের পাশাপাশি সংগঠনও দায়ী হবে।

এদিকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। এরপর প্রসিকিউশনে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি দল আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র তৈরির কাজ করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রসিকিউটর বলেন, আমাদের কোনও কারণ না জানিয়ে ২০১৪ সালের ১৯ মে কেবল যারা মামলাটি নিয়ে কাজ করছিলাম, তাদের সব নথি ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর হায়দার আলী। পরবর্তীতে কারণ হিসেবে আইনমন্ত্রীকে বলতে শুনলাম, ‘বিদ্যমান ট্রাইব্যুনাল আইনে জামায়াতের বিচার সম্ভব নয়৷ এর জন্য আইন সংশোধন করতে হবে৷’ গত ২০১৪ সালের ২৯ মে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের বিদ্যমান আইনে সংগঠনের বিচার ও শাস্তির বিধান নেই৷ তাই এই আইনে জামায়াতের বিচার সম্ভব নয়।’

প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ এ মামলার সক্রিয় প্রসিকিউটর ছিলেন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র তৈরির কাজ মাঝখানে বন্ধ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা আসলেই সঠিকটা বলতে পারবো না। আমাদেরকে ১৯ মে সকল নথি জমা দিয়ে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়, আমরা ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটরকে সেগুলো বুঝিয়ে দেই। দুই বছর ধরে আইন সংশোধনের অপেক্ষা করছি। সেটা হলেই কাজ শুরু হবে। তবে নাম প্রকাশ না করে আরেক প্রসিকিউটর বলেন, এটি খুবই সংবেদনশীল মামলা।

আমার মনে হয় মামলাটিকে শক্তিশালী করতে তদন্তে আরেকটু মনোযোগী হতে হবে। তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান জানান, জামায়াতে ইসলামীকে একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তারা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে যে সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, তার সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণের জন্য বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও দলটির অর্গানোগ্রামসহ অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আমা

Wordbridge School
Link copied!