জাল সনদ নিয়ে আতঙ্কে ১০ লাখ পেশাজীবী!

ঢাকা: আদালতের রায়ে বন্ধ থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ নিয়ে আতঙ্কে আছেন ১০ লাখ পেশাজীবী। এ ছাড়া আতঙ্কে রয়েছেন বন্ধের তালিকায় থাকা তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক লাখ সনদধারী।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে এ ধরনের জাল সনদ দিয়ে অনেকেই চাকরি করছেন বলে অভিযোগ আছে। তাদেরকে চিহ্নিত করে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে মাঠে নেমেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। অন্যদিকে চাকরি রক্ষা করতে তারাও জোর তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছেন।

টিআইবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ৫০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকায় সনদপত্র বিক্রি করছে। গত বছর ঢাকার মালিবাগের আমেরিকা-বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপুল পরিমাণ জাল সনদপত্র উদ্ধার করেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

আদালতের রায়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া দারুল ইহসান আর ঢাকার ফার্মগেট ও বনানীতে বাড়িভাড়া নিয়ে সনদ ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া আমেরিকা-বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ লাখ ভুয়া সনদধারী আছেন বিভিন্ন পেশায়। তাদের মধ্যে দারুল ইহসান থেকে অন্তত ১০ লাখ সনদ নেয়া বলে সরকারি বিভিন্ন প্রতিবেদন ঘেঁটে জানা গেছে।

ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া এবং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (সিসিএন) কয়েক লাখ সনদধারী কর্মরত আছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। জানা গেছে, আমেরিকা-বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিগগিরই বন্ধ করে দেয়া হতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কড়া নজরদারিতে রাখছে সাউথ এশিয়া ও সিসিএনকে।

যেকোনো সময় প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে বলে মন্ত্রণালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে। তিনটি প্রতিষ্ঠানের ‘সনদ’ ক্রেতারা তাই আতঙ্কে ভুগছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেয়া জাল সনদ নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিদ্যালয়, আদালত ও মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে অনেকে চাকরি করছেন। তাদের বেশির ভাগই বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

দারুল ইহসান ও আমেরিকা- বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার এলএলবি সনদধারী সারা দেশে ওকালতি করছেন। তবে বার কাউন্সিলের দাবি-২০১৩ সাল থেকে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের এলএলবি সনদধারীদের বার কাউন্সিলের পরীক্ষা দিতে দেয়া হচ্ছে না।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের একটি প্রকল্পের পাঁচজন কর্মকর্তা জাল সনদধারী বলে অভিযোগ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দুই কর্মকর্তার তদন্তে ধরা পড়লে তারা ‘বৈধ’ করার জন্য ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন।

ইউজিসির তদন্তে ঘুষ চাওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হলে প্রতিষ্ঠানটির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নাছিমা রহমান ও জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক আতোয়ার রহমান গত বছরের শেষ দিকে চাকরিচ্যুত হন।

গত বছরের ১৩ এপ্রিল দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেয়ার চূড়ান্ত রায় দেন উচ্চ আদালত। এ রায়ের আদেশ পুলিশ সদর দপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পৌঁছলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একই বছরের ২৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে।

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এক হিসাবমতে, দারুল ইহসানের সনদ নিয়ে শিক্ষকতা করছেন বা বিএড সনদ দিয়ে গ্রেড পরিবর্তন হয়েছে-এমন শিক্ষকদের সংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি। তবে ২০১১ সালের পর দারুল ইহসানের কোনো সনদ নেয়া হচ্ছে না।

ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের অন্তত ৫০ জন শিক্ষকের সনদ দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টাকার বিনিময়ে কেনা বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুল সালামের বিএড সনদ সম্প্রতি ভুয়া প্রমাণিত হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তদন্তে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৯ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির জাল সনদধারীদের বিষয়ে তদন্তে মাউশিকে নির্দেশ দেয়।

মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) এলিয়াস হোসেন জানান, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। কী ব্যবস্থা নেবে তা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার।’

অভিযুক্ত শিক্ষক আবদুল সালাম দাবি করেন, তিনি দারুল ইহসানের সাভারের গণকবাড়ি মূল ক্যাম্পাস থেকে সনদ নিয়েছেন। কিন্তু তদন্ত করা হয়েছে ধানমন্ডি ক্যাম্পাসের ঠিকানায়। বিষয়টির পুনঃতদন্তের আবেদন করেছেন তিনি। কার্যক্রম বন্ধ থাকা দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের গণকবাড়ি শাখার সাবেক কয়েক কর্মকর্তা জানান, ‘তাদের দেয়া সনদের ব্যাপারে প্রায়ই তদন্তে আসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান’।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেনা জাল সনদে চাকরি করছেন এমন ৫৫৬ জন শিক্ষককে গত বছর চিহ্নিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ওই ৫৫৬ জন শিক্ষক বেতন-ভাতা হিসেবে সরকারি কোষাগার থেকে নেন প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত নেয়ার সুপারিশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান ডিআইএ। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিহ্নিতরা কর্মরত। এ ছাড়া ডিআইএর আরেক প্রতিবেদন মতে, ৬০ হাজার শিক্ষকের সনদ জাল।

বন্ধ হয়ে যাওয়া দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় মোট কত লাখ সনদ বিক্রি করেছে, এর সঠিক হিসেব নেই। প্রতিষ্ঠানটি থেকে মোট ৩০ লাখের বেশি সনদ নিয়ে রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানে অনেকে চাকরি করছেন।

দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কত সালের মধ্যে নেয়া সনদ বৈধ, তা এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির দুই রকমের বক্তব্য আছে। ইউজিসির চেয়ারম্যান সংবাদমাধ্যমকে গত বছরের শেষের দিকে বলেন, ‘দারুল ইহসান থেকে ২০০৬ সালের পরে নেয়া সব সনদ অবৈধ’। তবে ২০১১ সাল পর্যন্ত নেয়া সনদ সঠিক বলে পরে জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিষয়টির মীমাংসা না হওয়ায় জটিলতায় আছেন সনদধারীরা।

প্রকৃত ভুক্তভোগীদের দাবি-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জালিয়াতির দায় শিক্ষার্থীরা বহন করতে পারেন না। চাকরি হারানোর আতঙ্কের পাশাপাশি তারা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন শিক্ষার্থীরা।’

মাউশি মনে করে-তড়িঘড়ি করে নয়, সঠিক তদন্ত করে অভিযুক্ত সনদধারীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক চন্দ্র শেখর হালদার জানান, ‘সম্প্রতি বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানের সনদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পালন করবেন তারা।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, আমেরিকা-বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে আদতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষসহ পূর্ণকালীন কোনো শিক্ষক নেই। সাউথ এশিয়া ও সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ। নিবন্ধন দলিলে বিশ্ববিদ্যালগুলো ঠিক ঠিকানা পর্যন্ত উল্লেখ করেনি।

সাউথ এশিয়ার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এইচএসসি পাস। সিসিএনে পূর্ণকালীন শিক্ষক কতজন এ তথ্য ইউজিসির কাছেও নেই। সিসিএনের সংরক্ষিত তহবিলে তিন কোটি টাকা ব্যাংকে এফডিআর রাখার কথা থাকলেও বিভিন্ন সময় তা তুলে নেন উদ্যোক্তারা।

গত বছরের নভেম্বরে ইউজিসি গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ১৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ না থাকায় সেগুলোর সনদ অবৈধ। বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামের তালিকা দেয় ইউজিসি।

প্রভাবশালী চক্রের চাপে ঘোষণা থেকে সরে এসে আরেক বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটি বলে, ‘ওই ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত সনদ বৈধ হবে এবং শিক্ষার্থীরা সাময়িক সনদ দিয়ে কাজ চালাতে পারবেন।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এমএইচএম