• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাসদকে গিলে খেলেন তাহের


জাফর ওয়াজেদ অক্টোবর ৩১, ২০১৭, ০৭:৪৭ পিএম
জাসদকে গিলে খেলেন তাহের

ঢাকা: গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী রাজনীতির ধারায় জাসদ প্রতিষ্ঠার পর আশা করা গিয়েছিল যে, সংসদীয় ব্যবস্থায় তারা এগিয়ে যাবে। তারা ১৯৭৩-এর সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েওছিল। কিন্তু দলটিকে কব্জা করে নেন কর্নেল তাহের। গণতান্ত্রিক রাজনীতিব্যবস্থায় এগিয়ে যেতে চাওয়া দলের নেতা কর্মীরা ভ্রান্তির বেড়াজালে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তারা বুঝতে পারেননি, তাহের কী চান? আসলে কী চেয়েছিলেন কর্নেল তাহের? কী ছিল তার কথিত বিপ্লব? 

চেয়েছিলেন চীনা গণবাহিনীর ধাঁচে সামরিক জান্তার অধীনে জনগণকে শাসন করবেন। তাই দেখা যায়, ১৯৭৪ সালেই জাসদের কথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শ দিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামে সশস্ত্র একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তাদের ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ব্রিটিশ অথবা পাকিস্তানি সেনাদের মতো হবে না, হবে গণবাহিনী। কোনো অফিসার থাকবে না। সেনাবাহিনীর মধ্যে তাহের ও তার গণবাহিনী ‘শ্রেণিসংগ্রাম ও বিপ্লবের’ মন্ত্র ছড়িয়ে দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর মধ্যে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তারা চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। গণবাহিনীর এ প্রচারপত্রে সিপাহিদের তাদের ঊর্ধ্বতনদের প্রতিও ক্ষুব্ধ করে তোলে। 

এমন একটি প্রচারপত্র বা লিফলেটে বলা হয়েছিল, ‘অফিসাররা ক্ষমতা ও পদের লোভে অভ্যুত্থান ঘটাচ্ছে। আর প্রাণ দিচ্ছে সাধারণ সিপাহিরা। নিগৃহীত; অধিকারবঞ্চিত সিপাহিরা আর কামানের খোরাক হবে না। সিপাহি-জনতার ভাগ্য এক। তাই সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমেই ক্ষমতা দখল করতে হবে। সুতরাং বিপ্লবের জন্য, শ্রেণিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হোন। ’ 

১৯৭৫ সালের নভেম্বরের দিনগুলো ছিল টালমাটাল। একদিকে জেলহত্যা, অন্যদিকে ক্যু-পাল্টা ক্যু, সেনা কর্মকর্তা হত্যাসহ জাসদের গণবাহিনীর হঠকারী তত্পরতা মিলে এক নারকীয় অস্থিরতায় পূর্ণ ছিল দেশ। নানা সুবিধাবাদী মহল বিশেষত স্বাধীনতাবিরোধীরা মাঠে নামার সুযোগটি কার্যকর করে। ২ নভেম্বর রাতে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। তিনি ক্ষমতা নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। এমনকি ক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করার বিষয়েও দোটানায় ছিলেন। তার অভ্যুত্থান ঘটানো বা ক্ষমতা দখল বিষয়ে রেডিও-টিভিতে কোনো ভাষণ বা ঘোষণা দেননি। 

খালেদ মোশাররফ যখন ক্ষমতা নিয়ে মোশতাকের সঙ্গে দরকষাকষি করছিলেন, তখন মোশতাক ও তার সহযোগী আত্মস্বীকৃত খুনিরা জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেন। এর পরপরই ক্ষমতাচ্যুত হন মোশতাক। আর খুনিদের দেশ ছেড়ে পালানোর পথ করে দেয়া হয়। সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলার সুবাদে এবং ভারত-ভীতি কাজে লাগান জাসদের নেতারা। এতে নেতৃত্ব দেন সিরাজুল আলম খান ও অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আবু তাহের। 

তাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষে ৪ নভেম্বর থেকে সেনাদের মধ্যে নানা দাবির স্লোগান তুলে পোস্টার ছড়ানো হয়। পাকিস্তান-প্রত্যাগত সিপাহিরা এ কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এই পোস্টারে ছিল ১২ দফা দাবি। যেমন— ‘যাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, এমন রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। সেনা সদস্যদের মধ্যে এত র‍্যাঙ্ক থাকবে না। বেতন বাড়াতে হবে, থাকা ও খাওয়ার উন্নতি করতে হবে’ ইত্যাদি। আর সবচেয়ে জনপ্রিয় দাবি ছিল ‘ব্যাটম্যান প্রথা লোপ’। তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়াসংবলিত এ পোস্টার সিপাহিদের আকৃষ্ট এবং উত্তেজিত ও ক্ষুব্ধ করে তোলে।

খালেদ মোশাররফদের অভ্যুত্থান যে ভারতের সহায়তায় ঘটেছে এবং তিনি যে ভারতের দালাল, তা প্রচার করে তার বিরুদ্ধে সিপাহিদের খেপিয়ে ও লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিদেশি গণমাধ্যমেও ঢাকার এক সাংবাদিকের বরাত দিয়ে প্রচার করা হয় যে, খালেদ মোশাররফের সহায়তায় ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশে আসছেন, যা সিপাহিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ জাগিয়ে তোলে খালেদ মোশাররফদের বিরুদ্ধে। দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট থেকে হাজার হাজার সিপাহি খালেদ মোশাররফকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ঢাকামুখী হন। মুসলিম লীগসহ ডানপন্থি দলগুলোও ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’ নাম দিয়ে একটি পোস্টার প্রচার করে সে সময়। 

৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পর সাধারণ সেনারা অফিসারদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান। এমনকি তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে বিশৃঙ্খলভাবে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। এর মধ্যে ১৫ আগস্টের খুনি ফারুক ও রশীদের অনুগত ল্যান্সার ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির জোয়ানরাও ছিলেন। বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে এসে খালেদ মোশাররফ ও তার সঙ্গীরা শেরেবাংলানগরে রংপুর থেকে আসা সেনা ইউনিটে আশ্রয় নেন। ভোরে ফারুক-রশীদের অনুগত ল্যান্সার ও আর্টিলারি বাহিনী সেখানে আসে। তারা প্রথমেই হত্যা করে খালেদ, কে এন হুদা, এ টি এম হায়দার— তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে। 

এরা ক্যান্টনমেন্টে একজন মহিলা ডাক্তারসহ (আবু ওসমান চৌধুরী সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রী) ১৩ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করে। অফিসারের স্ত্রীও বাদ যাননি। রাতেই ফারুক-রশীদের অনুগত ল্যান্সার বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট গিয়ে জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে উদ্ধার করে। 

তারা স্লোগান দেয়, ‘সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ, জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। ’ ৬ নভেম্বর মধ্যরাতের পর ভারি ও হালকা সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের অবিরাম গোলাগুলি করতে করতে সিপাহিরা শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। বিনা বাধায় তারা ঢাকা বেতার কেন্দ্র দখল করে নেন। গণবাহিনী-প্রধান তাহের সাময়িকভাবে বেতার ভবনের কর্তৃত্বভার গ্রহণ করেন। যখন গোলাগুলি চলছিল, তখন পাকিস্তানপন্থি উল্লসিতরাও সমানে ‘জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। ট্রাকে ট্রাকে ভ্রমণরত সশস্ত্র সিপাহিরাও বিভিন্ন রাজনৈতিক স্লোগান দেন। এসব স্লোগানের মধ্যে ছিল— ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার, সিপাহি জনতা এক হও, স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়েছে, গণরাজ কায়েম হয়েছে; বিপ্লবী গণবাহিনী জিন্দাবাদ; কমরেড সিরাজ ভাই লও লও লও সালাম’ ইত্যাদি। 

পাকিস্তানপন্থি সিপাহি আর জাসদের গণবাহিনী এককাতারে নেমে এসেছিল ৭ নভেম্বর। ৭ নভেম্বরের ক্ষমতার পট পরিবর্তনকে পরাধীনতার পরিসমাপ্তি হিসেবে অভিহিত করে এনায়েতুল্লাহ খান সম্পাদিত সরকারি পত্রিকা বাংলাদেশ টাইমস শিরোনাম দেয়, ‘বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম’। গণবাহিনী পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। শিখণ্ডী হিসেবে জিয়াউর রহমানকে সামনে নিয়ে আসার পর সিপাহিরা তার নিয়ন্ত্রণে চলে যান। তাহেরের অনুরোধে সিপাহিদের সমাবেশে কোরআন শরিফ ছুঁয়ে জিয়া প্রতিজ্ঞা করেন যে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলো মেনে নেবেন। 

যেমন— রাজবন্দী হিসেবে জলিল-রবদের মুক্তি এবং ব্যাটম্যান প্রথা লোপ। প্রথম দাবিটি তিনি কার্যকর করলেও বাকিগুলো আর কার্যকর করেননি। তাহের ও সিরাজুল আলম খানের কথিত ‘সিপাহি-জনতা বিপ্লব’ থেকে রব-জলিলসহ রাজবন্দীদের মুক্তি ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয়নি। সিপাহিদের কোনো দাবিই আর পূরণ হয়নি। প্রাণ দিয়েছেন অযথাই বহুজন। তাহের ও সিরাজুল আলম খানের চাওয়া কী ছিল? প্রথমত তারা শেখ মুজিব সরকারকে উত্খাত করতে চেয়েছিলেন।

তাহেরের ‘বিপ্লব’ প্রকল্পে জনগণের কোনো দাবি-দাওয়া, রাষ্ট্র পরিচালনার বিধিবিধান ছিল না। ছিল শুধু সিপাহিশাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা। যেখানে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের অবস্থান গণবাহিনীর অধস্তন। শেখ মুজিব সরকারকে উত্খাত করে সামরিক বাহিনীকে গণবাহিনীতে রূপান্তর করে তাহেররা চেয়েছিলেন ‘বিপ্লব’ নামক বিশাল হাতিকে ধারণ করতে। চীনের গণবাহিনী গড়ে ওঠার পেছনে জনগণের সঙ্গে দীর্ঘ পথচলার বিষয় ছিল। কিন্তু তাহেররা তাদের ‘চীনা বিপ্লব’ ঘটাতে জনগণকে সম্পৃক্ত করেননি। ফলে কেবল সিপাহিদের তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ করার ক্ষেত্রে ‘ট্রেড ইউনিয়ন’ প্রক্রিয়া নিয়ে তাহেররা এগিয়ে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। তাহেরদের বিদ্রোহ বা বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার কারণ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকা, পাকিস্তানপন্থিদের ওপর নির্ভর করা, রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকাসহ আরও নানাবিধ বিষয়। বরং জাসদের কাঁধে চড়ে ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়ে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে তাহেরসহ তার সহযোগীদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হন জিয়া। ক্ষমতায় বসার কদিনের মধ্যে জিয়া তার শপথ থেকে সরে আসেন। তখন তাহেররা নতুন করে বিপ্লব করার আহ্বান জানিয়ে পোস্টার-লিফলেট বিতরণ করেন সেনাবাহিনীর সিপাহিদের মধ্যে। 

শুধু তাই নয়, ২৪ নভেম্বর একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাও তারা করেন। কিন্তু জিয়া তা কঠোরভাবে দমন করেন। ২৩ ও ২৪ নভেম্বর তাহেরসহ জাসদের অন্য নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সরকার উত্খাতের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। তাহেরকে মুক্ত করার জন্য ২৬ নভেম্বর ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণ করে জিম্মি করার ব্যর্থ চেষ্টা চালান তাহেরের ভাইসহ সশস্ত্র অনুগতরা। ঘটনাস্থলে তাহেরের এক ভাই মারাও যান। তাহের ও সিরাজুল আলম খানরা যা চেয়েছিলেন, অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর অধীনে জনগণের শাসন। আর তাই করেছেন জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তী সময়ে এরশাদ। শুধু অবিচারে মৃত্যুবরণ করেন তাহের। জিয়ার ‘পথের কাঁটা’ হিসেবে তাকে সরে যেতে হয়। তাহেরের রোমান্টিক অ্যাডভেঞ্চারের মাশুল জাতিকে আজও দিতে হয়। সেদিনের ‘সিপাহি-জনতা ভাই ভাই’ স্লোগান বুমেরাং হয়ে ফিরেছিল দেশজুড়ে। তাহের ও তার গণবাহিনী বিপ্লবের নামে অবিপ্লবী কর্মকাণ্ড করে দেশকে পাকিস্তানি চেতনার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। যার রেশ এখনো রয়েছে। জাসদ নামক দলটি শতধা বিভক্ত হয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, দৈনিক জনকণ্ঠ ও ডাকসুর সাবেক নেতা

সোনালীনিউজ/জেএ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!