• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘জেলহত্যা : নেতৃত্বশূন্যের চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র’


ব্যারিস্টার এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার নভেম্বর ৩, ২০১৭, ০১:২৪ পিএম
‘জেলহত্যা : নেতৃত্বশূন্যের চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র’

ঢাকা: ১৯৭১ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর ঘটেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। তারপর জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার মহাপরিকল্পনা হিসাবে কারাগারের নিরাপত্তা বেষ্টনির ভেতরে ঢুকে চার নেতাকে প্রথমে গুলি করে পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সমাপ্তি ঘটায় স্বাধীনতার উজ্জ্বল আলোকিত অধ্যায়ের। সমসাময়িক সময়ে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব রাজনীতিতে এ ধরনের জেলহত্যা ঘটনার দৃষ্টান্ত নেই। জেলখানা তুলনামূলক নিরাপদ ও সংরক্ষিত এলাকা। সেখানে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, আইন লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জেল প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বন্দুকের নলের মুখে জেলখানায় বন্দি রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করা খুবই নৃশংস এবং পৈশাচিক ঘটনা।

তখন কারাগারের জেলার ছিলেন আমিনুর রহমান। জার্মানির প্রধান বেতার সার্ভিস ডয়চে ভেলেকে জানান, "তখনকার আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান ৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে সেই রাতে কারাগারে প্রবেশ করেন৷ এরপর টেলিফোনে খন্দকার মোশতাক ৪ নেতার নাম জানিয়ে দেন৷ তাদের নিউ সেলে জড়ো করে ঘাতকরা ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে৷ কারাগারের অভ্যন্তরে লাশের ময়না তদন্ত করা হয়৷ হত্যাকাণ্ডের ২ দিন পর সেনা পাহারায় পরিবারের সদস্যদের কাছে জাতীয় নেতাদের লাশ হস্তান্তর করা হয়৷ তখনকার আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান জানতেন যে ৪ নেতাকে কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যা করা হবে৷ কিন্তু কারাগারের আর কোন কর্মকর্তা ভাবতেই পারেননি যে ওই রাতে এমন পৈশাচিক হত্যাকান্ড ঘটবে।

এ মহান নেতারা বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা বঙ্গবন্ধুর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তাঁরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবন সহচর। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় তাকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত এই প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। এএইচএম কামরুজ্জামান এবং এম মনসুর আলী ছিলেন ওই সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী। জাতীয় চারনেতা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাস সাফল্যের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে মূল ভূমিকা ছিল খন্দকার মুশতাক আহমদের। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মুশতাক চক্র চার নেতাকে তাদের সাথে যোগ দেবার আহবান জানায়। কিন্তু তাদের এই নোংরা প্রস্তাব চার নেতা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এই ঘৃণিত প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। ২ নভেম্বর মুশতাক সরকারের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থানের পরপরই বঙ্গবন্ধুর ঘাতকেরা কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করে।

পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকেই হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থানের আশংকায় ছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এর একদিকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং অন্যদিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ।

তখন ঢাকা সেনানিবাসে মেজর পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন বিগ্রেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন তার লেখা বই 'বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায়: ১৯৭৫-৮১' এ বর্ণনা করেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা তখন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহেমদকে পরিচালনা করছিলেন। বঙ্গভবনে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সেনানিবাসের কিছু ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের একটা সংঘাত চলছিল। খন্দকার মোশতাক যে বেশিদিন ওখানে টিকবে না, এটাও ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছিল। তবে খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল সেটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক বা সমর্থনের বিষয়টি পরিষ্কার নয়।

এমতাবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর একদিকে জেলহত্যা অন্যদিকে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। অভ্যুত্থানকারীরা তাদের স্বপক্ষে কোনো প্রচার-প্রচারণা চালায়নি। বেতার কেন্দ্রেও ঘোষণা দেয়নি। ফলে গুজব আর গুজবে সয়লাব হয়ে পড়ে দেশ। মুশতাক তখনো ক্ষমতায়। খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। ‘রক্তপাত পরিহার করার উদ্দেশ্যে আপস-আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করছিলেন খন্দকার মুশতাক চক্র। আর খালেদ মোশাররফবিরোধী অন্যান্য শক্তি দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে দ্রুত যোগাযোগ করে পাল্টা অভ্যুত্থানের জন্য চেষ্টা করতে থাকে। সে সময় জেনারেল ওসমানী সেনাবাহিনীতে কর্মরত সাবেক মুক্তিবাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের, জনৈক ‘বাচ্চু করিম’ পাকিস্তান প্রত্যাগত পাকিস্তানপন্থি সিপাহীদের, কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীতে জাসদপন্থি সিপাহিদের এ জাতীয় অভ্যুত্থানের ব্যাপারে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা চালাতে থাকেন।

এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন ও পাকিস্তানপন্থী শক্তিগুলো সর্বাত্মক অপপ্রচার তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিল। জাসদও এই প্রচারাভিযানে শামিল হয়। ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য শহর ও বন্দরে জাসদ একটার পর একটা প্রচারপত্র বিতরণ করতে থাকে যে, ‘ভারতের প্ররোচনা ও অর্থায়নে খালেদ মোশাররফ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এমনও প্রচার করা হয় যে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ‘বাকশাল’ নেতারা ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই অভ্যুত্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন যে, খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান পরবর্তী আওয়ামী লীগ বা বাকশালের পক্ষে যদি কোন সরকার গঠিত হতো তাহলে জেলে থাকা চারনেতাই ছিলেন সম্ভাব্য নেতৃত্ব। ফলে মুশতাক সরকারের পতনের পরে ওরা ভেবেছে এই চার নেতামুক্তি পেলে জাতিকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংগঠিত করে ফেলতে পারবেন।

ইতিহাসের এক রক্তাক্ত এই অধ্যায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেমন দুর্দিন নিয়ে আসে তেমনি সামরিক বাহিনীর জন্য আনে রক্ত আর বিশৃঙ্খলার পৌনঃপুনিক আগমন। ৭৫’ এর হত্যাকাণ্ডগুলোর পরপরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদর্শের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এক নতুন ধারার রাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকলো। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, যারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল দেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে তারা আবার ফিরে এলো বিপুল বিক্রমে। চলতে থাকলো মুক্তিযুদ্ধের স্থপতির প্রতি এবং মুক্তিযুদ্ধেরচেতনা নিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার। তার অনেকটাই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল অতিপ্রচারের বদৌলতে।

এরপর ধারাবাহিকভাবে সংবিধান হত্যা বা কর্তন এবং যাঁরা একাত্তরের মহানমুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো, অধিনায়কত্ব লাভ করেছিলেন, তাদের গুণে গুণে হত্যা। আর অকথ্য নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করেছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয়জন ও তাঁর অনুসারীরা। এই জিঘাংসার নায়ক মোশতাক খুনিদের বিচার করা যাবে না, এই মর্মে অদ্যাদেশ জারি করে। পরবর্তীকালে এই অধ্যাদেশ জিয়াউর রহমান সংবিধানে প্রতিস্থাপন করে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহচরদের হত্যার বিচার রুদ্ধ করে দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই কূটচাল ভেদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলস্বরূপ রাজনীতি ও রাষ্ট্র এবং সেনাবাহিনী- বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বারবার।

১৫ই আগস্ট ও ৩রা নভেম্বর প্রতিবছর আমাদের শোকাবহ স্মৃতিকে আরো শোকার্ত করে তোলে। বাংলার আকাশ-বাতাস মাটি ও স্বাধীনতাকামী মানুষ এ বিষাদ স্মৃতি কোনোদিন ভুলতে পারবে না। রক্তক্ষরণের পাশাপাশি এ দুটি হত্যাকাণ্ড থেকে আমরা এ শিক্ষাই গ্রহণ করতে পারি যে, স্বাধীনতা বিরোধীরা ও স্বাধীনতার শত্রুরা কখনো এদেশের মাটি ও মানুষেকে ভালোবাসেনি ও বিশ্বস্ত থাকেনি।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!