• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জেলা পরিষদ না জেলা সরকার?


শফিকুল ইসলাম খোকন ডিসেম্বর ২৬, ২০১৬, ০৪:৫৮ পিএম
জেলা পরিষদ না জেলা সরকার?

কথায় বলে একই কথা বারবার বলতে বা শুনতে ভালো লাগে না। আবার কখনো কখনো এ কথার সাথে একমত পোষন করাও যায় না, বা উচিতও নয়। ঠিক এবারেও পুরানো ওই কথার দ্বিমত পোষন করে আবারও বলতে হচ্ছে ‘পুরানো কথা নতুন করে বলতে হয়’। একটি ইমারত তৈরী করতে হলে যেমন ভিত মজবুত করতে হয়, তেমনি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও গণতন্ত্র বা রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে হলে তৃণমুলের স্তরগুলোও মজবুত করতে হয়। আর সেই তৃণমুলের কয়েকটি স্তরের মধ্যে অন্যতম একটি স্তর হলো ‘জেলা পরিষদ’।

এতো কথা বলার কারণ ইতোমধ্যেই পাঠকরা বুঝতে পেরেছেন। জেলা পরিষদের নির্বাচন। ডিসেম্বরের ২৮ তারিখে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তফছিল ঘোষণা করা হয়েছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে ইতোমধ্যে জানা গেছে, দেশের অনেক জায়গায়ই বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় জেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূলে থাকে অংশগ্রহণমূলক স্থানীয় সরকার। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে গণতন্ত্রের কথা, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা, স্তর বিন্যাসের কথা ও স্থানীয় ইউনিটগুলোর গণতান্ত্রিক করার কথা রয়েছে কাগজ কলমে।

বহু প্রাচীন কাল থেকে এদেশে যে স্থানীয় সরকারের অস্তিত্ব ছিল, যা বারবার হোঁচট খেয়েছে, পরিবর্তন, বিবর্তনের পথ ধরে তা আজ বাংলাদেশে বিকাশমান। কখনো কখনো আইন লঙ্ঘন করে সরকার নিজেদের মতো করে চেয়ারম্যান কিংবা প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছেন। অনেক বছর পর আ.লীগ সরকারের আসার পর ২০১১ সালে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যা আইনসিদ্ধ ছিল না। যাক এতো কিছুর পরেও মন্দের ভালো, অবশেষে নিজেদের মতো করে আইনে কিছুটা সংশোধনী এনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেন সরকার। সে অনুযায়ী তফসিলও ঘোষণা করা হয়েছে ।

জেলা পরিষদ নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোট দেয়ার সুযোগ না থাকায় জনসাধারণের মাঝেও এ নির্বাচন নিয়ে কোনো আগ্রহ বা উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অনেকেই মনে করছেন, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট ছাড়া যে পদ্ধতিতে জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে তা সংবিধানপরিপন্থী। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।

এখানে ‘জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ’ বলতে বোঝায়- ‘জনগণ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে।’ ইতোমধ্যেই জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে উচ্চাদালতে একটি রিটও করা হয়েছে। ওই রিটে বলা হয়েছে- ‘জেলা পরিষদ আইন ২০০০ সালের ৪ (২) ও ১৭ ধারা এবং জেলা পরিষদ সংশোধিত আইনের ৫ ধারাকে রিটে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এসব ধারায় বলা হয়েছে- জেলার অন্তর্ভুক্ত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যেমন- সিটি করপোরেশন (যদি থাকে), উপজেলা পরিষদ, পৌর করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হবেন। এবং তারা জেলা পরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন।

রিটে আরও বলেন, উপজেলা পরিষদ আইনের এই তিনটি ধারা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭, ১১, ২৬, ২৭, ৩১ ও ৫৯ অনুচ্ছেদ এবং প্রস্তাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর মধ্যে সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের প্রত্যেক ইউনিটে প্রতিনিধিরা আইন অনুযায়ী নির্বাচিত হবেন। বাংলাদেশে ইলেক্টোরাল ভোটের নিয়ম নেই। ইলেক্টোরাল ভোটগ্রহণ করার আগে এ সংক্রান্ত বিধি সংশোধন করতে হবে’ (সূত্রঃ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, তারিখঃ ২৯ নভেম্বরর ১৬)।  ওই রিটের প্রেক্ষিতে ৬১ জেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
 
জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী ১২টি বাধ্যতামূলক কাজ করবে জেলা পরিষদ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার গৃহীত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা, জনসাধারণের ব্যবহার্থে উদ্যান, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ। এছাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক কল্যাণসহ কিছু ঐচ্ছিক কাজও করবে জেলা পরিষদ। অথচ সেই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন না, এটা কেমন কথা?

বাংলাদেশের আয়তন, ভূমি ব্যবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস ঐতিহ্য ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে এদেশে দুই প্রকারের কাজ রয়েছে। তা হলো স্থানীয় কাজ ও জাতীয় কাজ। জনগণ স্থানীয় কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে বেশি। সেজন্য স্থানীয় সরকারের কাজ স্থানীয় সরকারের জন্য নির্দিষ্ট হওয়া উচিত। সেজন্য দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, তথা স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সরকার ব্যবস্থা এদেশে বাস্তবায়ন যোগ্য। কিন্তু কেন্দ্রিভূত সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখে অনেকে স্থানীয় সরকার কার্যকর করার কথা বলছেন। যা কখনই বাস্তবসম্মত নয়।

আশার কথা, ‘সিডিএলজি’ দীর্ঘদিন যাবৎ দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কথা বলে আসছে। তাদের মতে, জেলা পরিষদ নয় ‘জেলা সরকার’ হবে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। জেলা সরকার এক হাতে গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ও অন্য হাতে নগরীয় স্থানীয় সরকারগুলো তত্ত্বাবধান করবে। জেলার এই প্রশাসনিক ইউনিটে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। অর্থাৎ জেলা সংসদ, জেলা প্রশাসন ও জেলা আদালত মিলে ‘জেলা সরকার’ হবে। এখানে উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে ‘ডিস্ট্রিক্ট গর্ভনমেন্ট’ প্রথা চালু করেছিলেন। নামে ডিস্ট্রিক্ট গর্ভনমেন্ট হলেও সে ব্যবস্থায় প্রজাতান্ত্রিক রূপ ছিল না। যদি বর্তমানে ‘জেলা সরকার’ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন বাস্তবায়ন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রিককরণ, জনগণের ক্ষমতায়নসহ বহু কিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আরও উল্লেখ্য, বর্তমান অর্থমন্ত্রী আব্দুল মাল আব্দুল মুহিত ২০০১ সালে ‘জেলায় জেলায় সরকার’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম ‘জেলায় জেলায় সরকার’ হলেও সে প্রস্তাবের জেলা সরকারের কোন রূপরেখা ছিল না। সেক্ষেত্রে সিডিএলজির প্রস্তাবটি অত্যন্ত বাস্তবানুগ ও বাস্তবায়নযোগ্য।   

আমদের মনে রাখা দরকার, জেলার আয়তন ছোট হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বহু দেশের সমান। বিভাগ অপ্রয়োজনীয় স্তর হওয়ায় বিভাগীয় পর্যায়ের অফিস আদালত জেলাতে স্থাপন করে এ স্তরটি বিলুপ্ত করে দেওয়া উচিত। জেলার সাথে শুধু কেন্দ্রের সম্পর্ক থাকবে। জেলা সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ সৃষ্টি করা সম্ভব। জেলা হবে স্থানীয় উন্নয়ন ও স্থানীয় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। সেজন্য জেলা পরিষদ নয়, ‘জেলা সরকার’ বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি।

লেখকঃ সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক। ইমেইল- [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!