• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত দিবস আজ


টাঙ্গাইল প্রতিনিধি ডিসেম্বর ১১, ২০১৬, ০৪:৩৭ পিএম
টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত দিবস আজ

টাঙ্গাইল : রোববার (১১ ডিসেম্বর) বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যদিয়ে টাঙ্গাইলে হানাদার মুক্ত দিবস উদযাপিত হচ্ছে। এই দিনে বিজয় উৎসবে মেতে উঠে টাঙ্গাইলবাসী। রোববার সকালে শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র জামিলুর রহমান মিরণ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আলহাজ ছানোয়ার হোসেন এমপি, খন্দকার আব্দুল বাতেন এমপিসহ অন্যান্যরা।

রোববার সকালে টাঙ্গাইল শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যানে উৎসবের উদ্বোধনী শেষে এক বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের হয়। র‌্যালিটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। র‌্যালিতে মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের প্রায় ১০ সহস্রাধিক জনতা অংশগ্রহণ করে।

টাঙ্গাইল পৌরসভা উদ্যোগে আয়োজিত ৬দিন ব্যাপী বিজয় উৎসব শুরু হয়েছে। মুক্তমঞ্চে প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চিত্র প্রদশনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল পাক হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার দামাল ছেলেরা পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে টাঙ্গাইলকে মুক্ত করে। উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। যুদ্ধকালীন সময়ে টাঙ্গাইলের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনী দেশের সীমানা পেড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত ‘কাদেরিয়া বাহিনীর বীরত্বের কথা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।

টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত দিবস ও বিজয়ের ৪৫ বছর উপলক্ষে টাঙ্গাইল পৌরসভার আয়োজনে ৬ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। স্থানীয় শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যানে শোভাযাত্রা, দেশবরেণ্য রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আলোচনা সভা এবং প্রখ্যাত শিল্পীদের সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
কাদেরিয়া বাহিনী সখীপুরের বহেড়াতৈলে অবস্থান করে মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

২৬ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টাঙ্গাইল ছিল স্বাধীন। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রশাসন পরিচালিত হয়। ২৬ মার্চ সকালে আদালত পাড়ার অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামের বাসভবনে এক সভায় গঠিত হয় টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক ও সশস্ত্র গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং বদিউজ্জামান খানকে চেয়ারম্যান ও আব্দুল কাদের সিদ্দিকীসহ আরো ৮ জনকে সদস্য করে কমিটি গঠিত হয়। প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আব্দুল মান্নান, গণপরিষদ সদস্য শামছুর রহমান খান শাজাহান, আব্দুর রাজ্জাক ভোলা ছিলেন অগ্রগণ্য। ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হতে থাকে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা।

গণমুক্তি পরিষদ গঠিত হবার পর চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইল শহর দখল করে। টাঙ্গাইল আসার পথে মির্জাপুরের সাটিয়াচরায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বাঙালি ইপিআর সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পিছু হটলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেখানে গণহত্যা চালায়। তারা গ্রামে ঢুকে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। টাঙ্গাইল দখলের পর কালিহাতী ও মধুপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানেও পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারপর মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যায়। তারা নতুন করে অস্ত্র সংগ্রহ ও সংগঠিত হতে থাকে। আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর অসীম সাহস, দুর্বার দেশপ্রেম, পরিস্থিতি বিশ্লেষণে তীক্ষè দৃষ্টিভঙ্গি সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও যুদ্ধ পরিচালনায় অসম্ভব মেধার কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী দেশ-বিদেশে পরিচিতি পায়।

টাঙ্গাইলের প্রতিরোধযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে পুরো বাহিনী টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এলাকা সখীপুরের বহেড়াতলীতে চলে যান। সেখানে শুরু হয় এ বাহিনীর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া এবং রিক্রুট ও প্রশিক্ষণ। পরবর্তীকালে এ বাহিনীরই নাম হয় কাদেরিয়া বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধকালে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী দক্ষতা এবং সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি অসংখ্য যুদ্ধ ও অ্যাম্বুশ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের অল্প দিনের মধ্যেই কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী। এ বাহিনীর সদস্য ১৭ হাজারে উন্নীত হয়, এছাড়া ১৮ হাজার সেচ্ছাসেবক বাহিনীও কাদেরিয়া বাহিনীর সহযোগী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কাদেরিয়া বাহিনীর যুদ্ধ। এ সময় পাক হানাদারদের কাছে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বাঘা সিদ্দিকী নামে এক মহাতঙ্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এছাড়াও টাঙ্গাইলে খন্দকার আব্দুল বাতেন বাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত বাতেন বাহিনী অনেক জায়গায় হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। চারদিক থেকে আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাক বাহিনী।

১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রায় পাঁচ হাজার পাক সেনা এবং সাত হাজার রাজাকার আলবদর টাঙ্গাইলে অবস্থান করে। খান সেনাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য যমুনা নদী পথে পাঠানো হয় সাতটি জাহাজ ভর্তি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। কাদেরিয়া বাহিনী গোপনে এই খবর পেয়ে কমান্ডার হাবিবুর রহমানকে দায়িত্ব দেয় জাহাজ ধ্বংস করার জন্য মাইন পোতার কাজে। জীবন বাজি রেখে ভূঞাপুরের মাটিকাটা নামক স্থানে ঘটানো হয় জাহাজ বিস্ফোরণ। দুটি জাহাজে দুইরাত দুইদিন ধরে চলতে থাকে অনবরত বিস্ফোরণ। বাকি জাহাজগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ আধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় জেলার বিভিন্ন স্থানে। মুক্তি বাহিনীর এ সকল আক্রমণ ও গোলাবারুদ ধ্বংস এবং অস্ত্র উদ্ধারে খান সেনারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ৮ তারিখ পর্যন্ত টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পরাজিত করে খান সেনাদের। এসব যুদ্ধে ৩ শতাধিক দেশপ্রেমিক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের টাঙ্গাইল অঞ্চলের প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যোদ্ধাদের নিয়ে সখীপুরের মহানন্দা ও কীর্ত্তনখোলায় গড়ে তুলেন দুর্ভেদ্য দুর্গ। একের পর এক আক্রমণের মুখে পাক সেনারা গুটিয়ে জেলার অন্যান্য স্থান থেকে এসে যখন টাঙ্গাইল শহরে অবস্থান নেয় তখন উত্তর ও দক্ষিণ টাঙ্গাইল ছিল সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

৮ ডিসেম্বর পরিকল্পনা করা হয় টাঙ্গাইল আক্রমণের। মিত্র বাহিনীর সঙ্গে সংর্ঘষ হয় পাক  সেনাদের পুংলি নামক স্থানে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণ ভয়ে পাক সেনারা টাঙ্গাইল ছেড়ে ঢাকার দিকে পালায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী চারদিক থেকে সারাশি আক্রমণ চালিয়ে পাক সেনাদের টাঙ্গাইল থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয় কাদেরিয়া বাহিনী। ১০ ডিসেম্বর রাতে টাঙ্গাইল প্রবেশ করেন কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক ভোলা। ১১ ডিসেম্বর সকালে কমান্ডার বায়োজিদ ও খন্দকার আনোয়ার টাঙ্গাইল পৌঁছান। আসেন বিগ্রেডিয়ার ফজলুর রহমান। ১১ ডিসেম্বর ভোরে কাদেরিয়া বাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজ আক্রমণ করে দখলে নেন এবং শহরকে শত্রুমুক্ত করেন। এরপর তারা ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেন।

টাঙ্গাইল শহর সম্পূর্ণ হানাদার মুক্ত হয়। শতশত মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে টাঙ্গাইল শহর। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কাদেরিয়া বাহিনীর ১৫৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং পাঁচশ মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এই বাহিনী থেকে ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় খেতাব পান।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!