• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাক হেলপার থেকে ‘মিনি গডফাদার’ নূর হোসেন


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ১৭, ২০১৭, ১১:৩৬ এএম
ট্রাক হেলপার থেকে ‘মিনি গডফাদার’ নূর হোসেন

ঢাকা: নূর হোসেন। একটি নাম। একটি আতঙ্ক। বিশেষ করে বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের স্বজনদের জন্যতো বটেই। আলাদিনের চেরাগ হাতে পাবার মত করেই উত্থান হয়েছে এই নূর হোসেনের। ট্রাকের হেলপার থেকে আজকের এই শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল টেকপাড়া এলাকার মৃত হাজী বদর উদ্দিনের ছেলে নূর হোসেন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে তিনিই তৃতীয়। পৈতৃক সূত্রেই জায়গা জমির মালিক নূর হোসেন। শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকা নূর হোসেন ইচ্ছা পোষণ করে গাড়ির চালক হওয়ার। ৯০ দশকের আগে সিদ্ধিরগঞ্জের আব্দুল মান্নান কন্ট্রাকটারের মাধ্যমে ট্রাক হেলপার বনে যান। এর পরই রাজনীতিতে নাম লেখান তিনি। ১৯৮৫ সালের এরশাদের কর্মী হয়ে রাজনীতিতে আসেন আলোচিত নূর হোসেন। 

নূর হোসেনকে কাছ থেকে দেখা একাধিক ব্যক্তি জানান, ১৯৮৫ সালে ট্রাকের হেলপার ছিলেন নূর হোসেন। বছরখানেক হেলপারি করার পর ট্রাক ড্রাইভার বনে যান তিনি। ১৯৮৭ সালে তার বাবা বদরুদ্দিন একটি পুরনো ট্রাক কিনলে ওই ট্রাকের চালক হন তিনি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১৯৯২ সালে বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিনের আশীর্বাদে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিন বছর বাদে ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে আদমজীতে খালেদা জিয়ার জনসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। শুরু করেন প্রকাশ্যে রাজনীতি। এর আগে তৎকালীন বিএনপি নেতা বর্তমানে এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের গাড়িতে বোমা হামলা চালিয়ে প্রথম বারের মত ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন নূর হোসেন।

ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার পর নূর হোসেন

এর পরই শুরু হয় নূর হোসেনের অধ্যায়। গড়ে তোলেন নিজের বাহিনী। এলাকার জমি দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড যে বাহিনীর কাজ। আওয়ামী লীগ প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আবারও দলবদল করে ১৯৯৮ সালে শামীম ওসমানের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি। এর পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেন সাত খুন মামলার মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত এই আসামী।

স্থানীয়রা জানান, ১৯৯৬ সালের মার্চে শিমরাইল মোড়ে নূর হোসেনের বাহিনীর গুলিতে নিহত হন রিকশাচালক আলী হোসেন। ২০০০ সালের ১ অক্টোবর থানা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে যুবলীগ নেতা মতিনকে গুলি করে হত্যা করে এই নূর বাহিনী।
 
২০০১ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান নূর হোসেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের এক নেতার সঙ্গে ভারতে সফল বৈঠকের পর বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর দেশে ফিরে আসেন নূর হোসেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের নেতাদের পেছনে মোটা অংক খরচ করে ২০১৩ সালের ২৯ মে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির পদটি বাগিয়ে নেন। অর্থের লেনদেনের ব্যাপারটি পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে। অথচ এর আগে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগে তার সদস্য পদও ছিল না।

সাত খুনের দুই আসামি নূর হোসেন ও ইয়াছিন মিয়ার সঙ্গে সাংসদ শামীম ওসমান

কেবল সাত খুন নয়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ-কাঁচপুরজুড়ে চাঁদাবাজি, শীতলক্ষ্যা নদী দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা, উচ্ছেদে বাধা, গণপরিবহনে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

এসব অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় নূর হোসেনের ‍বিরুদ্ধে ২২টি মামলা রয়েছে। এছাড়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এক মামলায় গতবছর নূর হোসেনকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। ওই রায়ের সময় তিনি ছিলেন ভারতের কারাগারে। 

পুলিশের খাতায় নাম উঠে যাওয়ায় ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এলাকায় ছিলেন না নূর হোসেন। থানার ‘তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী’ হিসেবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাকে ধরতে ইন্টারপোলেরও সহায়তা চাওয়া হয়েছিল।        

নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে এলাকায় ফেরেন নূর হোসেন। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এভাবেই ধীরে ধীরে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন তিনি।

বিলুপ্ত সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক ও বিএনপি নেতা আবদুল মতিন প্রধান নূর হোসেন সম্বন্ধে বলেছেন, তার যত অপকর্ম আছে তা বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় এসেছে। এলাকার মানুষ সবই জানে। নূর হোসেন কতটা কুখ্যাত, তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই।

২০১০ সালে হাই কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে শীতলক্ষ্যার তীর দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা গড়ে তোলায় নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করে বিআইডব্লিউটিএ। সরকারি কাজে বাধা, সরকারি কর্মকর্তাদের হুমকি দেওয়া এবং নদীতীরের প্রায় ৮০০ শতাংশ জমি দখলেরও অভিযোগ আনা হয় ওই মামলায়।

সীতলক্ষা নদীতে হাত-পা বাঁধা লাশ

তারপর কয়েক বছরে ওই জমি থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে আট-দশ বার অভিযান চালানো হলেও নূর হোসেন ও তার সমর্থকদের বাধার মুখে সেসব অভিযান সফলতার মুখ দেখেনি।

শিমরাইল-কাঁচপুরে বিভিন্ন পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় করে এবং চাঁদা না দিলে মারধর ও গাড়ি ভাঙচুরের একাধিক অভিযোগ রয়েছে নূর বাহিনীর বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে একাধিক মামলাও রয়েছে থানায়। পাশাপাশি সিদ্ধিরগঞ্জ সিটি করপোরেশন ট্রাক টার্মিনালে মেলার নামে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক বিক্রির অভিযোগও ওঠে সাবেক এ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে।

সাত খুনের এক জন কাউন্সিলার নজরুল ইসালামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম সে সময় অভিযোগ করেন, র‌্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেন ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। পরে র‌্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও তার সত্যতা পাওয়া যায়। 

অভিযোগপত্রে বলা হয়, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে হত্যার এই পরিকল্পনা করেন আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে র‌্যাব সদস্যদের দিয়ে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শহরের কাছ থেকে পৌর কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত জনকে অপহরণ করেন র‌্যাব-১১ এর কতিপয় সদস্য। এর তিনদিন পর সাত জনেরই মৃতদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে পাওয়া যায়। 

চাঞ্চল্যকর এই সাত খুনের মামলায় গতকাল সোমবার (১৬ জানুয়ারী) সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামির ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। এ মামলার ৩৫ আসামির মধ‌্যে বাকি নয়জনকে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড।

সোনালীনিউজ ডটকম/ঢাকা/এআই

Wordbridge School
Link copied!