• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন ঝুঁকিপূর্ণ!


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৭, ০৩:৫৩ পিএম
ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন ঝুঁকিপূর্ণ!

ঢাকা : কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর হাতিয়ার দ্বীপ ঠেঙ্গারচরে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেখানে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করবেন তারা। পরে সেখান থেকেই মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

অবস্থানকালীন রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করবে সরকার। অবশ্য ওই দ্বীপে নেওয়ার আগে আগামী তিন মাসের মধ্যে সরকার বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ‘ডাটাবেজ’ তৈরি করবে, যাতে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য নিয়ে আলোচনা করতে পারে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে।

সরকারের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতোমধ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়েছে। স্থানান্তর নিয়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মতভেদ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সরকারের এ পরিকল্পনা বাতিলের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। 

সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সুচিন্তিত বলে মনে করছে না রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। সরকারের সঙ্গে এক আলোচনায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) বিষয়টির ব্যাপারে আরো জানতে চেয়েছে। এমনকি জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সংসদ সদস্য মঈনউদ্দিন খান বাদল সরকারের এ সিদ্ধান্ত দেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য ‘বিপজ্জনক উদাহরণ’ সৃষ্টি হবে বলে মন্তব্য করেছেন।

কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে জানা গেছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে অস্থায়ী পুনর্বাসন করার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

গত বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেন, কক্সবাজার দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র, এটাকে ধ্বংস হতে দেওয়া যেতে পারে না। পরিবেশগত ও স্থানীয় লোকজনের সমস্যার কথা বিবেচনা করতে হবে আমাদের। ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের চিরতরে থাকতে দেওয়া হবে না; কারণ তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। রোহিঙ্গাদের এখনই স্থানান্তর করা হচ্ছে না। তাদের পাঠানোর আগে অবকাঠামো নির্মাণ ও জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে।

রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তরে সরকারের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন দেশের শরণার্থী বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা। তারা এ সিদ্ধান্তে সরকারকে অনড় থাকার পরামর্শও দিয়েছেন। তারা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিরোধিতার সমালোচনা করেছেন। তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করতে অবশ্যই সীমান্ত এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের সরাতে হবে। 

তবে তারা যেখানেই নেওয়া হোক, সেখানে বসবাস উপযোগী ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে মিয়ানমারের অবৈধ নাগরিকদের হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে অস্থায়ী ক্যাম্পে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় ঠেঙ্গারচরে কাঠামো তৈরির কাজ চলছে। তবে ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গা পাঠানোর কাজ শুরু করতে সময় লাগবে। 

কিন্তু নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। তারা অস্থায়ী ভিত্তিতে সেখানে থাকবে এবং আমরা চাইব মিয়ানমার সরকার যত দ্রুত সম্ভব তাদের ফেরত নেবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তরের এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ঠেঙ্গারচরে যাওয়ার ব্যাপারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে। একপক্ষ চাইছে, মিয়ানমারে যেতে। সে ক্ষেত্রে তাদের স্থায়ী আবাসনের দরকার নেই। স্থায়ী আবাসন হলে তাদের পক্ষে আর নিজ দেশে ফেরত যাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু যে পক্ষ যেতে চাইছে না, তাদের মত হলো, ঠেঙ্গারচর বসবাসের উপযোগী নয়। 

এ জন্য দীর্ঘদিন ধরে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা নেতারা বিভিন্নভাবে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও আন্তজার্তিক সম্প্রদায়ের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। কেন রোহিঙ্গারা ঠেঙ্গারচর যেতে চাইছে না, নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশ কিছু রোহিঙ্গা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। কেউ স্থায়ীভাবে ব্যবসা করছে, কেউ এ দেশে বিয়ে করে সংসার করছেন। এমনকি রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মানবপাচারসহ ইয়াবা বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছে। তাই ঠেঙ্গারচরে নিয়ে গেলে সবচেয়ে বিপদে পড়বে তারা।

জানা গেছে, ১৯৯১ সালে উখিয়া টেকনাফ সীমান্তে নাফ নদ অতিক্রম করে মিয়ানমারের দুই লাখ ৪৮ হাজার ৫৩০ জন রোহিঙ্গা সপরিবারে উখিয়া, টেকনাফ ও রামু উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। এ সময় সরকার আশ্রয় কেন্দ্র খোলে এসব রোহিঙ্গাকে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে। 

পরে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সরকার সক্ষম হলেও উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার ও টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় ১৪ হাজার রোহিঙ্গা রয়ে যায়। সরকারি নিবন্ধিত এক লাখ রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং সরকারি বনভূমির জায়গা দখল করে অবস্থান করছে। টেকনাফের লেদা এলাকায় বস্তি করে বাস করছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, এখানে রোহিঙ্গাদের বাস দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ সীমান্ত এলাকায় বাস করায় বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি ও অপরাধীরা এদের অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানে ব্যবহার করছে। এদের মাধ্যমে সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে এসব চোরাচালান চালাচ্ছে। মিয়ানমারে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী দল আছে, তারাও এসব রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করছে। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও শরণার্থী-মানবপাচার গবেষক জাকির হোসেন বলেন, ঠেঙ্গারচর বা অন্য যেখানেই নেওয়া হোক না কেন, কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের সরাতে হবে। কারণ দিনে দিনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেভাবে বাড়ছে, তাতে পর্যটন কেন্দ্র তো দূরেই থাক, সাধারণ বসবাসের উপযোগীও থাকবে না এই এলাকা। পর্যটন এলাকা হিসেবে কক্সবাজার গুরুত্ব হারাচ্ছে। আর এ সবই হচ্ছে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে চার থেকে পাঁচ লাখ চিহ্নিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কক্সবাজারের টেকনাফ উখিয়া এলাকায় রয়েছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়ার। আমি মনে করি, সরকারের এ সিদ্ধান্তে অনড় থাকার সময় এসেছে। রাখাইনে এখনো ১২ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। বাংলাদেশ কি সব রোহিঙ্গা এ দেশে পুনর্বাসন করবে? এটা কখনোই হতে পারে না।

সোনালীনিউজ/জেডআরসি/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!