• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডিজিটাল যুগেও তারা ক্রীত দাস!


শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মে ১, ২০১৭, ০৯:০২ পিএম
ডিজিটাল যুগেও তারা ক্রীত দাস!

ঢাকা: সূর্য ওঠার আগেই ঘর থেকে বের হতে হয় পঞ্চাশের কোঠা পেরোনো জয়নালকে। যেতে হয় পুরান ঢাকার লোহা গলানোর একটি কারখানায়। যেখানে লোহা গলিয়ে ছাঁচে ঢেলে বিভিন্ন আকারের লোহার সামগ্রী তৈরি করা হয়।

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টানা ১২ ঘণ্টার বেশি গ্যাসের উত্তপ্ত আগুনের তাপ সহ্য করতে হয়ে জয়নালকে। এতে শ্বাসকষ্ট হয়েছে তার। রাতের ঘুমও কম হয়। অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠেন। শুধু কি জয়নাল? এরকম হাজারো শ্রমিক কাজ করেন এই লোহা গলানোর কারখানায়।

সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে জয়নাল মজুরি পান আড়াইশ টাকা। মার্কিন ডলারে যা তিন ডলারের সমান। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে কোনো ব্যক্তির দৈনিক গড় আয় তিন ডলারের কম হলে তিনি দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করেন। এ হিসাবে জয়নাল এখনো দরিদ্র সীমার প্রান্তে অবস্থান করছেন। কোনো কারণে উপার্জন সক্ষমতা হারালে হতদারিদ্র সীমার নিচে নেমে যেতে পারেন।

জয়নাল যেখানে কাজ করেন সে কারখানাটিতে টিউবওয়েল থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেশিনের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়। ক্ষুদ্র-শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করলেও তার নেই হাজিরা খাতা। বিদ্যমান শ্রম আইন তাদের ওপর প্রয়োগ না হওয়ায় এই খাতটি আনুষ্ঠানিক শ্রম বাজার হিসেবে স্বীকৃত নয়। প্রচলিত ভাষায় তাদের হিসাব করা হয় অনানুষ্ঠানিক শ্রম হিসেবে। যদিও মোট দেশজ উৎপাদনের যোগফলে (জিডিপি) তাদের কর্মঘণ্টা হিসাব করা হয়।

রাষ্ট্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের হিসাব যোগ করলেও শ্রম ও জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। শ্রম আইনের প্রয়োগ না থাকায়, জয়নালের মতো শ্রমিক এখনও ছুটি, ওভার টাইম, উৎসব ভাতা, বোনাস, চিকিৎসা খরচ, চাকরির নিশ্চয়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। অথচ তাদের ঘামের ওপর টিকে আছে আজকের নগর সভ্যতা। তাদের পুঁজি করে এক শ্রেণির মানুষ বিত্তশালী হচ্ছে। কিন্তু তাদের উন্নয়ন হয়নি। বংশ পরম্পরায় এখনো তারা শ্রমিক হিসেবেই থাকছেন। অসুস্থ হলেও তাদের কাজে যেতে হয়।

কয়েকদিন আগে চোখের চিকিৎসার জন্য জয়নালের বাবা ঢাকা আসেন। ফার্মগেটের ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে অপরেশনের দিনে সকাল বেলা জয়নালের যাওয়ার কথা। মালিক ছুটি দেয়নি। কাজ শেষে, বিকেল বেলা হাসপাতালে যান জয়নাল। তার অনুপস্থিতিতেই অপারেশন হয়েছে।

ইটভাটা, নির্মাণ খাত, চামড়া শিল্প, ট্যানারি, জুতা, মোম, প্লাস্টিক উপকরণ তৈরি, লেদ মেশিন, জাহাজ ভাঙা শিল্প, বাসের বডি তৈরি, অভ্যন্তরীণ বাজারের পোশাক কারিগর ও মজুর শ্রেণির শ্রমিকদের অবস্থা জয়নালের মতো। জয়নাল তাদেরই প্রতিনিধি। এরা এখনো মালিকের কথা মতোই জীবন চালায়। নেই কোনো স্বাধীনতা। কাজের মৌসুমে দৈনিক ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টার মতো কাজ করতে হয়। তারপরেও পায় না ওভার টাইম ও ন্যায্য মজুরি। এরা এখনো দাস হয়ে আসছে। ডিজিটাল যুগেও তাদের দাসত্বের অবসান হয়নি।

বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে দেশের মোট শ্রমের ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের। দেশের বিসিকসহ অন্য শিল্প নগরিতে কর্মরত শ্রমিকদের অবস্থাও এই রকম। অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা এভাবেই দিন যাপন করছে। বিদ্যমান শ্রম আইন তাদের কোনো সুরক্ষা দিতে পারে না। আইনকে ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন কারখানা মালিকরা। 

১৮৮৬ সালের পহেলা মে শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের অধিকারের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। শিকাগোর হে মার্কেটের সামনে বিশাল শ্রমিক জমায়েত ও বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ১১ জন। এর পরপরই হে মার্কেটের ওই শ্রমিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। গড়ে ওঠে শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য। অবশেষে তীব্র আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ১৮৮৯ সাল থেকে মে দিবস পালন করা হয়।

কিন্তু জয়নালের মতো শ্রমিক দিবসটিকে জানে ছুটির দিন হিসেবে। তাদের অধিকার আদায়ের দিবস, এটি তা জানেন না, জানার আগ্রহও নেই।

বিদেশি ক্রেতাদের চাপে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সাড়ে তিন হাজার কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করা হয়ছে। টয়লেট, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ক্যাফেটেরিয়া, নিজস্ব চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা সেবা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সর্বোপরি ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। চাকরির নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। শ্রমিকের স্বীকৃতি পেয়েছে।

কোনো কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে বকেয়া বেতন আদায়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সরকারের উদ্যোগে করা হয়েছে আপদকালীন ফান্ড। নিয়মিত কারাখানাগুলো পরিদর্শন করা হচ্ছে সরকারের প্রতিনিধিদের দিয়ে। প্রথম শ্রেণির মর্যাদার লেবার ইন্সপেক্টর নিয়োগ করা হয়েছে। যাদের বাধ্যতামূলক মটরসাইকেল ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), বিশ্ব ব্যাংক, ইউএস এইড, নেদারল্যান্ড ও কানাডা সরকার এই খাতের উন্নয়নে মনোযোগ, প্রশিক্ষণ, নীতি সহায়তা, পরামর্শ ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছে।

ফলে পোশাক শ্রমিকদের মান উন্নয়নের একটি প্লাটফরম তৈরি হয়েছে। ক্রেতাদের চাপে দেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও সরকার তাদের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি যার ওপর ভর করে চলছে, সেই অভ্যন্তরীণ শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের খোঁজ নেয়ার কেউ নেই।

এজন্য বাংলাদেশের শ্রম আইনকে বৈষম্যমূলক হিসেবে দেখছে জাতিসংঘ। সুপারিশ দিয়েছে দ্রুত আইনটি সংশোধনের। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সাবেক নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান সোনালীনিউজকে বলেন, সংশোধিত শ্রম আইন শুধু পোশাক শিল্প নয়, সব সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য। আইনটির প্রয়োগকারী সরকারি সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দিতে হবে। বিদেশিদের চাপে পোশাক শিল্পে সরকার মনোযোগী হয়েছে। তবে, অভ্যন্তরীণ বাজারের শ্রমিকদের ব্যাপারে সরকারের মনোযোগ কম।

গবেষক মুস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, মে দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও তাদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। এই দেশের বৈশিষ্ট্য হলো, তার নাগরিকদের অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতার নিশ্চয়তা দেয়া।

বিশ্লেষকদের মতে, অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদেরও সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে আনতে হবে। দিতে হবে বিভিন্ন প্রণোদনা। তাহলে সমাজে আয় বৈষম্য কমে আসবে। ঠিক থাকবে আর্থ-সামাজিক অবস্থা। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে সরকার যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা অর্জন করতে পারবে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আতা

Wordbridge School
Link copied!