• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তরুণ প্রজন্ম জানে না উমর আলীর সেই বীরত্বের কথা


মেহেরপুর প্রতিনিধি ডিসেম্বর ২৩, ২০১৬, ০৫:১১ পিএম
তরুণ প্রজন্ম জানে না উমর আলীর সেই বীরত্বের কথা

স্বামীর অপেক্ষায় উমর শাহের স্ত্রী ছকিনা খাতুন

একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলে যারা বীরত্বগাঁথা ইতিহাস রচনা করেছেন তাদের অন্যতম একজন মেহেরপুর গাংনীর তেরাইল গ্রামের বীর উমর আলী শাহ। পাকিস্তানি সৈনিকদের বর্বরোচিত নারকীয়তার বিরুদ্ধে হোঁসো হাতেই গর্জে উঠেছিলেন তিনি। প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নেয়া মানুষের দীর্ঘ লাইনও তার মনকে দুর্বল করতে পারেনি। পরিবারের সভ্রম রক্ষায় দুই পাকিস্তানি সৈন্যকে হোঁসো দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে কেড়ে নিয়েছিলেন রাইফেল। পাল্টা আক্রমণে গুলিবিদ্ধ উমর আলী শাহ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভারতের কৃষ্ণনগরে ছিলেন। দীর্ঘ ৪৫ বছরেও পরিবার পাননি তার সন্ধান। একাত্তরের দুঃসহ সেই স্মৃতি আকড়ে তিন সন্তান নিয়ে স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় আজও প্রহর গুণছেন স্ত্রী ছকিনা খাতুন (৬৫)। অপরদিকে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানে না উমর আলী শাহের সেই বীরত্বের কথা।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর আম্রকাননে প্রথম সরকারের শপথের পর থেকেই কার্যত মেহেরপুর জেলা পাক হানাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। পাকিস্তানিরা গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। শুরু হয় মুক্তিকামী মানুষের উপর নজরদারী ও অমানুষিক নির্যাতন। বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকেন নারী-পুরুষ। এর প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠেন তেরাইল গ্রামের দিনমজুর কৃষক উমর আলী শাহ। ঘাস কাটার হোঁসে ধার দিয়ে রাখতেন পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের লক্ষে।

১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই রাতে পাক বাহিনীর কয়েকজন হায়েনা প্রবেশ করেন উমর আলী শাহের বাড়িতে। মান-সম্মান রক্ষায় সেই হোঁসে দিয়ে দুই সৈন্যকে হত্যা করে বীর উমর আলী শাহ। এক সৈন্যের ছোঁড়া গুলিতে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। নিহত সৈন্যদের দুটি রাইফের নিয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ উমর আলী রাতেই পালিয়ে যায় ভারতে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র দুটি জমা দেন। ঘটনার পর থেকে তেরাইল গ্রামে শুরু হয় নির্বিচারে মানুষ হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। অন্তত ১১ জনকে হত্যা করা হয় বলে জানান ওই সময়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়া আব্দুর রশিদ।  

অবুঝ দুই শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে সাত মাসের গর্ভবর্তী স্ত্রী ছকিনা খাতুনও পাড়ি জমান ভারতে। করিমপুর হাসপাতালে স্বামীর সঙ্গে শেষ দেখা হয়। পরে কৃষ্ণনগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় উমর আলীর সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ বিছিন্ন হয়। দেশ স্বাধীনের পর স্বামীর অনুপস্থিতিতে তিন ছেলে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েন তিনি। পরের বাড়িতে কাজ করে চলে তার সংসার। ওই দিনের ঘটনায় বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পর জমিও দখল করে অনেকেই। তাই অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু করেন ছকিনা। এমনটি স্মৃতি চারণে বলেন ছকিনা খাতুন।

ছকিনা খাতুন বলেন, স্বাধীনের পর উমর শাহ মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেয়েছেন। কিন্তু তিন ছেলেকে তিনি লেখাপাড়া শেখাতে পারেননি। সেই সময় থেকে জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে যে যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্যে দিন পার করেছেন তা ভোলার নয়। অনেকেরই লাশ পাওয়া গেছে কিন্তু তার স্বামী বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন তা আজও জানে না পরিবার।

তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা না দেওয়াটাকে জাতির এক বড় ব্যর্থতা উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক রফিকুর রশিদ রিজভী বলেন, দেখতে দেখতে আমরা চার দশক পেরুতে চলেছি। এই দেশেরই মানুষ কত না লড়াই-সংগ্রাম করেছে, কিভাবে আত্মাহুতি দিয়েছে, সেই সব বীরত্বগাঁথার কথা তরুণ প্রজন্মকে জানানো না গেলে তারা কি শিখবে? প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইতিহাস ধরে রাখা না গেলে জাতিসত্ত্বার বিপর্যয় মোকাবেলা করা যাবে না।

জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী অন্যতম একজন গাংনী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম শফিকুল আলম। তিনি জানান, বীর উমর আলী শাহ আমাদের গর্ব। তার বীরত্ব সত্যিই বিমোহিত করে। গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক কিভাবে এই দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন তা কোনোদিনই ভোলার নয়। তার স্মৃতি রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।

উমর আলী শাহের পরিবারের দাবি, প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই আজ তার দুই ছেলে প্রতিষ্ঠিত। উমর শাহের বীরত্বের গর্বে তাদের বুক ভরে যায়। কিন্তু তার স্মৃতি রক্ষায় কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তার নামে প্রতিষ্ঠান ও সড়কের নাম করণ ও স্মৃতি ফলক নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন পরিবার ও এলাকার অনেকেই।

দাবিগুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করার কথা জানালেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মুন্তাজ আলী।  

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!