• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তৃণমূল নিয়ে চিন্তিত আ.লীগ


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ৩০, ২০১৭, ১০:২১ পিএম
তৃণমূল নিয়ে চিন্তিত আ.লীগ

ফাইল ফটো

ঢাকা: বেপরোয়া হয়ে উঠছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূল। মাঠপর্যায়ে এখন কোন্দল আর ঠাণ্ডা লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই দলটির নেতাকর্মীরা। মন্ত্রী, এমপি, জনপ্রতিনিধি ও দলীয় নেতাদের মধ্যে চলছে, বয়কট ও পাল্টা বয়কটের ঘোষণাও। প্রকাশ্যে মারামারি, হানাহানি, সংঘাত ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন নেতাকর্মীরা।

এ কারণে তৃণমূলের রাজনীতি অনেকটাই নাজুক। কেন্দ্র থেকে বারবার সতর্ক করার পরও দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ না হওয়ায় চিন্তিত ক্ষমতাসীন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। এমন প্রেক্ষাপটে বিরোধপূর্ণ জেলা ও থানা কমিটির নেতাদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বৈঠক করছে কেন্দ্র। এর মাধ্যমে চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ হবে বলে আশাবাদী কেন্দ্রীয় নেতারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সম্প্রতি অন্তত ২০টি জেলায় দলীয় কোন্দল প্রকাশ্যে মারামারি-প্রাণহানির পর্যায়ে গড়িয়েছে। তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নেয় চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা। চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে সুইমিংপুলের নির্মাণকাজ বন্ধের দাবিতে ঘেরাও কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের ২৫ নেতাকর্মী। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক মন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে হরতালও ডেকেছেন স্থানীয় এমপির সমর্থকেরা।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী এবং বর্তমান মেয়র ও নগর সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের বিরোধ বেশ পুরনো। সম্প্রতি তা আরো প্রকাশ্যে রূপ নেয়। পৃথক সমাবেশ ডেকে মহিউদ্দীন ও নাছির একে অপরের কড়া সমালোচনা করেন।

চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে বিভক্তি ও সংঘাত সংঘর্ষের জন্য একে অপরকে দায়ি করে বক্তব্য দেন। এরই মধ্যে সুইমিংপুল নির্মাণকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। জানা গেছে, মেয়র নাছির সুইমিংপুল নির্মাণের পক্ষে অন্য দিকে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরীর অবস্থান বিপক্ষে আর দুই শীর্ষ নেতার বিরোধিতার জের ধরেই ছাত্রলীগ ও পুলিশের মধ্যে এ সংঘর্ষ বাধে। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ বেশ চিন্তিত।

আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে দলীয় নেতাদের বিরোধ নিয়ে আগে একাধিকবার বৈঠক করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। দলীয় নেতাদের কোন্দল নিরসনে সম্প্রতি চট্টগ্রামে একটি প্রতিনিধি সম্মেলন করা হয়। সেখানে একজনের অনুসারি নেতা অন্যজনের অনুসারিদের নিয়ে নানা ধরনের তীর্যক বক্তব্য দেন।

পরে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সবাইকে সতর্ক করে একসঙ্গে চলার নির্দেশ দেন। তবুও বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বেশ ক্ষুব্ধ। দলের এক সভায় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে চট্টগ্রামের বিষয়টি তিনি নিজেই দেখবেন বলে জানান। এমন প্রেক্ষাপটে শুক্রবার আবারো নগরের প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সভায় ওবায়দুল কাদের মহিউদ্দীন-নাছিরের বিরোধের কথা উল্লেখ করে বলেন, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের মুরব্বি বলতে আছেন একজনই। তিনি হচ্ছেন মহিউদ্দীন চৌধুরী। আমি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, মহিউদ্দীন ভাই আমারও মুরব্বি। কিন্তু সারা দেশে দেখুন এ রকম একজন মুরব্বি আর কোথাও নেই। তবুও চট্টগ্রামে কাদা ছোড়াছুড়ি কেন? এ রকম একজন মুরব্বি থাকলে তো আর কাউকে লাগে না।

নাছিরকে ছেলের মতো দেখার অনুরোধ জানিয়ে মহিউদ্দীনের উদ্দেশে কাদের বলেন, নাছির আপনার ছেলের বয়সী। সে ভুল করলে তাকে ঘরে ডেকে নিয়ে শাসন করবেন। কিন্তু আমরা তো ঘরের কথা এভাবে পরকে বলতে দিতে পারি না। দুঃখজনক হলো আপনারা ধৈর্য ধরতে পারেননি। যে ধৈর্যটা ধরা উচিত ছিল।

অন্যদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না করা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। জেলার বিজয়নগরে নবনির্মিত উপজেলা প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্রের উদ্বোধনের পূর্বনির্ধারিত তারিখ ছিল ২৩ এপ্রিল। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হকের বিজয়নগর সফরসূচিও ঘোষণা করা হয় আগেই।

কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে আমন্ত্রণ না জানানোর অভিযোগ তুলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এই সফরের বিরোধিতা করে। তারা কর্মসূচি বর্জনের পাশাপাশি মন্ত্রীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে সফর ঠেকাতে হরতালেরও ডাক দেয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। মন্ত্রীর সফরসূচি সামাল দিতে গিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের হামলায় পুলিশের ওসিসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বর আহত হন। পরে কঠোর পুলিশি নিরাপত্তায় উন্নয়ন কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন মন্ত্রী। এ ঘটনায় দলের ভেতরে বেশ তোলপাড় হয়।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগ তৃণমূলের কোন্দলে জর্জরিত সাংগঠনিক জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, খুলনা জেলা, রাজশাহী জেলা, নাটোর, নওগাঁ, বরিশাল মহানগর, ভোলা, পিরোজপুর, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ। এসব জেলায় মাঝেমধ্যেই ঘটে অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনা।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে দেশে ১৭৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আর নিহতদের মধ্যে ৮৩ জনই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের শিকার।
 আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, মাঠপর্যায়ে দলীয় কোন্দল নিয়ে বেশ চিন্তিত দলের হাইকমান্ড। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। অবিলম্বে এসব কোন্দল নিরসনে ব্যর্থ হলে আগামী নির্বাচনে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

সে জন্য কোন্দলপূর্ণ জেলাগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে গত রোববার থেকে কুষ্টিয়া ও যশোরসহ তিন জেলার নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে কেন্দ্র। তবে যশোরের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকটি তেমন ফলপ্রসূ না হওয়ায় আবারো ওই জেলার থানা ও উপজেলা নেতাদের কেন্দ্রে ডাকা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কোন্দল নিরসনে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, নির্বাচনের আগে দলীয় কোন্দল নিরসনে ধারাবাহিক বৈঠক করছি। আশা করি এ কোন্দল নিরসন করতে পারব।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘আমাদের কিছু কিছু জেলায় খানিকটা সমস্যা রয়েছে। তবে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে তা অবিলম্বে নিরসন হবে বলে আমরা আশাবাদী।’

দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এত বড় দলে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা তো থাকবেই। এসব ঘটনাকে আমরা খুব বড় করে দেখছি না। আসলে এগুলো নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে তা অবিলম্বে নিরসন হবে। এ ছাড়া দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে। তিনি ডাক দিলে সব বিভেদ ভুলে নেতাকর্মীরা আগামী নির্বাচনে দলকে বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!