• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তোরা সব জয়ধ্বনি কর...


মিতুল আহমেদ ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬, ০৩:০৬ পিএম
তোরা সব জয়ধ্বনি কর...

ঢাকা: ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়েছিল চলতি বছরের ১৮ মার্চ। সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ও আতাউর রহমানের নির্দেশনায় নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বলের প্রযোজনায় এই নাটক। যেখানে উপস্থিত ছিলেন নাটকটির লেখক প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হক নিজে।

সম্ভবত শামসুল হকের জীবিত থাকা অবস্থায় এটায় তার লেখা নির্দেশিত কোনো নাটক। এ নাটকটির মঞ্চস্থ হওয়ার সময় সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, আতাউর আমার ১১টি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছে। আমার নাটকের একটা বিষয় হলো যে তা চট করে ধরা যায় না মঞ্চস্থ করার জন্য। আমি নিজেও তা জানি। একটি ভাবনাকে গভীর চিন্তার আকার দিতে হয়। কিছু দল আমার নাটক ধরেও শেষ পর্যন্ত এগোতে পারেনি। কিন্তু আতাউর ঝুঁকি নেয়। কীভাবে যেন সে ঝুঁকিগুলো মোকাবিলা করে ঠিকই সফল হয়।   

হ্যাঁ। এইদিক থেকে নাটকটি সত্যিই সফল হয়েছে। কারণ মার্চ মাসের পর থেকে এখন পর্যন্ত বেশ ক'টি সফল মঞ্চায়ন হয়েছে ‌‌তোরা সব জয়ধ্বনি কর নাকটটির। বিশেষ করে বাংলার জাতীয় দিবসগুলোতে সৈয়দ হকের ‘তোরা সব জয় ধ্বনি কর’ যেনো অনিবার্য হয়ে উঠছে। স্বাধীনতা দিবসে নাটকটি যেমন প্রাসঙ্গিক, তেমনি বিজয় দিবসেও। আর বাংলাদেশের ৪৫তম বিজয় উৎসবেও শিল্পকলায় মঞ্চস্থ হয় নাটকটি।

তোরা সব জয়ধ্বনি কর নাটকের প্রেক্ষাপট ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ-পরবর্তী সময়, যখন নিরীহ বাঙালির ওপর হঠাৎ করেই অত্যাচার, নিপীড়ন আর নিষ্পেষণের ভয়াবহ খড়্গ নিয়ে হাজির হয় বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জায়গায় চলছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এই কঠিন আর সংকটময় মুহূর্তের গল্প নিয়ে নাটকটি লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। পরিস্থিতি আর চাপের মুখে যে একটা জাতি কোনো প্রস্তুতি ছাড়া নিজের সম্ভ্রমহানির প্রতিশোধ নিতে বীর বেশ ধারণ করতে পারে, সেই কথাই যেন গাঁথা থাকে তোরা সব জয়ধ্বনি কর নাটকের পরতে পরতে। একই সঙ্গে পাকিস্তানিদের অজ্ঞতা ও মূর্খতার বয়ানও তুলে ধরা হয়েছে নাটকটিতে।

সাধারণ একজন মানুষ নজরুলকে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভেবে পাকিস্তানিরা তার ওপর যে অকথ্য অত্যাচার করে, তা ধারণাতীত। অথচ মানুষটি মোটেও যুদ্ধ কিংবা অস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত নয়। সে স্ত্রী, সন্তান আর নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বলেই ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভয়ে তাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সুযোগ বুঝে সেও সেখানেই যাচ্ছিল। আর তখনই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তাকে পাকিস্তানিরা চিহ্নিত করে বিদ্রোহী কবি নজরুল হিসেবে। তারা মনে করে, বাঙালিকে নিষ্পেষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলছে এই নজরুলের লেখা মারাত্মক সব কবিতা। তাই তাকে ধরে এনে চাপ দেওয়া হয়, যাতে বাঙালিকে সে বোঝায়, তারা যে পথে আছে, তা দেশদ্রোহের পথ। কিন্তু নজরুল জানে, সে কবি কাজী নজরুল নয়। কোথাও বিরাট ভুল হয়ে গেছে সেনাবাহিনীর। সে তো কবিতা লিখতেই জানেন না! কীভাবে সে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার লেখকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে? নজরুল যে যুদ্ধ করছে, এ যুদ্ধ প্রত্যেক বাঙালির। যার ভাবনায় এত দিন সংসার, সন্তান, একান্ত ব্যক্তিগত জগতের বাইরে কিছুই ছিল না, সেও বুক চিতিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামনে বজ্রকণ্ঠে বলে ওঠে ‘জয় বাংলা’।  

একাত্তরে নিরস্ত্র বাঙালি শুধু পরিস্থিতিকে ঘিরে কীভাবে বীরসেনাতে পরিণত হয়েছিল, কী করে প্রত্যেক সাধারণ মানুষ জড়িয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে, তা সরল ভাষ্যে একটি চমৎকার ঘটনার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন সৈয়দ শামসুল হক আর আতাউর রহমান। বাঙালিরা তখনো যুদ্ধের কিছুই জানত না। তারা কখনো যুদ্ধ করেনি, যুদ্ধ দেখেনি, যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, পূর্বপ্রস্তুতি নেই। কিন্তু তারপরও নিজেদের সম্ভ্রমহানি দেখতে দেখতে সবচেয়ে নিরীহ মানুষটিও গর্জে ওঠে, প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। বীরবেশে প্রবেশ করেন রণক্ষেত্রে। চাপের মুখে মানুষের সম্ভ্রমে মানুষের ভেতরের অসাধারণত্ব বেরিয়ে আসে।

নজরুলের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় এবং একই সঙ্গে কর্নেল, ক্যাপ্টেন ও নজরুলের প্রেমিকা সালেহার অসাধারণ অভিনয়ে মুগ্ধ উপস্থিত দর্শক নিশ্চয়ই একাত্তরে নিরস্ত্র বাঙালির এককাট্টা ভাবটা সামান্য হলেও অনুধাবন করেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে আতাউর রহমান তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বড় শিল্প অন্তরের তন্ত্রীতে আঘাত করে, অনুরণন তোলে, ঝংকার তোলে। তাঁর নির্দেশনায় সৈয়দ শামসুল হক রচিত তোরা সব জয়ধ্বনি কর নাটকটি তেমনই একটি বড় শিল্প, যা মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে বিশাল এক ঝাঁকি দিয়ে যায়। তোরা সব জয়ধ্বনি কর মঞ্চস্থ হোক বাঙালির দ্বারে, বাঙালি জানুক তার সাহসী হয়ে ওঠার গল্প।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিএল

Wordbridge School
Link copied!