• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

থামছে না বিচারবহির্ভূত হত্যা, দেড় মাসে নিহত ১৯


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৭, ০২:২৯ পিএম
থামছে না বিচারবহির্ভূত হত্যা, দেড় মাসে নিহত ১৯

ঢাকা: চলতি বছরে মাত্র দেড় মাসের মধ্যে ১৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন নয়জন। আর চলতি মাসের প্রথম ১৬ দিনেই তা দাঁড়িয়েছে দশজনে।

সর্বশেষ শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ভোর ৪টার দিকে কক্সবাজার শহরের কলাতলী কাটাপাহাড় এলাকায় ইয়াবা ব্যবসায়ী দু'গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলিতে মুসতাক আহম্মদ ওরফে হাজী মফিজ নামে একজন নিহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে, মুসতাক ইয়াবা ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে একাধিক মাদক ও অস্ত্র মামলা রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে ইয়াবা, বন্ধুক ও গুলি জব্দ হয়েছে।

একই সময়ে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়ায় গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তালিকাভূক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী খুরশীদ আলম সোহেলকে (৩৪) গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চার সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের কাছ থেকে তিনটি পিস্তল ও বেশকিছু গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত তিনটার দিকে রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া অঞ্চলিক মহাসড়কের বনগ্রাম এলাকায় পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মোজাম্মেল নামে এক চরমপন্থী নেতা নিহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে, নিহতের বিরুদ্ধে হত্যা-খুন এবং ধর্ষণসহ সাতটি মামলা রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একটি ওয়ান শুটারগান, এক রাউন্ড  তাজা কার্তুজ এবং দুই রাউন্ড ফায়ার কার্তুজ উদ্ধার করে।

আর গত বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) পাবনায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। পুলিশের দাবি, পাবনায় নিহত ব্যক্তি নিজাম নিস্তার। তিনি চরমপন্থি দল নিস্তার বাহিনীর প্রধান। পাবনা সদর উপজেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক এ নিজামের বিরুদ্ধে ঢালারচরের আলোচিত পুলিশ হত্যা, অপহরণ চাঁদাবাজিসহ প্রায় দুই ডজন মামলা রয়েছে।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও সুশীল সমাজের একের পর এক সমালোচনার পরও থামছে না কথিত বন্দুকযুদ্ধ। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটা থেকে ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার, বগুড়ার কাহালু ও কক্সবাজারের মহেশখালীতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে তিনজন নিহত হয়েছেন।

পুলিশ বরাবরই দাবি করে আসছে, এরা প্রত্যেকেই দাগী আসামি। এরা পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। এদের বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলা রয়েছে। সার্বিক বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যারা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে তারা সবাই অপরাধী। সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাবে, এটা স্বাভাবিক ঘটনা। দেশে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী অপরাধীদের মৃত্যুর কারণে দেশে শান্তি ফিরেছে বলেও বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এদিকে, ২০১৬ সাল জুড়ে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১৯৬ জন। যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। ধারাবাহিক ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে র‌্যাবের চেয়ে এগিয়ে পুলিশ বাহিনী। এক সময় বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ‘আলোচিত’ ছিল এলিট ফোর্সখ্যাত র‌্যাব।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর দেওয়া তথ্যমতে, আগের তুলনায় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। ২০১৫ সালে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ১৯২ জন। ২০১৪ সালে ১৫৪ জন। আর ২০১৬ সালে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৬ জনে। এরপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রায়ই বলে থাকেন, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

এ বিষয়ে আসক-এর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, গত কয়েক বছরে কয়েকশ’ মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। দিন দিন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেলে এ হত্যাকাণ্ড কমে আসবে বলেও মত দেন তিনি।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান বলেন, র‌্যাব তার অপারেশনের সময় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে গুলি চালায়। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে ধরতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলি চালায়। তখন জীবন বাঁচাতে তাদেরও পাল্টা গুলি চালাতে হয়। গোলাগুলির একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা নিহত হয়। তিনি বলেন, আমরাও চাই অপরাধীদের ধরতে। তাদের বিচারের আওতায় আনতে। যারা নিহত হয়েছে তারা সবাই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে।

মাত্র দুই ঘণ্টায় নিহত ৩ : গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটায় বগুড়ার কাহালু উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে আবু মুসা ওরফে আবুজার ওরফে আবু তালহা ওরফে রবিন (৩২) নামে এক জঙ্গি নিহত হয়।

পুলিশের দাবি, মুসা নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা এবং নব্য জেএমবির পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার প্রধান সমন্বয়ক। নাটোর ও কুষ্টিয়ার দুটি হত্যাকা-সহ বড় ধরনের নানা জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সে সরাসরি জড়িত ছিল। হলি আর্টিজান হামলার ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া রাজীব গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে সে দায়িত্ব পালন করছিল বলেও জানায় পুলিশ।

একইদিন রাত সাড়ে ৩টায় পুরান ঢাকার চিত্রা সিনেমা হলের গলিতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সাগর (২৮) নামে এক যুবক নিহত হয়। পুলিশের দাবি, সাগর চারটি মামলার চার্জশিটভুক্তসহ ১১ মামলার আসামি। তার স্থায়ী কোনো ঠিকানাও খুঁজে পায়নি পুলিশ।

আর এ দিন ভোর সাড়ে ৪টায় কক্সবাজারের মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের কেরুনতলীর পাহাড়ি এলাকায় পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আবদুস সাত্তার ওরফে সব্বির (৩৫) নামে এক সন্ত্রাসী নিহত হয়। এ ঘটনায় পুলিশের ছয় সদস্যও আহত হন বলেও দাবি করেন মহেশখালী থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস। ওসি জানান, সাত্তার একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অস্ত্র ব্যবসায়ী। মহেশখালী থানায় তার বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ ও অস্ত্র ব্যবসার মতো একাধিক মামলা রয়েছে।

‘বন্দুকযুদ্ধের’ আরো কয়েকটি ঘটনা: নতুন বছরের ৪ জানুয়ারি চাঁদপুরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ডাকাত দলের দুই সদস্য, ৫ জানুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও নব্য জেএমবি নেতা নুরুল ইসলাম মারজান ও তার সহযোগী সাদ্দাম পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। ৮ জানুয়ারি গাজীপুরে একজন, ১১ জানুয়ারি সাভারে একজন, ১০ জানুয়ারি যশোরে একজন ও ১৬ জানুয়ারি পাবনায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজন নিহত হয়।

এরপর ১৮ জানুয়ারি কুষ্টিয়ায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক যুবক ও ২০ জানুয়ারি ফেনীর সোনাগাজীতে এক যুবক নিহত হয়। আর চলতি মাসের ২ ফেব্রুয়ারি রংপুর ও মাগুরায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিন ডাকাত নিহত হয়। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাটে একজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক জন ও বগুড়ায় একজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি বগুড়ায় দুইজন, টেকনাফে একজন ও মুন্সীগঞ্জে ২২ হত্যা মামলার আসামি পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।

প্রতিটি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি ছিল, নিহতরা ডাকাত, জলদস্যু, ইয়াবা পাচারকারী, ছিনতাইকারী, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলার আসামি। তারা পুলিশের তালিকাভুক্ত আসামি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!