• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষিণ এশিয়ার পথে প্রান্তরে


দীপংকর গৌতম সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৭, ১২:৫৬ পিএম
দক্ষিণ এশিয়ার পথে প্রান্তরে

ঢাকা : ভ্রমন সাহিত্য অনেক পুরনো। তারচেয়ে পরনো ভ্রমন লিপ্সুতা।  আমরা হিউয়েন সাঙসহ যেসব পর্যটকদের নাম পাই তা তাদের সময়কালের এক বিস্ময়। পায়ে হেটে অযুত মাইর পার হয়ে যেতে যেতে দেখা কোন ছোটখাটো বিষয় নয়। সেসব পর্যটকদের পথ ধরেই গড়ে উঠেছে ও সময়ের ইতিহাস, প্রত্বতত্ব, নৃবিজ্ঞানের পাঠ। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা যতই গতিশীল হয়েছে দেশ-দেশান্তর মানুষের কাছে এসেছে। একই সাথে মানুষের অনিসন্ধিৎসু মনোবৃত্তি প্রসারিত হয়েছে। তাই ভ্রমনের ব্যাপ্তি বেড়েছে।

চীনা  দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন, মানুষের জ্ঞানের বিকাশে  দুটি বিষয় অপরিহার্য একটি পঠন অন্যটি ভ্রমন। ভ্রমন ছাড়া অন্তর্গত ভেতরের ব্যাপ্তি বাড়ে না। ভ্রমনের সঙ্গে ভ্রমন সাহিত্যের যে প্রওকাশ বেড়েছে তার প্রমান বহন করছে- ‘সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে’  বইটি। ভিন্ন রকমের এক ভ্রমন সাহিত্যিকের দেখা মেলে ভারতের রাহুল সাংকৃত্যায়নের বেশ কিছু বইয়ে, বুদ্ধদেব গুহ’র বনভ্রমন কেন্দ্রিক সাহিত্যও বিশেসত্বের দাবি রাখে। সমরেশ বসুর ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ এক ধরনেসর ভ্রমন সাহিত্যই। কুম্ভ মেলাকে ঘিরে এ ধরনের সাহিত্য আর নেই।

মূলত মুজতবা আলীর ভ্রমন সাহিত্য বিশেষত দেশে বিদেশে পড়ার  নিটোল ভ্রমন সাহিত্য যে কতো ঐশ্বর্যমণ্ডিত তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে ফারুক মঈনউদ্দীনের ভ্রমনের ব্যাপিও— ছোট নয়। লেখার ব্যাপারেআর বর্ননা গতিময়। ফারুক মঈনউদ্দীনের ‘দুধমুখো যেতে যেতে’ পড়ার পর থেকেই তার গদ্য ভাষাটা মোটামুটি রপ্ত করা যায়। তারপর বহুমাত্রিক সাহিত্য তিনি রচনা কররে¥ন সাহিত্য হিসাবে তার এ লেখাটি খুবই গুরুত্ববহ।

দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি  দেশ ভ্রমনের অদ্যোপান্ত লেখা এ বইটতে। ফ্লাপে তার একটি ফিরিস্তিও তিনি দিয়েছেন- ‘দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে ভ্রমনের অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণলব্ধ খন্ড খণ্ড কাহিনী এই গ্রন্থে আছে ভারত, থাইল্যাণ্ড, ভিয়েতনাম, চীন, মালয়েশিয়া এবং ম্যাকাউ-এর এগারটি ভ্রমন গল্প। ভারত মহাসাগরের কোলঘেঁষা গোয়া থেকে মালয় সাগরতীরে মালাক্কা, ভিয়েতনামের হা লং বে থেকে দক্ষিণ চীন সাগরবর্তী দ্বীপ ম্যাকাউ পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গার আকর্ষণীয় বর্ননা, ইতিহাসের অনুপান এবং সুপর্যবেক্ষণের সাথে লেখকের ব্যক্তিগত অনুভ‚তি ভ্রমনপিপাসু পাঠকের ভ্রমনের তৃষ্ণা মেটাতে পারে।’

যতটুকুই মেটাক পাঠক তাতে ঋদ্ধ হবে। ভিয়েতনাম  সম্বন্ধে আমাদের আগ্রহন্রান্য দেশের তুলনায় বেশী। গরীব মানুষের দেশ। ধানই প্রাণশক্তি। সেখানকার সময় শুরু হয় সাম্রাজবাদী আগ্রাসন। কৃষক মজদুরের মধ্য থেকে গড়ে ওঠে গেরিলা যুদ্ধ। হোচিমিনের নেতৃত্বে চলে যুদ্ধ। দিয়েনবিয়েন ফু এর আাক্রমনের মধ্য দিয়ে এই দরিদ্র মানুষের দেশটি জয়ী হয়। ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতা আমাদের বাংলাদেশের সঙ্গে অদ্ভুত রকমে মিলে যায়।দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচীন অঞ্চলের পূর্ব প্রান্তের দেশ ভিয়েতনাম উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ভিয়েতনাম আক্রমণ করে এর কর্তৃত্ব নিলেও ফরাসী ঔপনিবেশিক শাসন তখনও সমাপ্ত হয়নি। তখন জাপান আর ফ্রান্স ক্ষমতা ভাগাভাগি করে এ অঞ্চলে শাসন চালিয়ে যেতে থাকে। চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রবাদপ্রতীম নেতৃত্ব হো চি মিন ১৯৪১ সালের মে মাসে গঠন করেন ‘ভিয়েত মিন’, যার অর্থ হলো ‘ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংঘ’। জাপান ও ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্যই এই সংগঠন গড়ে তোলেন আংকেল হো।

১৯৪৩ সালের শেষ দিকে জাপানের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে ভিয়েত মিন, এর নেতৃত্বে ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসের এক দুর্ধর্ষ সমরনায়ক জেনারেল ভো নগুয়েন গিয়াপ। ১৯৪৫ সালের মার্চে জাপান ভিয়েতনামী বাও দাইকে রাজা বানিয়ে ভিয়েতনামকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে। জাপান ও ফ্রান্সের ক্রমাগত শোষণের ফলস্বরূপ ১৯৪৪-৪৫ সালে ভিয়েতনামে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়, যাতে প্রায় ৪ থেকে ২০ লক্ষ মানুষ কেবল অনাহারেই মৃত্যুবরণ করে। এ দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে, বাড়তে থাকে ভিয়েত মিনের সদস্য সংখ্যা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে, জাপান ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। জাপানের আÍসমর্পণ যখন আসন্ন, সে সময় আগস্টের ১৪ তারিখে ভিয়েত মিন গোটা ভিয়েতনাম জুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দখল নেয়া শুরু করে। ইতিহাসে ‘আগস্ট বিপ্লব’ নামে পরিচিত এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বরে হো চি মিন হ্যানয় শহরে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ভিয়েতনামের নতুন নামকরণ করা হয় ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম’ (ডিআরভি)। বাও দাই ক্ষমতাচ্যুত হয়, ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয় হো চি মিনকে। ভিয়েতনামের এসবক কাহিনী আমাদের জানা। এই জানা কাহিনীর মধ্য থেকেই এক সাহিত্য সন্দর্শন যুক্ত করেছেন লেখক।

 তিনি লিখেছেন-‘ ভিয়েতনামের সংগ্রামী নামের সাথে আশৈশব পরিচিত সুবাদে বহুদিন ধরে দেশটি দেখার লারিত স্বপ্ন পূরন হর সেবার হ্যানয়ে এশিয়ান ব্যাংকার্স সামিটে যোগদানের সুবাদে। ...বেশ কয়েক বছর আগে একজন ফুল ব্রইট স্কলার  ম্যাথিও মোরি  তার গবেষণায় বাংলাদেশ আর ভিয়েতনামের মধ্যে একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছিলেন, তাতে দেশটির সাথে বাংলাদেশের বেশ কিছু সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য দেখানো হয়েছিলো। তবে মুল বক্তব্য ছিলো বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের সাথে  বাংলাদেশের মিল আছে।’ (অবাক নামের ভিয়েতনাম, পৃষ্ঠা-১৩)     
                      
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সাল থেকে চীনের শাং সাম্রাজ্যের (১৬০০ থেকে ১০৪৬ খ্রিস্টপূর্ব)  আমলে লিখিত ও প্রামান্য ইতিহাস পাওয়া যায়। প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ যেমন ‘রেকর্ড অব গ্রান্ড হিস্টোরিয়ান’ (১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) এবং ‘বাম্বু এ্যানালস’ এ সিয়া সাম্রাজ্য এর উলে­খ পাওয়া যায়। সে সময় থেকে শাং সাম্রাজ্যের আমল পর্যন্ত লিখিত কোন দলিল দীর্ঘদিন সংরক্ষন করার কোন উপায় চীনাদের জানা ছিল না। হুয়াংহো নদীকে চৈনিক সভ্যতার সুতিকাগার বলা হয়। হাজার হাজার বছর ধরে হুয়াংহো ও ইয়াংজি নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা অনেক আঞ্চলিক সংস্কৃতি চীনের সভ্যতাকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এ কয়েক হাজার বছরের ধারাবাহিক ইতিহাসে চৈনিক সভ্যতা পৃথিবীর আদিম সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই কারণে চৈনিক সভ্যতাকে মানব সভ্যতার অন্যতম সুতিকাগার বলা হয়।

ঝউ রাজবংশের (১০৪৬ থেকে ২৫৬ খ্রিস্টপূর্ব) আমলে চীনের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও দর্শনের প্রভ‚ত উন্নতি সাধিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী থেকে ঝউ শাসকরা নানা রকম অভ্যন্তরিন ও বাইরের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে শুরু করে এবং এক সময় বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা ’শরৎ’ ও ‘বসন্ত‘ পর্যায় থেকে শুরু হয় এবং ‘আন্তঃরাজ্য যুদ্ধাবস্থা’ এর সময়ে পূর্নরূপ লাভ করে। এই সময়কালটি ছিল চীনের ইতিহাসের অন্যতম ’ব্যর্থ রাষ্ট্রীয় শাসনামল’। এই ব্যর্থ রাষ্ট্রীয় শাসনামলের সর্বশেষ সময়টি ছিল ১৯২৭ সালে চীনের গৃহযুদ্ধের সময়।বহু রাজ্য ও যুদ্ধবাজ নেতাদের শাসনামলে চৈনিক রাজবংশগুলো চীনের একটি অংশ শাসন করত। যার সীমানা বর্তমান জিংজিয়ান এবং তিব্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কিন শি হুয়াং বিভিন্ন যুদ্ধরত রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে কীন বংশের একটি ক্ষুদ্র “সম্রাজ্য” (হুয়াংডি) প্রতিষ্ঠা করে, চৈনিক সম্রাজ্যের ইতিহাসে শুরু করেন।

পরবর্তী রাজবংশগুলো একটি আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল যা ক্রমে তৎকালিন চীনের বিশাল এলাকায় চৈনিক সম্রাটের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। চীনের সর্বশেষ সাম্রাজ্য ছিল কিং সাম্রাজ্য (১৬৪৪ থেকে ১৯১২), যার উচ্ছেদের পর ১৯১২ সালে রিপাবলিক অব চায়না, এবং ১৯৪৯ সালে গনপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হয়।পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব, অভিবাসন, বৈদেশিক বাণিজ্য ও চুক্তি ইত্যাদি আধুনিক চীনের সংস্কৃতি গঠনে ভ‚মিকা পালন করেছে।

চীনের এই প্রচলিত ইতিহাসের সাথে তিনি যে সাহিত্য রস যুক্ত করেছেন তা র কারনে বইটি সুপাঠ্য হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে লেখক লিখেছেন-‘ ছোট বেলায় মহানবীর উপদেশ পড়েছি‘ জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন পর্যন্ত যাও’ তাই বহুদিন ধরে বিশার দেশটিকে এক নজর দেখার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। চীনের বিশালত্বের চাইতে বেশি আলোচিত চীনের জনসংখ্যা। হিসেব করে দেখা গেছে দেশটির সব নাগরিক যদি চারজনের সারি করে এটি গেট পেরিয়ে হেঁটে যেতে বলা হয় তাহলে তাতে সময় লাগবে ত্রিশ বছর।’(সুদূর চীনের এককোনে, পৃষ্ঠা-৬২)

একইভাবে আমরা দেখি মারয়েশিয়া থাইল্যাণ্ড ও ভারতের পতুগীজ স্মৃতি ভাস্বর এরাকা গোয়ার বিবরণ।

লেখকের একটি বর্ননার মধ্য দিযে তার সাহিত্য পিপাসু মনের ঝিলিক টের পাওয়া যায়। ‘গভীর রাতে ঢেউয়ের গর্জনে ঘুম ভেঙে গেলে হোটেলের বারান্দায় এসে বসি।

সামনে অন্ধকার জলরাশি থেকে পাকানো দড়ির মতো গড়িয়ে আসা সাদা  ফেনা যেন প্রবল আক্রোশে ছুটে এসে লুটিযে পড়ছে নিস্পৃহ বালুকা বেলায়, তারপরে পরাজিত মানুষের মতো পিছু হটে মিশে যায় অথৈ জলে। একই দৃশ্য সেই এক ঘেয়ে গর্জন নিকষ কালো অন্ধকারের ভেতর থেকে জেগে থাকা দুয়েকটা মাছধরা নৌকার মিটমিটে আলো- তার ভেতর রাত জাগি চোখে বসে থাকতে থাকতে এক সময় চোখে ঘোর লেগে আসে। সেই ঘোরের মধ্যে হঠাৎ যেন সমুদ্র থেকে উঠে আসে এক মৎস্যকন্যা, তার দীঘৃ বসন সমুদ্রের হাওয়ায উম্মাতাল আন্দোলনে কাঁপে।’(কোঙ্কান কন্যা গোয়া,পৃষ্ঠা-১৬০)
লেখকের এই হৃদয়গ্রাহী বর্ননার মধ্য  দিয়ে পূর্নতা পেয়েছে তার ভ্রমন। সাহিত্য রসে যা নিষিক্ত। বইটির সফল প্রচার ও প্রসার ভ্রমনপিপাসুদের  আগ্রহী করে তুলবে।

সিংহল সমুদ্র
থেকে
মালয় সাগরে

দক্ষিণ এশিয়ার ভ্রমনগল্প
ফারুক মঈনউদ্দীন
প্রকাশক: অবসর
প্রচ্ছদ: এ.টি. আজাদ রানা
মূল্য: ২৭৫ টাকা

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!