ঢাকা : ষাটের দশকেও রাজধানীর খালগুলো মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল। বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-বালু-শীতলক্ষ্যা থেকে সরাসরি এসব খাল ব্যবহার করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করত লোকজন। ওই সময় রাজধানীতে কোনো জলাবদ্ধতা ছিল না, পরিবেশ ছিল স্বাস্থ্যসম্মত।
অর্ধশত বছরের ব্যবধানে খালগুলো দখল-ভরাটে অর্ধেকের বেশি হারিয়ে গেছে। ফলে তীব্র জলজট, জলাবদ্ধতা এবং চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে রাজধানীর সড়কগুলোয়। এই সময়ে দখল আর দূষণে অস্তিত্ব বিলীনের পথে রাজধানীর ছোট-বড় ৫০টি খাল। বেশিরভাগ খালই মাটিচাপা পড়ে গেছে।
এসব খাল দখলে জড়িত রয়েছে নামে বেনামে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, খাল উদ্ধারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, খাল উদ্ধার করা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব, প্রয়োজনে সরকার সহযোগিতা করবে।
পুরো ঢাকার প্রায় অর্ধেক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সঞ্চালন হতো মোহাম্মদপুরের বসিলার এই খাল দিয়ে। একসময় বুড়িগঙ্গা থেকে তুরাগ তীরে সহজে পৌছার মাধ্যম ও ছিল এই খালটি। কিন্তু বর্তমানে এর দুপাশ জুড়ে রয়েছে অবৈধ দখল, যুক্ত হয়েছে দূষণ। দখল আর দূষণের পরে এবার ভরাট করার পালা। সরকারের কোন ধরণের অনুমতি ছাড়াই খালটিকে ভরাট করছে আন্ত:জেলা ট্রাক চালক ইউনিয়ন।
আন্ত:জেলা ট্রাক চালক ইউনিয়নের সভাপতি নসু মিয়া বলেন, 'আমরা গেলো তিন চার মাস যাবত এখানে মাটি ভরাট করে ট্রাক রাখার ব্যবস্থা করছি। ট্রাক রাখার পারমিশন এখনও দেয় নি। তবে বলেছে আপনারা আগে জায়গা ভরাট করেন তারপর দেয়া যাবে।'
বসিলার এ খালটি ভরাট করায় স্থায়ী দুর্ভোগের শঙ্কা এলাকাবাসীর। এলাকাবাসী বলেন, 'যদি খালই আটকে যায় তাহলে তো ঢাকা শহর তলায় যাবে। তখন কেউ কূল কিনারা পাবে না। এজন্য এসব ট্রাক রাখার জন্য একটা ভালো ব্যবস্থা করে এই খাল পুনুরায় খনন করা উচিত।'
জলাশয় আইন থাকলেও বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে না বলে মন্তব্য পরিবেশবাদীদের। বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ান হাসান বলেন, সরকারি বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে বাস ট্রাক মালিক সমিতি পর্যন্ত ভরছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলোর অনুমোদন নেই। সরকারি বাহিনীরা তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে এগুলো করছে।' এসময় তিনি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে প্রশ্ন করে বলেন, সরকার কি আজ পর্যন্ত কোনো জলাশয় আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে?
খাল দখলের বিষয়টি স্বীকার করে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জানান, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধার করা জরুরি, তবে সেক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনকে এগিয়ে আসতে হবে।
স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গা বলেন, যদি কোনো খাল কেউ ভরাট করে দখল করার চেষ্টা করে। এমন অভিযোগ সরকার যদি পায়, তাহলে সরকার অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং একপর্যায়ে গিয়ে এগুলো উদ্ধার হবেই হবে।
পরিবেশবিদদের তথ্যমতে, রাজধানীর খালগুলো পানি নিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। স্বাধীনতার পর ঢাকাকে রাজধানী করায় আস্তে আস্তে জমির দাম বাড়তে থাকে। আর রাজধানীকেন্দ্রিক ব্যবসা-শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় গ্রামবাংলার মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকায় জড়ো হতে থাকে। মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অসাধু প্রভাবশালী মহল রাজধানীর খালগুলো দখল করে গড়ে তুলেছে অট্টালিকা। কেউবা গড়ে তুলেছে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৬০ সালে ঢাকা শহরে জলাশয় ও নিুভূমি ছিল ১৬ হাজার ৪৭৯ দশমিক ৬ হেক্টর, ১৯৮৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৮২১ দশমিক ৩৫ হেক্টর। ২০০৮ সালে জলাধারের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৭৭৫ দশমিক ৯ হেক্টরে। ২০১৩ সালে এর পরিমাণ আরও কমে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩২৫ হেক্টরে। ১৯৬০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ হ্রাসের পরিমাণ ৬২ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে, রাজধানীর ৪৩টি খালের ১৭টির হদিস নেই। বাকি ২৬টি খালের ৫টি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড করে নিয়েছে অসাধু চক্র। এগুলো হচ্ছে : মাণ্ডা, হাজারীবাগ, কসাইবাড়ি ও বাইশ টোকি খাল। বেদখল খাল উদ্ধার করতে নেমে জেলা প্রশাসন ও ওয়াসার কর্মকর্তারা তালিকাভুক্ত এসব খালের অস্তিত্বই খুঁজে পাচ্ছেন না। অন্যদিকে ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাওয়া খালগুলো ফিরে পেতে সরকারের সহায়তা চেয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
খালগুলো দখলের পর অবকাঠামোর এমন পরিবর্তন আনা হয়েছে যে, ওই স্থানে কখনও খাল ছিল তা বোঝার কোনো উপায় নেই। অনুসন্ধানে এবং নগর সংস্থাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজধানীর ৪৩টি খাল দখল করেছে অন্তত ১০ হাজার ৫০০ জন প্রভাবশালী। যাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে এ দখল। ২০১০ সালে নগর সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সরকারি এক তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। ২০১২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন অবৈধ দখলদারদের ধরতে মাঠে নামলেও পরে রহস্যজনক কারণে তদন্ত থেমে যায়।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসন, জরিপ অধিদফতর থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা ছাড়া কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি। বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদে সরকারের পক্ষ থেকে রাজধানীর খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অভিযানও পরিচালনা করা হয়েছিল। প্রভাবশালীদের প্রচণ্ড বাধার কারণে সেই উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়ে যায়। খাল উদ্ধারের নামে গত ৫ বছরে গড়ে ১০ কোটি টাকা করে খরচ করলেও কার্যত কোনো সফলতা আসেনি।
সূত্রমতে, খাল বেদখলে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করতে ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মহানগর জরিপের সময় জরিপ কাজে সংশ্লিষ্ট ২১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খালের জমি দখলের কাজে সহায়তা করেছেন।
শুধু তাই নয়, দখলকৃত কোনো কোনো খালের ওপর ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের পাকাকাঁচা স্থাপনা। তদন্ত রিপোর্টে দখলকারীদের নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য এবং এ কাজে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচয়েরও উল্লেখ করা হয়।
অবিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের ২০০৮ সালের এক জরিপে বলা হয়, রাজধানীতে একসময় ৪৪টি খাল ছিল। যার মধ্যে ৩৫টি খাল শুকিয়ে গেছে। অনেক খাল ভরাট করে সড়ক, ড্রেনেজ লাইন করে ফেলা হয়েছে।
তবে ঢাকা ওয়াসা এবং ঢাকা জেলা প্রশাসনের যৌথ জরিপের তথ্যমতে, খালের সংখ্যা ৪৩। বর্তমানে ২৬টি খাল আছে শুধু তালিকায়, বাস্তবে নেই। ১৩টি খালের প্রস্থ ১০ ফুটের বেশি নয়।
মাণ্ডা ব্রিজ থেকে নন্দীপাড়া পর্যন্ত প্রায় ২৫ জায়গা নতুন করে দখল হয়েছে। এসব জায়গায় গজিয়ে উঠছে টংঘর, দোকান, টিনের চালা ও বস্তি। সেগুনবাগিচা খালের সঙ্গে যুক্ত আড়াই হাজার ফুট দীর্ঘ গোপীবাগ খাল ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। বেগুনবাড়ি খালের ভেতরে গড়ে উঠেছে বিজিএমইএ ভবন। চারটি খালের অংশবিশেষ লেক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ঝিগাতলা-শুক্রাবাদ খালটির ধানমণ্ডি অংশের নাম হয়েছে ধানমণ্ডি লেক। সেগুনবাগিচা খালের নাম হয়েছে রমনা লেক। বেগুনবাড়ি খালের নাম হয়েছে হাতিরঝিল এবং আবদুল্লাহপুর খালের কিছু অংশ নিয়ে হয়েছে উত্তরা লেক। অন্যগুলো পেয়েছে নর্দমার আকৃতি।
জলবায়ু ইন্সটিটিউটের তথ্যমতে, রাজধানীর খালগুলোর সঙ্গে আশপাশের চারটি নদীর সংযোগ ছিল। সূত্রাপুর থেকে লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, মোহাম্মদপুরের বসিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরার-আবদুল্লাহপুর হয়ে তুরাগ, উত্তরখান হয়ে তুরাগ, খিলক্ষেত ডুমনি হয়ে বালু ও মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদ-নদীতে চলাচল করা যেত।
সোনালীনিউজ/জেডআরসি
আপনার মতামত লিখুন :