• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দলীয় কোন্দলই নাসিরনগরে হামলার কারণ


সোনালীনিউজ ডেস্ক নভেম্বর ১২, ২০১৬, ১১:২৩ এএম
দলীয় কোন্দলই নাসিরনগরে হামলার কারণ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা দলীয় কোন্দলের কারণেই সংঘটিত হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের একটি জাতীয় পত্রিকা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, নাসিরনগরের এমপি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হকের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের দ্বন্দ্বের কারণেই এমনটি ঘটেছে। আর হামলার পেছনে ছিলেন মোকতাদির চৌধুরীর সমর্থকরা।

পুলিশ বলছে, হামলাকারী ও ইন্ধনদাতা যেই হোক না কেন তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। নাম আসা কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এদিকে হামলাকারীদের আইনি সহায়তা না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের নেতারা গতকাল শুক্রবার (১১ নভেম্বর) ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে এ ঘোষণা দেন। হামলার নেপথ্য নায়কদের গ্রেপ্তার করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের দাবি জানিয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশর (সিপিবি) নেতারা। নাসিরনগর শহীদ মিনার চত্বরে যুব ইউনিয়ন আয়োজিত সম্প্রীতি সমাবেশে এ দাবি জানান তারা।

তিন দিন বন্ধ থাকার পর বৃহস্পতিবার রাতে বিভিন্ন গ্রামে আবারও অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তার করেছে আরও চারজনকে। হামলার ঘটনায় প্রথম যে আটজনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল, তাদের রিমান্ড শুক্রবার শেষ হয়েছে।

রাজনৈতিক দ্বন্দ্বেই হামলা : স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের বিরোধ দীর্ঘদিনের। উপজেলা আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম পরিচালিত হয় মন্ত্রী ছায়েদুল হকের কথায়। গত মার্চে ইউপি নির্বাচন নিয়ে এ বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। এর জের ধরে ছায়েদুলকে উপদেষ্টার পদ থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করে জেলা আওয়ামী লীগ। বহিষ্কার করা হয় নাসিরনগর উপজেলা সভাপতি রাফি উদ্দিনকেও। নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল গাফ্ফার বলেন, ‘মন্ত্রী সাহেবকে বিপদে ফেলার জন্য এ হামলা।’

অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, হামলার মূল হোতা ছিলেন মোকতাদিরের সমর্থনপুষ্ট হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি। তার এলাকা হরিপুর বাজারে সমবেত হয়ে ট্রাকে করে ১৩ কিলোমিটার দূরে এসে নাসিরনগরের হিন্দুপল্লীতে হামলা চালানো হয়। ইউপি নির্বাচনে জেলা কমিটির আপত্তির মুখে মন্ত্রী ছায়েদুল প্রভাবিত উপজেলা আওয়ামী লীগের দেয়া প্রার্থী তালিকা পরিবর্তিত হয়ে এ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়েছিলেন আঁখি। নাসিরনগরে হামলার পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসম্পাদক ও সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবুল হাসেম, হরিপুর ইউনিয়ন সভাপতি ফারুক মিয়া ও চাপরতলা ইউনিয়ন সভাপতি সুরুজ আলীকে সাময়িক বহিষ্কার করে জেলা আওয়ামী লীগ। অনুসন্ধানে ফারুকের বিষয়ে মিশ্র তথ্য মিললেও হামলায় অন্যদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ, মন্ত্রীর অনুসারী হওয়ায় মোকতাদিরের উদ্যোগে এ নেতাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। হামলার ঘটনায় নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন মোকতাদির চৌধুরী। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের এ সদস্য বলেন, ‘নাসিরনগরে মন্ত্রী মহোদয়ই সব। আঁখির সঙ্গে আমার কোনো যোগ নেই। তাকে যখন মনোনয়ন দেয়া হয়, তখন আমি দেশের বাইরে ছিলাম।’

উপজেলার মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বিরোধের কথা স্বীকার করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুনও। তিনি বলেন, ‘এমপি সাহেব (ছায়েদুল) সেখানে সর্বেসর্বা।’ কেন্দ্র ও জেলা কমিটির কোনো কর্মসূচি তারা পালন করেন না। এমপি উপস্থিত হওয়া ছাড়া কোনো প্রোগ্রাম হয় না।

আঁখির এলাকা থেকে এসে হামলা : হরিপুর থেকে ১৪-১৫টি ট্রাক ভরে মানুষ আসার পর হামলা হয় হিন্দুপল্লীতে। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানিয়েছেন, যেসব ট্রাকে চড়ে হামলাকারীরা এসেছিল সেগুলোর ব্যবস্থা ও অর্থের জোগান চেয়ারম্যান আঁখি দিয়েছিলেন।

জেলা যুবলীগের সাবেক সদস্য আঁখির বর্তমানে কোনো পদ নেই আওয়ামী লীগ বা এর কোনো সহযোগী সংগঠনে। তিনি সমবায় সমিতির মালিক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মদ ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে থাকেন।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নাসিরনগর কলেজ মোড়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের এবং আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে তৌহিদি জনতার ব্যানারে হেফাজতে ইসলাম ও কওমি ওলামা পরিষদের সমাবেশ চলছিল। সোয়া ১২টার পর ট্রাকে চড়ে ‘বহিরাগতরা’ নাসিরনগর সদরে এসে পৌঁছায়। তারা হিন্দুপাড়ার দিকে যেতে থাকলে সমাবেশের একটা অংশও তাদের সঙ্গে মিলে যায়। কলেজ মোড়ের অদূরে দত্তবাড়ির মন্দির থেকে হামলা শুরু হয়। ইউপি নির্বাচনে আঁখির কাছে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন হারানো ফারুক মিয়া বলেন, ঘটনার দিন রোববার মাধবপুর ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে ট্রাক ভাড়া করে সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরের হরিপুর থেকে লোক নিয়ে যাওয়া হয় নাসিরনগর সদরে। মাধবপুর ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে ভাড়ায় দুটি ট্রাক সরবরাহকারী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘অন্তত ১৫টি ট্রাক মাধবপুর থেকে যায়। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে টাকা দেয়া হয়েছিল। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তো আঁখি সাহেব। আমার দুটি ট্রাকের ভাড়া দেয়া হয়েছিল দুই হাজার টাকা করে।’ আঁখির কর্মী দোকানদার জাহাঙ্গীর ও সুজন পাঠান মেটারসাইকেলে গিয়ে ট্রাকগুলো নিয়ে আসেন বলে জানান হরিপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী আমরু মিয়া।

চেয়ারম্যান আঁখির ট্রাক ভাড়ায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন জাহাঙ্গীর ও সুজন। তবে তারা যে আঁখির কর্মী তা স্বীকার করেছেন। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘কারা ট্রাক ধরাইছে আমি জানি না। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো টাকা দেয়া হয়নি।’

হরিপুরের হরিণবেড় বাজারের যে দোকান থেকে রসরাজ দাসের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ধর্ম অবমাননার ছবি পোস্টের খবর পাওয়া যায় তার মালিক জাহাঙ্গীরও আঁখির অনুসারী। ‘আল-আমিন সাইবার ল্যাব ও স্টুডিও’র সামনের দোকানি অমৃত বিশ্বাস বলেন, ‘দোকান মালিক জাহাঙ্গীর বিএনপির রাজনীতি করেন। তবে ইউপি নির্বাচনের সময় আঁখির সঙ্গেই ছিলেন। এখন চেয়ারম্যান আঁখির সঙ্গে তার সখ্য।’

হরিণবেড়ের বাসিন্দা অজয় বর্ধন বলেন, ‘চেয়ারম্যান কালীপূজা দেখতে শনিবার রাতে (হামলার আগের দিন) এলাকায় এসে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন। আমি রাতে না গিয়ে পরদিন সকাল ১০টায় বাড়ি থেকে চলে গেছি।’ আঁখির কথামতো রাত আড়াইটার দিকে পাশের হাছানপুর গ্রামে চলে যাওয়ার কথা জানান গ্রামের শুঁটকি ব্যবসায়ী অতীন্দ্র চন্দ্র দাস। তবে এ বিষয়ে আঁখি বলেন, ‘আমি এলাকা ছেড়ে যেতে বলি নাই। শনিবার রাতে কালীপূজা দেখতে গিয়া তাদের শুধু নিরাপদে থাকতে বলছি।’

স্থানীয় নেতারা জানান, গত মার্চে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচনের সময় উপজেলা আওয়ামী লীগ ১৩ ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে প্রার্থীদের তালিকা কেন্দ্রে পাঠায়। মন্ত্রী ছায়েদুলের পরামর্শে এসব প্রার্থী বাছাই হয় জানিয়ে সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি গাফ্ফার বলেন, এখানে জেলা নেতাদের কোনো কথা না রাখায় বিরোধের শুরু হয়। জেলা কমিটির আপত্তিতে ওই তালিকার মধ্যে হরিপুরে মনোনীত ফারুক মিয়াসহ দুই ইউনিয়নে প্রার্থী পরিবর্তন হয়। পরে হরিপুরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি। জেলা কমিটির নেতাদের বক্তব্য ছিল, ফারুকের বাবা তাজুল ইসলাম ওরফে তাইজুদ্দিন একাত্তরে রাজাকার হিসেবে যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত ছিলেন। আর মন্ত্রী ছায়েদুল হক একক সিদ্ধান্তে একজন ‘রাজাকারপুত্রকে’ দলের মনোনয়ন দিচ্ছেন।

এ নিয়ে সে সময় মিছিল-সমাবেশও হয়। তবে উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি কাজলজ্যোতি দত্ত বলেন, ‘একজনকে সরিয়ে আরেকজনকে দিয়েছে- দু’জনেরই তো প্রায় একই রকম অবস্থা। একজন রাজাকারের ছেলে, আরেকজন নাতি।’ আঁখির দাদার ভাই দরবেশ মিয়া রাজাকার ছিলেন বলে জানান ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলা সভাপতি জয়তুল হোসেন।

হামলার ইন্ধনদাতা হিসেবে নাসিরনগর উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এটিএম মনিরুজ্জামান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আবদুল আহাদ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উপজেলা সভাপতি আদেশচন্দ্র দেব এবং জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী বিউটি কানিজ সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন স্থানীয় নেতাদের।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!