• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
বিদেশে অপহরণ দেশে মুক্তিপণ!

দালাল ভয়ংকর, আতঙ্কে প্রবাসীরা!


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ২০, ২০১৭, ০৩:০৮ পিএম
দালাল ভয়ংকর, আতঙ্কে প্রবাসীরা!

স্বপ্ন ছিল বিদেশ গিয়ে ছোট বোনকে ‘ভালো ঘরে’ বিয়ে দেবেন। সুযোগ বুঝে ছোট ভাইকেও বিদেশে তার কাছে নেবেন। দুই ভাই মিলে বৃদ্ধ মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবেন। তাই সুদের ওপর এক লাখ টাকা ধার করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার শাহবাজপুর ইউনিয়নের আবদুল হাকিম (ছদ্মনাম)। 

সেই টাকা তুলে দেন স্থানীয় এক দালালের হাতে। দালালের কথা অনুযায়ী, হাকিমের বেতন হবে প্রায় ৩০ হাজার টাকা, সঙ্গে থাকা-খাওয়া ফ্রি। কিন্তু বিদেশের মাটিতে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই আবদুল হাকিমের সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার।

মালয়েশিয়ায় প্রবেশের প্রথমদিনেই আবদুল হাকিম বুঝতে পারেন, তিনিসহ ১৩-১৫ জন বাংলাদেশি ভয়ঙ্কর ফাঁদে পা দিয়েছেন। বিমানবন্দরে নামার পরপরই দেশি-বিদেশি দালালরা তাদের একটি দুর্গম বনাঞ্চলে নিয়ে আটকে রাখে। সেখানে তাদের দিনে একবার খেতে দেওয়া হয়। অনাহারে-অর্ধাহারে এভাবে কেটে যায় ৫ দিন। 

বন্দিদশার ৬ষ্ঠদিনে হাকিমকে আলাদা একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ফোনে তাকে বাংলাদেশে থাকা পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয় দালালরা। এ সময় তারা হাকিমের পরিবারের কাছে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণও চায়। এরপর মুক্তিপণের বিষয়ে আর কিছুই জানে না হাকিম। শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্মম অত্যাচারের ১১ দিন পর তাকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারী চক্র। পরে তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফেরেন। 

দেশে এসে আবদুল হাকিম জানতে পারেন, তাকে উদ্ধার করতে পরিবারকে গুনতে হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। আর সেই টাকার যোগান হয়েছে তাদের ভিটেবাড়ি বিক্রি করে। তবে বিদেশে অপহৃতদের অনেকে মুক্তি পেলেও কারো কারো কপালে বেঁচে ফেরা সম্ভব হয় না। মুক্তিপণ না পেলে অপহরণকারীদের হাতে নির্মম অত্যাচারে প্রাণ হারান অনেকে।

শুধু আবদুল হাকিম নয়, গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের তৈয়ব মোল্লা (২০) ও তার ভগ্নিপতি আজিজুর রহমান মোল্লা (৪৮) কানাডায় যাওয়ার জন্য স্থানীয় এক দালালের হাতে তুলে দেন ১৮ লাখ টাকা। নির্দিষ্ট দিনে তারা উড়াল দেন কানাডার উদ্দেশে। কিন্তু ৩ দিন পর দক্ষিণ আফ্রিকার এক জঙ্গল থেকে তারা ফোনে পরিবারকে জানান, গভীর জঙ্গলের ভেতর একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে তাদের। ১০ লাখ টাকা না দিলে তাদের মুক্তি মিলবে না। 

একই বছরের ২৩ জুলাই রাজধানীর দক্ষিণখানের ব্যবসায়ী ফয়েজ আহমেদ ব্যবসার কাজে মালয়েশিয়া যাওয়ার পর অপহরণকারীদের খপ্পরে পড়েন। অপহরণকারীরা তার মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করে এক কোটি টাকা। টাকা দিতে দেরি হওয়ায় নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তিনি। পরে এ ঘটনায় দেশে মুক্তিপণ নিতে গিয়ে মা-ছেলেসহ অপহরণ চক্রের ৭ সদস্য র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। 

এর আগে ২০১২ সালে লিবিয়ায় গিয়ে একইভাবে অপহরণকারীদের হাতে বন্দি হন চাঁদপুরের ফয়েজ উল্লাহ ও নাটোরের মন্টু মিয়া। পরে মুক্তিপণ দিয়ে বেঁচে ফেরেন তারা।

গত ২ জানুয়ারি নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি লিবিয়ায় তার ছোট বোনের স্বামী সুমনকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা জানিয়ে র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে অভিযোগ করেন। তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে তারা বোন জামাইয়ের মুক্তিপণ হিসেবে সাড়ে ৪ চার লাখ টাকা দিয়েছেন। তারপরও জামাইকে মুক্তি না দিয়ে অপহরণকারীরা আরো দেড় লাখ টাকা দাবি করে। অভিযোগ পেয়ে তদন্ত নামে র‌্যাব। একপর্যায়ে রাজধানীর বারিধারার মোস্তফা হোটেল অ্যান্ড

রেস্টুরেন্টে মুক্তিপণের টাকা নিতে আসা মূল হোতা মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান (৪৫), সহযোগী শফিকুল ইসলাম ও মাসুম আহমেদকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপর তাদের দেওয়া তথ্যে, অপহরণে জড়িত আরো ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। আর দূতাবাসের সহায়তায় লিবিয়ায় অপহৃত সুমনকেও উদ্ধার করা হয়। সুমনকে গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে আনা হয়।

র‌্যাব জানায়, সুমনকে লিবিয়ায় অপহরণের ঘটনায় জড়িত ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী ও জিম্মিকারী চক্রের সদস্য। তাদের কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক পাসপোর্ট, বিভিন্ন দেশের জাল ভিসা, ভিসা তৈরির সামগ্রী এবং বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রাসহ প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ জব্দ করা হয়। 

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অপহরণকারীরা জানায়, জনশক্তি রফতানির বৈধ কোনো কাগজপত্র ছাড়াই তারা বিদেশে লোক পাঠিয়ে আসছিল। তারা বিমান, স্থল ও নৌপথে চীন ভারত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য, ইতালি, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশে মানবপাচার করে আসছে। এজেন্টের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক লোক সংগ্রহ করত। স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে বিদেশে গমনের প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করা হতো। 

পরে বিদেশগামীদের দেশি-বিদেশি এজেন্ট ও দেশীয় এয়ারপোর্টে দায়িত্বরত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে ইমিগ্রেশন পার করানো হয়। বিদেশে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের দুর্গম এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর মুক্তিপণের টাকা আদায়ে পরিবারকে ফোন দেওয়া হয়। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে চলছে দেশি-বিদেশি অপহরণকারী চক্রের দালালদের খপ্পড়ে পড়ে এভাবেই সর্বস্ব খুইয়ে যাচ্ছেন বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর অসংখ্য যুবক। নিরীহ যুবকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র সক্রিয়।

এভাবে বিদেশে অপহরণ করে দেশে বসে আরেকটি চক্রের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। এদের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। ইমিগ্রেশন পুলিশ এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ ধরনের অপরাধের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, এ ধরনের অপহরণের ঘটনা তুরস্ক, ইরাক, ইরান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ঘটছে। 

এছাড়া লিবিয়া, সিরিয়া ও সুদানেও এ ধরনের চক্র সক্রিয় রয়েছে। তাই ৮-১০টি দেশকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কয়েকটি দেশের সাথে বাংলাদেশ পুলিশের সফল তথ্য বিনিময়ের পর সেসব দেশে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে বিভিন্ন কারণে কয়েকটি দেশ এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। 

এ ক্ষেত্রে অবৈধভাবে বিদেশ না যাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল বিরাজ করছে- এমন দেশ পরিহার করা এবং বিদেশে যাওয়ার পর বিচ্ছিন্ন না থেকে প্রবাসী শ্রমিকদের একসঙ্গে থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকি জানান, বিদেশের মাটিতে এ পর্যন্ত অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক ও ব্যবসায়ী অপহরণের শিকার হয়েছেন। সংঘবদ্ধ এ চক্রটি তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে বাংলাদেশে অপহৃতের স্বজনদের কাছ থেকে নানা কৌশলে মুক্তিপণও আদায় করছে। অনেকে অপহৃতের জীবনের ঝুঁকি ভেবে ঘটনাটি সঠিক সময়ে পুলিশকে জানাতে চান না। তবে পুলিশ জানার পর একাধিক ঘটনায় বিদেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সে দেশের দূতাবাসের সহায়তায় অপহৃতকে উদ্ধারও করেছে। 

তিনি আরো জানান, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি অপহরণের বেশকিছু ঘটনার অভিযোগ পাওয়ার পর ইরান, তুরস্ক ও দক্ষিণ আফ্রিকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে একাধিকবার মিটিং হয়েছে। তারাও বেশ আন্তরিকতা ও গুরুত্বের সাথে ঘটনার তদন্ত করে ওইসব দেশে চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছেন। এরপর থেকে ওইসব দেশগুলোতে এধরনের অপরাধ অনেকাংশে কমে গেছে।

তবে ইমিগ্রেশন পুলিশ ও সিআইডির একটি সূত্র জানায়, মালয়েশিয়া, সুদান, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকে এ অপরাধী চক্রটিকে পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি। কারণ হিসেবে সূত্রটি জানায়, মালয়শিয়ার কিছু দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ সদস্যের অসহযোগিতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। 

অন্যদিকে লিবিয়া ও ইরাকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীল থাকায় সেখানেও এ বিষয়ে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল সেসব দেশেই এসব চক্র বেশি সক্রিয়। তাই ওইসব দেশে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

আবদুল্লাহেল বাকি আরো জানান, দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু অপরাধীর সখ্য গড়ে উঠে। তাই দেশি-বিদেশি অপরাধী চক্র এক হয়ে অপহরণ চক্রে জড়িয়ে পড়ছে। আবার দেখা যায়, ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের অধিকাংশই অবৈধভাবে বিদেশে যান। তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নেয় অপহরণকারীরা।

অপহৃত হওয়ার পর তাদেরকে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি ভয় দেখানো হয় যে, মুক্তিপণের টাকা না দিলে তাদের পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়া হবে। তাই বাধ্য হয়েই তারা মুক্তিপণ দিচ্ছেন। তাই এ সংক্রান্ত অপরাধী চক্র থেকে বাঁচতে অবৈধপথে বিদেশে পাড়ি না জমানোরও পরামর্শ দেন তিনি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!