• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দিনে ‘মা’, সন্ধ্যা নামলেই ‘মোহিনী’


আন্তর্জাতিক ডেস্ক জুন ২৭, ২০১৬, ০৩:৫৯ পিএম
দিনে ‘মা’, সন্ধ্যা নামলেই ‘মোহিনী’

আমার ছেলেবেলাটা কেটেছে নিষিদ্ধপল্লির আবহে। তবে তখনও পর্যন্ত ওই পল্লিকে ‘নিষিদ্ধ’ বোঝার বয়স হয়নি। মফস্বল শহর চন্দননগরে জিটি রোডের ওই অংশের পোশাকি নাম কানাইলাল অ্যাভিনিউ। কাছেই স্বাধীনতাসংগ্রামী শহিদ কানাইলাল দত্তের জন্মস্থান। তবে সবাই চিনত ‘খেজুরতলা’ নামে। সেটা এখন অতীত। এক গোলমালের দিনে গোটা পল্লীসহ সেই সাবেক নামটাও বিদায় নিয়েছে একদা ফরাসি উপনিবেশ ‘ফরাসডাঙা’ চন্দননগর থেকে।
তবে আমার স্মৃতি জুড়ে রয়ে গেছে সেই মায়েদের কথা। যে মায়েদের সমাজ পতিত করতে চাইলেও সংস্কার পতিত করতে পারেনি আজও। ওই মায়ের দ্বার-মাটি না পেলে যে দশভূজা মায়ের পূজাই হয় না!
‘ওরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে কেন‌? ওদের ঘর-বাড়ি ভাঙা? অত সাজগোজ করে কেন?’ শিশু থেকে বালক হয়ে ওঠা মনে এইসব স্বাভাবিক প্রশ্ন জমা হত। যার সদুত্তর না পাওয়ায় কৌতূহল আরও বেড়ে যেত। তবে কানে শুনতাম, ওদের ‘রাস্তার মেয়েছেলে’ বলে। ওরা ‘বেশ্যা’, ‘পতিতা’। আর পাঁচজনের তুলনায় অনেক ছোটবেলায় এই শব্দগুলো শিখে গিয়েছিলাম আমরা, যারা ওইখানে বড় হয়েছি। তবে এরই মধ্যে কে যেন শিখিয়েছিলেন ওরা ‘রাস্তার মা’। বেশ পছন্দ হয়েছিল নামটা। কখনও উচ্চারণ না করলেও মনে মনে ডেকেছি অনেকবার।
জিটি রোডের দু‍’পাশে সারি সারি বাড়ি। একের পরে এক গলি। প্রথম যে ‘গৃহস্থ গলি’ শুরু হল, তারই ভিতরে ছিল আমাদের বাস। অনেক বাড়িতেই দেখেছি দরজায় লেখা ‘গৃহস্থ বাড়ি’। কিন্তু অনেকেই জানে না, ‘গৃহস্থ বাড়ি’ তকমা দিয়ে যেমন সব আড়াল করা যেত না, তেমনই ওই ‘পতিত’ বাড়ির ভিতরেও থাকত একটা ‘গৃহস্থ’ সংসার।
পতিতাপল্লী নামটাতেও আমার বড় আপত্তি। যেমনভাবে আপত্তি সাহেবদের ‘Sex Worker’ শব্দের তর্জমা— ‘যৌনকর্মী’। আমাদের ভাষা তো অত কৃপণ নয়! পণ্যশ্রী, বেশবধূ, নগরনটী, বারাঙ্গনা, দিব্যাঙ্গনা, গণিকা ইত্যাদি আরও অনেক নামেই ডাকা যেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি।
আমাদের সমাজ, সংস্কৃতিও অত কৃপণ নয়। নিজের ভূখণ্ডের মধ্যে স্থায়ী বেশ্যালয় নির্মাণ বাঙালি জমিদার সমাজে একটা সময় পর্যন্ত অত্যন্ত গৌরবের বিষয় ছিল। বারাঙ্গনাদের জন্য বরাদ্দ জমি হত নিষ্কর। সে জমি সাধারণত জমিদারের নিজস্ব খাস জমি থেকেই দেওয়া হত, যার কোনও খাজনা নেই। কলকাতা শহরেও পুরনারীদের জন্য জমি-বাড়ি বিলিবন্টনের অনেক নজির রয়েছে। এখনও অনেকে সেই বাড়ির ভোগ-দখল করছেন। সবমিলিয়ে বারাঙ্গনারা কোনওভাবেই ব্রাত্য ছিলেন না। পতিত ছিলেন না।
আমাদের সংস্কৃতির মধ্যেও নগরনটীদের সম্মানজনক স্থান ছিল। এখন আর থাকে না, তবে এক সময়ে পঞ্জিকায় শুভযাত্রার সময় নির্ধারণ করতে ‘যাত্রামঙ্গল’ স্ত্রোত্র থাকত—
ধেনুর্বৎস প্রযুক্তা
বৃষ গজ তুরগা
দিব্যস্ত্রী পূর্ণ কুম্ভ
দ্বিজ, নৃপ, গণিকা
পুষ্পমালা পতাকাঃ।
যার অর্থ দাঁড়াল, ব্রাহ্মণ ও রাজার পরেই গণিকার স্থান। তবে আর তিনি পতিতা কী করে হলেন! কেন তবে তাদের ‘পতিতা’ বলতে হবে?
আসলে বলতে হয় কারণ, জমিদারের কাছে রক্ষিতার আদর থাকলেও রক্ষিতা-সন্তানের আদর সবসময়ে ততটা থাকত না। পিতৃপরিচয় জুটতো না। তাই ‘মা’-এর কষ্টটা থেকেই যেত। পুরোপুরি ‘মা’ হয়ে ওঠা হত না। আবার এমন উদাহরণ রয়েছে যেখানে, জমিদারের অবর্তমানে স্বীকৃত-পুত্র রক্ষিতা মাকে শেষ বয়সে কাশীবাসের ব্যবস্থা করে দিতেন। পাকা দালান তো বটেই, সেই সঙ্গে মাসোহারাও।
সবাই যে মা হতে পারতেন বা পারেন সেটাও তো ঠিক নয়। কিন্তু মা হ‌ওয়ার একটা আকুল আততি যে কাজ করত এবং করে, তা অস্বীকার করা যাবে না। সাহিত্যেই আমরা পড়েছি, কালীঘাটের সেই বেবুশ্যে মায়ের কথা,  যিনি গঙ্গার পার থেকে কুড়িয়ে এনেছিলেন এক সাহেব ছেলেকে। আসল বাবা-মা যাকে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে লোকলজ্জার ভয়ে। শুধু ‘মা’ ডাক শুনবেন বলে খেজুরতলার পল্লির ঘরে আমি দেখেছি সন্তান কামনায় ‘রাস্তার মা’ গোপাল ঠাকুরের নিত্যপুজো করছেন। সন্তানস্নেহে ঘাটতি থাকত না। সুবিধাও ছিল। গোপাল ছেলের ‘পিতৃ-পরি‌চয়’ লাগে না।
একটা সময় পর্যন্ত, গণিকাপল্লিতে কনডমের ব্যবহার ছিল না। তাই মা হতে চাইলে সেটা খুব অসম্ভবও ছিল না। ওই মেয়েরা জানতেন কী করে মা হওয়া যায় বা ইচ্ছা করে আটকানো যায়। কিন্তু অপেক্ষা করতেন। সন্তানের জন্য ভাল বাবা চাই যে! মা মনটা বলত রক্তে মাংসে গড়া সেই আত্মজ যেন মানুষ হয়। ভদ্র মানুষ। লেখাপড়া জানা মানুষ। একটু ‘ভাল’ রক্তের জন্য চলত মা হওয়ার অপেক্ষা। একটু অন্য রকম কাস্টমার-এর অপেক্ষা করতেন। আজও নিশ্চয়ই সেই অপেক্ষা চলতে থাকে। মা হওয়ার আশায় রক্তক্ষয় চলতে থাকে।
এই মায়েদের কথাই সম্ভবত লিখেছিলেন কবি সুজাতা গঙ্গোপাধ্যায়—
দীর্ঘ, বড় দীর্ঘ ছিল দিন
রুক্ষ, বড় রুক্ষ ছিল পথ...
তবুও তোকে আনতে গিয়ে একা
সয়েছি কত রক্ত ঝরা ক্ষত...
আর সন্তান হলে তার জ্বালা কি কম! সন্ধের সময়টা রোজগারের সময়। তার আগে ‘মা‍’ রূপ ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে হবে। সাজে-গোজে মাতৃত্বের গন্ধ সরিয়ে ‘কামিনী’ হয়ে উঠতে হবে। সব মায়ের এক চিন্তা। বাচ্চাগুলোকে সারা দুপুর জাগিয়ে রাখতে হবে। সন্ধ‌ের আগে পেট ভরিয়ে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে তবে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে। প্রতিদিনের মতো বউনির আগে প্রথা মেনে এক মুখ থুতু ফেলতে হবে রাস্তায়। আসলে সেটা নিজ‌ের পেশার গায়েই। কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়েও মনটা পড়ে থাকবে রান্নাঘরে। সেই এক চিলতে জায়গাটাতেই তো মশারি ঢাকায় শোয়ানো আছে ‘প্রাণের সোনা‍’কে। কাস্টমার-এর শরীরের নিচে অভ্যাসের শিৎকারের মধ্যেও মনটা পড়ে থাকে অন্য জায়গায়— ‘খিদে পায়নি তো সোনাটার! ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে হঠাৎ কেঁদে উঠবে না তো!’
লাল রঙের পৃথিবীতে যাঁরা মা হন, তাদের শতেক জ্বালা। কাস্টমার যদি হঠাৎ কান্নাকাটি শুনে বিগড়ে যায়! আবার অনেকে বাচ্চাকে আদর করে হাতে এটা সেটা দিয়েও যায়। এসব চিন্তা নিয়ে সারাটা দিন কেটে যায় কিন্তু, ভয় করে সন্ধে নামলেই— ‘জ্বরজারি, পেটের গোলমাল কিছু যেন না হয় ঠাকুর।’ সন্ধ‌েটা মাটি হলে রোজগার বন্ধ।
এত কিছুর পরেও কিন্তু সন্তান-সুখ চিরস্থায়ী হয় না। ‘নিষিদ্ধ’ পল্লীর সন্তানকে যে ‘নিষিদ্ধ-পৃথিবী’ হাতছানি দেয়। মেয়ে হলে মায়ের পেশা আর ছেলে হলে অন্য অনেক পথ। ‘ভাল’ রক্তের জোর খাটে না খারাপ পরিবেশের সঙ্গে। তাই সংসার করেও সংসার করা হয় না। মেকি হয়ে যায় সবটা। দাপটে যৌবন কাটানো ৩৩ নম্বরের সুধারানী একদিন পথের ভিখারিনী হয়ে যান।
এক ‘রাস্তার মা’-এর মুখেই  বলতে শুনেছিলাম, ‘এই পৃথিবীতে চিরকালই কোনও মানুষ সংসারের ভেতরে থাকে, কোনও মানুষ সংসারের বাইরে। আমরা চিরকালের বাইরের মানুষ। জানলা দিয়ে উঁকি মেরেই আমাদের সংসার দেখা।’
এখনও খেজুরতলার ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মনে পড়ে সেইসব মায়েদের মুখ, যারা আমাদের ‘ভদ্র বাড়ির ছেলে’ বলে সমাদর করতেন। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি দেখে, বন্ধ করে দিতেন খরিদ্দারের সঙ্গে দরাদরি। স্টুডেন্টস হেলথ হোমের চাঁদার পাতা সবাই মিলে দল বেঁধে ভরিয়ে দিতেন। নাম লিখতাম, মালতীদেবী, বিমলাদেবী, মাধুরীদেবী...
ওই দেবীদের নিয়ে কবি পিনাকী ঠাকুরের একটা কবিতা দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল মনে আছে। ড্রেসকো দোকানের দেওয়ালে হেলান দেওয়া মায়েদের নিয়ে।
কবিতাটার নাম ছিল— ‘চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী’। গল্পটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এএম

Wordbridge School
Link copied!