• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দীর্ঘ হচ্ছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সারি


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৬, ০৪:৪৭ পিএম
দীর্ঘ হচ্ছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সারি

বিশেষ প্রতিনিধি

বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, মেয়েদের জন্যে উপ-বৃত্তি, ইংরেজি ও গণিতের অতিরিক্ত ক্লাস—এর কোনও কিছু দিয়েই ঝরে পড়া বন্ধ করা যাচ্ছে না। বরং দীর্ঘ হচ্ছে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের তালিকা। ২০১০ সালের প্রাথমিক সমাপনী ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৫ বছরের শিক্ষাজীবন শেষে চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এসে ঝরে পড়েছে ১০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। প্রাথমিক সমাপনী ও সমমানের পরীক্ষা থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা পর্যন্ত পৌঁছনো সময় পর্যন্ত শিক্ষার্থী কমার এই হার পরিমাণ আশঙ্কাজনক।

এভাবে ঝরে পড়ার জন্য শিক্ষাখাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ স্বল্পতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এবং নিম্নমানের শিক্ষাকে দায়ী করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। আর শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একে উল্লেখ করছেন শিক্ষাব্যবস্থার রূঢ় বাস্তবতা বলে।

পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী  সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) সারাদেশের দশটি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এক যোগে শুরু হচ্ছে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এসএসসি), এসএসসি ভোকেশনাল এবং দাখিল সমাপনী পরীক্ষা। নিয়মিত-নিয়মিত মিলিয়ে এবার মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৫১ হাজার ৫২৩। রবিবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটি জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি আরও জানান, তাদের মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৭ জন।

হিসাব অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের এই ব্যাচটি ২০১০ সালে অংশ নিয়েছিল প্রাথমিক ও এবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায়। ওই বছর নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের সংখ্যাছিল ২৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৮ জন। দেখা যাচ্ছে, পাঁচ বছরের দৌঁড় শেষে মাধ্যমিক, ভোকেশনাল ও দাখিল সমাপনী পরীক্ষা পর্যন্ত পৌঁছতে-পৌঁছতে তাদের মধ্য থেকে ঝরে পড়েছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ শিক্ষার্থী।

অথচ, শিক্ষার্থীদের এই ঝরেপড়া বন্ধে সরকার অনেক আগে থেকেই বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে। মেয়েদের জন্যে উপবৃত্তি অব্যাহত রেখেছে। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় দেশের ৬১টি জেলার পিছিয়ে পড়া ১২৫টি উপজেলার ৫৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের প্রতি ভীতি দূর করতে অতিরিক্ত ক্লাস পরিচালনা করা হচ্ছে। এমনকি শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া আটকাতে বর্তমান সরকার আগের মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরপরই শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক ও এবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা শুরু করেছে। কিন্তু এর কোনও কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া। বরং দীর্ঘ হচ্ছে ঝরে পড়াদের মিছিল।

সরকারের দেয়া হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায় ২০১০ সালের প্রাথমিক ও এবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় মোট নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুপস্থিত এবং অকৃতকার্যের সংখ্যা ছিল চার লাখ ৭২ হাজার ৩৫২ জন। সে হিসেবে ওই বছরে পাস করেছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ১৩ হাজার ৯৬৬ জন এবং তাদের প্রত্যেকে মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করেছে এমনটি ধরে নেয়া হলেও ২০১৩ সালে অষ্টম শ্রেণিতে অনুষ্ঠিত জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় তাদের মধ্যে থেকে অংশ নেয়নি এক লাখ ৫১ হাজার ৫৮৬। অকৃতকার্য হয়েছে এক লাখ ৮৭ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ, ওই স্তরে পাস করেছিল এমন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ১০৯ জন। যাদের প্রত্যেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ভোকেশনাল ও দাখিল সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেবে এমনটি ধরে নেয়া হলেও এ স্তরে এসে তাদের সংখ্যা ঠেকেছে ১৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৭ জনে। অর্থাৎ, আবারও ঝরে পড়ল দুই লাখ ১৮২ জন।

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত ও অবকাঠামোগত দুর্বলতাকে দায়ী করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার কারণ অনেকটাই আলাদা। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা প্রাক-প্রাথমিকের মধ্যে দিয়ে না আসার কারণে তাদের অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলে, আনন্দটা পেয়ে ওঠে না। তাই প্রাথমিকেই অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। অন্যদিকে, মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার মূল কারণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক। দেখা যাচ্ছে, মাধ্যমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ মেয়ে। যারা বাল্যবিয়ে ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ছিটকে পড়ছে। আর ছেলেরা যোগ দিচ্ছে কাজে। কারণ পড়া-লেখার চেয়ে কোনও কর্মে যোগ দেয়াটাই তাদের কাছে লাভজন বলে মনে হচ্ছে।

এছাড়া, শহরের বাইরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণেও শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে বলে মনে করছেন রাশেদা কে চৌধুরী। তাই ঝরে পড়া আটকাতে হলে গতানুগতিক চিন্তা দিয়ে নয় বরং সরকারকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে এবং শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, যেখানে শিক্ষা খাতে জিডিপি’র চার শতাংশ বিনিয়োগ থাকা উচিত। সেখানে বর্তমানে রয়েছে মাত্র দুই দশমিক দুই শতাংশ। শিক্ষার্থীদের সংখ্যার অনুপাতে তা অপ্রতুল বলেই মনে করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা।

আর শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একে অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবেই দেখছেন। তিনি বলেন, শিক্ষা সুযোগ এখন আর বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, বেতন মওকুফ এবং উপ-বৃত্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। শিক্ষা উপকরণ থেকে শুরু করে প্রাইভেট কোচিং, গাইড বই সবকিছু  মিলিয়ে শিক্ষা এখন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। অনেকের পক্ষেই যা বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।  তিনি আরও বলেন, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে অজ্ঞতা বা বোধের অভাব। এছাড়া বোধটা তৈরি করাও সম্ভব হয়নি। কারণ লেখাপড়ার সঙ্গে জীবিকারও সম্পর্ক নেই। লেখাপড়া দিয়ে বেকারত্ব দূর হবে এমনটিও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে সমস্যাটাই অর্থনৈতিক। কিন্তু এই সমস্যার মূলে যেতে চায় না সরকার। এত শিক্ষার্থী কোথায় হারিয়ে গেল? কেন হারিয়ে গেল, তাও বুঝতে চায় না। বরং সরকার হই হুল্লোড় করছে জিপিএ-৫ নিয়ে।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে প্রাথমিক ও এবতেদায়ি সমাপনীতে পাসের হার ছিল যথাক্রমে ৯২ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ৮৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় চার শতাংশ বেশি। একই ভাবে ২০১৩ সালের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল যথাক্রমে ৮৯ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ৯১ দশমিক ১১ শতাংশ। বলা হয়েছিল ওই বছরে পাসের হার, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এবং শতভাগ পাস করা স্কুলের সংখ্যায় অর্থাৎ তিনটি সূচকেই আগের বছরের তুলনায় বেশি ছিল।

সোনালীনিউজ/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!