• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুই হাত হারানো শাহাকুলের হার না মানার গল্প


মেহেরপুর প্রতিনিধি ডিসেম্বর ৩, ২০১৬, ০২:৫২ পিএম
দুই হাত হারানো শাহাকুলের হার না মানার গল্প

মেহেরপুর : প্রতিবন্ধী মানেই অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকা নয়, পরিবার কিংবা সমাজের বোঝাও নয়। আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে দান-দক্ষিণার জন্য অন্যের দুয়ারে দুয়ারে ছুটে চলা স্বাভাবিক পন্থা। কিন্তু এর ব্যতিক্রম কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অনেকেই এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছেন। তাদেরই একজন মেহেরপুর সদর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের শাহাকুল ইসলাম। আত্মমর্যাদা বোধ থেকেই ভিক্ষাবৃত্তি ও পরনির্ভরশীলতার বিপরীত স্রোতের যাত্রী তিনি। শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ- দুটি হাত হারালেও আত্মশক্তিতে বলিয়ান। সামান্য একটি ছাগল খামার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রোজগারের রাস্তা তৈরি করেছেন। এ যেন দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের এক আলোক মশাল। জীবনের চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও হার মানেননি শাহাকুল। একমাত্র মানসিক শক্তি দিয়েই প্রতিকুলতা জয় করার চেষ্টা করছেন। শোনালেন জীবনের চরম বাস্তব দুর্বিসহ অভিজ্ঞতার কথা।

শাহাকুল ইসলাম জানান, তার বয়স যখন ১১ বছর, তখন মাঠে ছাগল চরাতে গিয়ে একটি বৈদ্যুতিক খুটির স্পর্শে বিদ্যুতায়িত হন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাতের বিভিন্ন অংশ পচন ধরায় তার দুই হাতই কেটে ফেলতে হয়। চিকিৎসার জন্য পরিবারকে গুণতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। অভাবের সংসারে আদরের শিশু পুত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে বাবা জামাত আলী আর মা বুলুজান খাতুন। তাদের কষ্টের কথা ভেবে অনেকেই শাহাকুলকে ভিক্ষাবৃত্তির পরামর্শ দেয়। কিন্তু বাধ সাধে আত্মমর্যাদাবোধ। না, ভিক্ষাবৃত্তি ভাল নয়, কারো অনুগ্রহ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। বলছিলেন শাহাকুল।

তিনি আরও বলেন, নদীর বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতই একের পর এক সমস্যা সামনে এসে দাঁড়াচ্ছিল। ধারদেনা পরিশোধ তো দূরের কথা সংসারের নিত্যকার খরচই জোগানের মত অবস্থা ছিল না পিতা-মাতার। দুই হাত হারানো শাহাকুলতো কাজ করতে পারবে না। তাকে কেউ কাজও দিবে না। তাই বলে কি আর থেমে থাকা যায়? চিকিৎসাজনিত চরম বাস্তবতা মোকাবেলার পর দারিদ্র্যতা ঘোচানের চরম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিবন্ধী শাহাকুল। পরিবারের শেষ সম্বল থেকে ৫টি ছাগল কিনে পরিবর্তনের যাত্রা শুরু। গ্রামের পার্শ্ববর্তী মাঠে ছাগল চরানোর পাশাপাশি তার সার্বক্ষণিক দেখভালের কাজ করেন তিনি। লালন-পালনের মধ্য দিয়ে বাড়তে থাকে ছাগলের সংখ্যা। কয়েক বছরের মধ্যেই ওই ছাগলের সংখ্যা বেড়ে একটি খামারে পরিণত হয়। ধরা দিতে থাকে কাঙ্খিত সাফল্য। ছাগলের বাচ্চা ও মাংসের জন্য উপযুক্ত ছাগল বিক্রির আয় দিয়েই চলতে থাকে সংসার খরচ।

শাহাকুল জানান, কয়েক বছর আগে বিয়ে করেছেন তিনি। দাম্পত্য জীবনে এক সন্তানের জনক। পিতা-মাতা ও স্ত্রী সন্তান নিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। তারপরেও শারীরিক এ অবস্থা নিয়ে আয়-রোজগার করতে পারা গর্বের ও প্রশান্তি। হার না মানা এই প্রতিবন্ধীর স্ত্রী তারিফা খাতুন জানান, স্বামী অক্ষম হলেও তার কর্মে তিনি গর্বিত। বুঝে-শুনেই তার সঙ্গে সংসার পেতেছেন। ব্যক্তিগত ও সংসারের আবদার তেমন মেটাতে না পরলেও তাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন এটাই বড় পাওয়া বলে জানান তিনি।

শাহাকুলের পিতা জামাত আলী জানান, ছেলে দুই হাত হারানোর পর চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেক স্বেচ্চাসেবী সংগঠন তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। তারপরও ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নেয়নি ছেলে। ৫টি ছাগল থেকে এখন তার খামারে ১৫/২০টি ছাগল রয়েছে। প্রতিবছর ছাগল বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে। সংসার বেড়েছে। ফলে অনেক সময় কষ্টের মধ্যেই দিন চলে। তাই সমাজের বৃত্তবান ও সরকারি ঋণের সহযোগীতা পেলে খামারটি বাড়াতে পারবেন তিনি।

গ্রামের দুলাল মিয়া জানান, প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, এটি প্রমাণ করেছেন শাহাকুল। তার এ সাফল্যে গর্ববোধ করে এলাকাবাসী। এ ধরনের প্রতিবন্ধীদের সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতার দাবি তাদের।

সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার আশরাফুর বললেন, প্রতিন্ধীরা যাতে পরনির্ভরশী না থাকে। সেই লক্ষে কাজ করছে সরকার। যারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় তাদের ঋণ সহযোগীতার মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!