• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্গতিনাশিনী জ্যোর্তিময়ী দেবী দুর্গা


এ্যাডভোকেট সুবল চন্দ্র সাহা অক্টোবর ১০, ২০১৬, ১০:৫২ এএম
দুর্গতিনাশিনী জ্যোর্তিময়ী দেবী দুর্গা

দুর্গাপূজা বাঙ্গালী হিন্দুদের সবচাইতে বড় ধর্মীয় উৎসব। এ উৎসব প্রতিটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে বয়ে আনে এক অনাবিল আনন্দ। সর্বজনীন ও দুর্গোৎসব শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়; জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে এ দুগোৎসবকে ঘিরে বাঙ্গালীদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক সৌহার্দ-প্রীতি ও মৈত্রির বন্ধন। দেবীদুর্গা সকল দেব-দেবীর সমম্বিতা পরমা শক্তি। অসুর দমনে যিনি চন্ডী, শরণাগতদের কাছে তিনিই সাক্ষাৎ লক্ষী- স্বরূপিনী সিদ্ধি প্রদায়িনী জগম্ময়ী মা। ব্রহ্মাকে রক্ষা করার জন্য, জীবের দুর্গতি হরণ করার নিমিত্ত দুর্গা রূপ ধারন করে আর্বিভূত হন বলে তিনি দুর্গা। তিনি মাতৃজাতির প্রতি করুনাময়ী বলে তাঁকে নারী মূর্তিতে কল্পনা করা হয়। আসলে তিনি নারীও নন বা পুরুষও নন। বস্তুতঃ তিনি এক ও অভিন্ন। জীব জগতের কল্যাণের জন্য জগম্ময়ী মা দেবী দুর্গা যে রূপ ধারণ করার প্রয়োজন মনে করেন, তিনি সেই রূপই ধারণ করেন।
 
দুর্গা পুজোর কাহিনী শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে। চন্ডী গ্রন্থে তিনটি খন্ডে মোট তেরটি অধ্যায় রয়েছে। এ গ্রন্থে আদ্যাশক্তি মহামায়ার সঙ্গে দোর্দ্দন্ড দানব অসুরদের সম্মুখে যুদ্ধের বিবরন বিধৃত হয়েছে। প্রখ্যাত দার্শনিক বৈজ্ঞবাচার্য্য ড. মহামানব্রত ব্রহ্মচারীজীর মতে ‘শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থ বিজ্ঞান সম্মত শাস্ত্র। বেদাদি শাস্ত্রের মহাসত্য চন্ডী আধ্যাত্মিক পরীক্ষা অর্থাৎ সাধনার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছে।’ চন্ডীর প্রথম অংশে মধু কৈটব বধ, মধ্যম খন্ডে মহিষাসুর বধ এবং উত্তর খন্ডে শুম্ভু-নিশুম্ভু বধের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই সনাতন ধর্মে বৈদিক ও তান্ত্রিক নামে দু’টি ধারা প্রচলিত আছে। তান্ত্রিক ধারার পরিপূর্ণ রূপায়ন ঘটেছে শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থে। 

সত্যযুগে রাজা সুরথ রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে আশ্রয় নেন। সাংসারিক জ্বালা- যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ রাজা সমাধি বৈশ্যও বাড়ি ছেড়ে বনে চলে আসেন। উভয়ই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে ঋষি মেধষমুনির শরনাপন্ন হন। সত্যদ্রষ্টা মুনিবরের পরামর্শে তাঁরা দুর্গতি নাশিনী দুর্গাদেবীর পুজো  করেন। তবে এ পুজো বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হয় বলে এ পুজোকে বাসন্তী পুজো বলা হয়। ত্রেতাযুগে শ্রীরাম চন্দ্র রাবনকে সংহার করে সীতা দেবীকে উদ্ধারের জন্য শরৎকালে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। এ দুর্গা পুজোই শারদীয় দুর্গোৎসব হিসেবে প্রচলিত। শ্রী রামচন্দ্রের শরৎকালের এ অকাল বোধনই হল বর্তমান কালের শারদীয় দুর্গোৎসব। হেমন্ত ঋতুতেও মা দুর্গার আগমন ঘটেছিল। যা’ কাত্যায়নী দুর্গাপুজো নামে খ্যাত। 

মা ব্রহ্মময়ী। আদ্যাশক্তি অপরূপা শোভামন্ডিত ত্রিনয়না । অনিন্দ্য সৌন্দয্যের প্রতীক। সর্বালঙ্কারে ভূষিত দেবী দূর্গা। তিনি সর্বশক্তির আধার। মাতৃরূপে তিনি সর্বজীবে বিরাজ করেন। দশভূজা মা দূর্গার দশটি হাতে দশটি অস্ত্র শোভা পাচ্ছে। ডান হাতে ত্রিশুল , খড়গো ও চক্র। বাম হাতে শঙ্খ, ঢাল, কুঠার ও ঘন্টা। মা দুর্গা কৈলাশ থেকে মর্তলোকে একা আসেননি। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ ঐশ্বর্যের প্রতীক লক্ষী দেবী। সঙ্গে আরো রয়েছেন জনশক্তির প্রতীক ‘সিদ্ধিদাতা’ গনেশ। সঙ্গে এসেছেন আতœরক্ষা, শত্রু দমন ও বলবীর্যের প্রতীক কার্তিক। প্রতিটি শক্তির সমষ্টিরূপে দেবী দুর্গার আত্নপ্রকাশ ঘটেছে শ্রীরাম চন্দ্রের অকাল বোধনে। 

পুজা হলো শক্তির প্রতীক। দেব- দেবীর কৃপালাভের জন্য ভক্ত তাঁর অনন্তরের অন্তঃস্থলে থেকে ভক্তি সহকারে দেবতার উদ্দেশ্যে যে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন তা’ই পুজো বা উপাসনা। দেবতার প্রতীক হিসেবে প্রতিমা  পুজো হিন্দু ধর্মে প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত রয়েছে। হিন্দুরা মায়ের মৃম্ময়ী মূর্তিতে প্রান প্রতিষ্ঠা করে চিম্ময়ী জ্ঞানে পুজো করেন। তবে সেটা পুতুল পূজো নয়। ভক্তের হৃদয়ের অকৃত্রিম ভক্তি ও শ্রদ্ধায় মৃম্ময়ী মূর্তি চিম্ময়ী হয়ে ওঠে। তাই হিন্দুরা নিছক মাটিতে তৈরী মূর্তিকে পুজো করেন বলা ঠিক নয়। কালবিজয়ী প্রবাদ পুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়- ‘পুতুল পূজা করে না হিন্দু কাঠ মাটি দিয়ে গড়া মৃম্ময়ী মাঝে চিম্ময়ী হেরে যাই আত্নহারা।’

প্রতিবছর শরৎকালীন শুক্লা পক্ষীয় মহাষষ্ঠীর পূন্য তিথি থেকে শুরু হয় দুর্গা পুজো। মহাসপ্তমী,  মহাঅষ্টমী, মহানবমী তিথিত্রয়ে আরাধনা শেষে বিজয়া দশমীতে মা দুর্গা বিসর্জনের মাধ্যমে দুর্গোপুজোর সমাপ্তি ঘটে। তবে মৃম্ময়ী মূর্তির বিসর্জন হলেও ভক্তের হৃদয়ে চিম্ময়ী সত্তা চির অম্লান চির ভাস্বর হয়ে থাকে। শক্তির জাগরনই মাতৃবন্দনার আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট। শক্তি ‘স্বয়ম্ভু’। ‘স্বপ্রকাশ’। আদ্যাশক্তি মহামায়াই মহাশক্তির বিচিত্র প্রকাশ মাত্র। শক্তিই চৈতন্যের লক্ষন। প্রান বা শক্তিহীন ব্যক্তি শবদেহ মাত্র। তাই প্রাচীন ঋষিগণ সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরের শুভ শক্তির প্রতিক হিসেবে জ্যোর্তিময়ী দেবীদুর্গার আরাধনা করতেন। এ যুগেও সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্তবৃন্দ তাঁদের হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদন করে আনন্দমীয় মা দুর্গার অর্চনা করেন। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে শক্তির অস্তিত্ব সর্বত্র বিদ্যমান। সনাতন ধর্মের ঋষিগণও শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তবে উভয়ের দৃষ্টি ভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বৈজ্ঞানিক বিশ্বের সকল বস্তুতে শক্তির প্রকাশ অবলোকন করেন। আর ঋষিগণ বিশ্বাস করেন সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি একটি মহাশক্তি। বৈজ্ঞানিক এ শক্তিকে মানব কল্যানে ব্যবহার করেন। আর সনাতন ঋষি ও আধ্যাত্মিক পুরুষেরা এ শক্তিকে জীব ও জগতের হিতার্থে অর্চনা করেন। ঋষিগন সর্বশক্তির আধার মহামায়ার মধ্যে মাতৃস্নেহ দর্শন করেন। তাই তাঁরা শক্তিকে ব্যবহার না করে পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তি ভরে বিশ্বের কল্যাণার্থে অর্চনার পথ বেছে নিয়েছেন। 

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির যুগে মানুষ জড়বাদের দিকে ঝুকে পড়েছে। বৈজ্ঞানিক ও আর্যঋষিগণ মহাশক্তির অস্বিত্ব সম্পর্কে একমত। উভয়ই বিশ্বাস করেন মহাশক্তির নিয়ন্ত্রাধীনেই সারা বিশ্ব। তবে এ শক্তিকে সমগ্র মানব জাতির কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। শক্তির অপরিকল্পিত ব্যবহারে কল্যাণের পরিবর্তে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। হিংস্রাশ্রয়ী শক্তি প্রয়োগে মূহুর্তের মধ্যে গোটা বিশ্ব নিশ্চিহ্ন হতে পারে। তাই শক্তি ব্যবহারে কল্যাণকর মানসিকতা থাকতে হবে। অধুনা দুর্গা পুজোর বাহ্যিক আড়ম্বর বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। কিন্তু হ্রাস পেয়েছে পুজোর অন্তর্নিহিত আধ্যাত্নিকতা। বহিরাঙ্গের উৎসব আয়োজনের প্রতিযোগীদের অহংকার বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বিনিষ্ট হয়েছে দেবীর মাহাত্ত্য। মন্ডবে মন্ডবে ভক্তিপূর্ণ গানের পরিবর্তে আজ শোনা যায় কুরুচিপূর্ণ অশালীন সংগীত পরিবেশনা। আমাদের ভুললে চলবে না দুর্গাপুজো শুধুমাত্র বাহ্যিক আড়ম্বর অনুষ্ঠানের পুজো নয়। জাগতিক ও আধ্যাতিক জ্ঞান ও শক্তি অর্জন করাটাই এ পুজোর প্রধান উদ্দেশ্য। জাত-পাতের অভিশাপ হিন্দু সমাজকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছে। জাতিভেদ, বর্ণভেদ, কৌলিন্য প্রথা প্রভৃতি গোটা হিন্দু সমাজকে করে তুলেছে দ্বিধা বিভক্ত। 

তাই আসুন দুর্গোৎসবের এ শুভ দিনে আমরা হিংসা বিদ্বেষ পরনিন্দা ভুলে যাই। আদ্যাশক্তি মহামায়ার করুণালাভে হই উজ্জীবিত। হিংসার আস্ফালন ও মূল্যবোধের অবক্ষয় দুর করে আমরা আত্মশক্তিতে বলিয়ান হই। আমাদের অঙ্গীকার হোক আদ্যাশক্তির আর্শীবাদে আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে এক সুখী ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তুলি। যেখানে থাকবে না মানুষে মানুষে কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ। মানুষের অহংসত্তার গভীরে যে শাশ্বত বিশ্বজনীন মানব সত্তা রয়েছে, তা’ দেবী দুর্গার আর্শীবাদে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রষ্ফুটিত করে আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলি। জ্যোর্তিময়ী জগন্মাতা দুর্গা আমাদের সহায় হোন। লেখক : এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।  

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!