• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শিগগিরই


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ১৯, ২০১৭, ০৫:৪৮ পিএম
দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শিগগিরই

ঢাকা: হামলার নতুন কৌশল হিসেবে ভয়ংকর আত্মঘাতীরূপে সক্রিয় হচ্ছে জঙ্গিরা। পরপর বেশ কয়েকটি ঘটনা থেকে তারই ইঙ্গিত মিলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সম্প্রতি গ্রেপ্তার একাধিক জঙ্গি জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগাতার কয়েকটি অভিযানে তাদের শতাধিক নেতৃস্থানীয় সদস্য গ্রেপ্তার এবং প্রাণ দিয়েছে। এর জন্য দলীয়ভাবে তারা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘শায়েস্তা’ করতে এবং নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতেই তারা আত্মঘাতী হামলার পথ বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে নতুনভাবে দল গোছানোরও চেষ্টা করছে তারা।

আত্মঘাতী জঙ্গিদের হঠাৎ সক্রিয় হওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছিল জেএমবি। এরপর প্রায় ১০ বছর গোপনে কার্যক্রম চালালেও আত্মঘাতী হতে দেখা যায়নি জঙ্গিদের। সম্প্রতি জঙ্গিদের আত্মঘাতী বিস্ফোরণের ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

গত শুক্রবার রাজধানীর আশকোনায় র‌্যাবের নির্মাণাধীন সদর দপ্তরের ব্যারাকে এক জঙ্গির আত্মঘাতী হামলার পর নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গিদের নতুন এ কৌশলকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে তারা। হঠাৎ করে জঙ্গিদের আত্মঘাতী হামলা বেড়ে যাওয়ায় তা ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি হয়েছে। একই সঙ্গে শিগগিরই দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান নামছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত না রাখলে জঙ্গি তৎপরতা আরো বেড়ে যেতে পারে। জঙ্গিদের এভাবে হঠাৎ করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পেছনে দেশি-বিদেশি শক্তি সক্রিয় আছে বলেও ধারণা গোয়েন্দাদের। জঙ্গিদের অস্ত্র-গোলাবারুদের সংগ্রহে বিপুল অঙ্কের টাকার প্রয়োজন, সেই টাকার জোগানদাতাদের চিহ্নিতেরও চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সর্বশেষ সীতাকুন্ডের জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার করা সরঞ্জাম, বিভিন্ন আলামত ও হামলার ধরন থেকে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নতুন কৌশল নিয়ে এবার মাঠে নেমেছে জঙ্গিরা। আত্মঘাতী হামলায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও শক্তিশালী যেসব বোমা উদ্ধার হয়েছে, তা আগে উদ্ধার হওয়া বোমা থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী।

গত বছর জুলাই মাসে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও ঈদের দিন শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে নব্য ধারার জেএমবির কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ অন্তত ৩৫ জঙ্গি মারা যায়। ধরাও পড়ে অনেকে। এতে নব্য জেএমবির ৭০ শতাংশ শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি। কিন্তু টানা অভিযানের মধ্যেই আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জঙ্গিরা।

তবে এবার তারা আগের কৌশল বদলে ভয়ংকর আত্মঘাতী কিলিং মিশন নিয়ে ফিরেছে। হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর বেশ কয়েক মাস জঙ্গিদের দৃশ্যমান তৎপরতা ছিল না। কিন্তু উত্তরায় র‌্যাব ক্যাম্পে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার অপচেষ্টা, টঙ্গীতে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা, কুমিল্লায় শক্তিশালী বোমাসহ নব্য জেএমবির দুই সদস্য গ্রেফতার ও সীতাকুন্ডে দুটি আস্তানায় অভিযান চালানোর পর আত্মঘাতী নারী জঙ্গিসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনাই প্রমাণ করে জঙ্গিরা আবারও তৎপর হয়ে উঠেছে।

জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেররিজমের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ধারণা, ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত হুজিপ্রধান মুফতি হান্নান, আনসার আল ইসলামের জসিমুদ্দীন রাহমানী, রেদোয়ান আজাদ রানা, আল্লাহর দলের মতিন মেহেদীসহ প্রায় ২৮ জঙ্গি এখন কনডেম সেলে বন্দি। তাদের ফাঁসি নস্যাৎ করতেই জঙ্গিদের একটি গ্রুপ আত্মঘাতী হামলা চালাচ্ছে।

তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মতো বাংলাদেশেও অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে জঙ্গিরা। এ কারণে তারা তাদের অস্তিত্বকে জানানোর জন্য র‌্যাবের ওপর আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে। জঙ্গিদের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়লে এবং সদস্য সংগ্রহ স্তিমিত হলে তারা আত্মঘাতী হামলার দিকে ধাবিত হয়। এটিকে মনোবল চাঙ্গা করার একটা কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে জঙ্গিরা।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পুরুষ আত্মঘাতী স্কোয়াডের পাশাপাশি শতাধিক নারী স্কোয়াডও সক্রিয় রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সীতাকুন্ডে ছায়ানীড় বাড়িতে তারা একটি পরিবারসহ এই পরিকল্পনা নিয়েছিল। এর আগেও উত্তরার আশকোনায় এক নারী জঙ্গি আত্মঘাতী বিস্ফোরণে মারা যায়। জেএমবির জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী ধরা পড়লেও তার স্ত্রী মাহমুদা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গোয়েন্দারা বলছেন, জেএমবির মাহমুদা বেগমের নেতৃত্বে নারী আত্মঘাতী দলটি উত্তরাঞ্চলের কোনো একটি জেলায় আত্মগোপনে আছে। যেকোনো সময় তারা আত্মঘাতী হামলা চালাতে পারে। রাজীব গান্ধী গ্রেফতারের পর তার স্ত্রী সম্পর্কে বলেছে, তার স্ত্রী ইসলামের পথে নিজেকে শহীদ বলে উৎসর্গ করেছেন। তার স্ত্রীর নেতৃত্বে আরো অন্তত ১০ জন নারী ‘শহীদ’ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নারী আত্মঘাতী স্কোয়াডে শতাধিক সদস্য রয়েছে।

এদিকে বিভিন্ন অভিযানে জঙ্গিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, বোমা ও অস্ত্র উদ্ধার হলেও এদের গডফাদারদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা কার নির্দেশে হামলা চালাচ্ছে- সেটিও থাকছে অজানা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, জঙ্গিরা নিজেদের ফ্ল্যাট বিক্রি, চাকরির বেতনের টাকা ও তিলে তিলে সঞ্চয় করা স্ত্রীর গচ্ছিত টাকা দিয়ে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।

দল থেকে চাঁদা হিসেবে সংগ্রহ করা টাকাও জঙ্গিদের ফান্ডে জমা হচ্ছে। আর তা দিয়েই দেশে জঙ্গি নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে। একেকটি অভিযান শেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ‘জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক তছনছ হয়ে গেছে। তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।’ অথচ সময় যেতে না যেতেই জঙ্গিরা আবারও ভয়ংকর হয়ে ফিরছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের শেষদিকে উত্তরার আশকোনার সূর্য ভিলায় যে ধরনের বোমা পাওয়া গেছে, সে তুলনায় সীতাকুন্ড ও র‌্যাবের ক্যাম্পে বিস্ফোরিত বোমার ধ্বংসক্ষমতা কয়েক গুণ বেশি। গোয়েন্দাদের ধারণা, কোনো না কোনোভাবে জঙ্গিদের হাতে অনেক অর্থ যাচ্ছে, যা দিয়ে তারা বোমা তৈরির সরঞ্জাম কিনছে। বোমা মিজান, সাগর, সোহেল মাহফুজ নব্য জেএমবির জন্য বোমা তৈরি করছে বলে ধারণা গোয়েন্দাদের। মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি মুসাকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, দেশে জঙ্গি আছে। তারা নিষ্ক্রিয় হয়নি। তাদের কার্যক্রম প্রকাশের চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশ বসে নেই। তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে আমরা ছাড় দেব না। তারা যে ধরনের হামলার জন্য প্রস্তুতিই নিক না কেন, আমরা প্রতিরোধ করে তাদের সমূলে উৎপাটন করব।

এত দিন জঙ্গিদের বিভিন্ন দল আলাদা হয়ে কাজ করছিল। কিন্তু সম্প্রতি গোয়েন্দাদের কাছে প্রমাণ এসেছে, একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠী একত্রিত হয়ে নতুন নতুন হামলার ছক কষছে। নব্য জেএমবির ট্রেনিং নিয়েছে-এ ধরনের পাঁচটি গ্রুপ রয়েছে, প্রতিটি গ্রুপে অন্তত ২৫ করে সদস্য রয়েছে।

নতুন সদস্য তৈরি করতে ‘মগজ ধোলাই’ চলছে। এ গ্রুপটিই জঙ্গিদের ‘সুইসাইডাল স্কোয়াড’। অপারেশনে যাওয়ার আগে জঙ্গি নেতাদের কড়া নির্দেশ, ‘কোনোভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়া চলবে না।’ নেতাদের এই নির্দেশ মেনেই অপারেশনে নামছে জঙ্গিরা। এরই অংশ হিসেবে ধরা পড়ার আগেই আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করছে জঙ্গিরা।

সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার জঙ্গি আজওয়াদ পুলিশকে জানিয়েছিল, গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই সে দুই দফায় ১২টি বোমা ঢাকায় পৌঁছে দিয়েছিল। ওই বোমা কার হেফাজতে রয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই পুলিশের কাছে। আর যেসব জঙ্গি বিদেশে পালিয়েছে এবং জামিন নিয়ে লাপাত্তা তাদের খোঁজে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। পলাতক জঙ্গিদের মাধ্যমেই দেশে জঙ্গিবাদের অর্থের জোগান আসছে।

গোয়েন্দাদের কাছে অন্তত ১৮ জনের খোঁজ রয়েছে, যারা উগ্রপন্থায় জড়িয়ে এখন দেশের বাইরে। বিদেশে পলাতকরা যাতে দেশে ফিরতে না পারে সে ব্যাপারে সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে ছবিসহ তথ্য দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিদেশের মাটিতে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে মারা গেছে তিন বাংলাদেশি নাগরিক। এসব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এ বিষয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ডিসি মুহিবুল ইসলাম খান বলেন, জঙ্গিরা আবারও হয়তো কোনো না কোনোভাবে সংঘবদ্ধ হয়েছে। অনেক দিন ধরে যারা পলাতক ছিল, তারাও নতুনভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অতীতে জঙ্গিদের কার্যক্রম রুখে দেওয়া হয়েছে। এবারও তার ব্যত্যয় হবে না।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!