• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
হেফাজত তাণ্ডবের ৪ বছর

দেশব্যাপী ৮৩ মামলা, চার্জশিট মাত্র চারটিতে!


জুবায়ের চৌধুরী মে ৩, ২০১৭, ১১:৩৬ এএম
দেশব্যাপী ৮৩ মামলা, চার্জশিট মাত্র চারটিতে!

ঢাকা : রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের ওপর হামলা, সড়ক অবরোধ, হামলা-ভাঙচুরের ঘটনার চার বছর হতে চলল। ভয়াবহ সেই তান্ডবের ঘটনায় দেশব্যাপী ৮৩টি মামলা হয়। ঘটনার দুই বছরের মধ্যে ঢাকায় তিনটি ও চট্টগ্রামে একটি মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।

তবে চার বছরে দুটি বাদে ৮১টি মামলার তদন্তে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। আর বিচার? সেটা তো বহুদূর। মামলাগুলোর তদন্তের ধীরগতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত মতিঝিল ও পল্টন এলাকার ব্যবসায়ীরা।

চার বছরেও মামলাগুলোর তদন্ত শেষ না হওয়ায় হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার অভিযোগও উঠেছে নানা মহলে। গতিহীন তদন্তের মধ্যেই আসামিদের প্রকাশ্যে নানা কর্মসূচিতে অংশ নিতেও দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দাবিতে কয়েক দফা রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করতে দেখা যায়। সরকারও ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৌশল হিসেবে হেফাজতকে নতুন করে উসকে দিতে আগ্রহী হচ্ছে না বলেও দাবি অনেকের।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, হেফাজতের সঙ্গে বৈঠক মানেই তাদের মামলার বিষয়ে সমঝোতা নয়। মামলা তার নিজস্ব গতিতেই চলছে। কিন্তু হেফাজত আমির শফি বরাবরই তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, হেফাজতের আমির আল্লামা শফি কোনো মামলারই আসামি নন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ঘটনার পর হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা জুনাইদ বাবুনগরী, সাবেক এমপি মুফতি ওয়াক্কাস, মুফতি হারুন, মুফতি মমিনুল ইসলামসহ ১০ শীর্ষ নেতা এবং আরো ৭৭ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মামলায় দুই শতাধিক নেতার নাম উল্লেখসহ ৪০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। তদন্তে ইসলামী সাতটি দল ও ১০ নেতার সম্পৃক্তার তথ্যও উঠে আসে।

একপর্যায়ে ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ নির্দেশে বাকি ৭৯ মামলায় আসামি গ্রেফতার এবং তদন্ত প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। পরে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে গেছে। আসামি হিসেবে শনাক্ত ব্যক্তিরা এখন প্রকাশ্যে ঘুরছে।

এদিকে ৫ মের অভিযানে আড়াই থেকে তিন হাজার লোক শহীদ হয়েছে বলে সে সময় হেফাজতের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও সে বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেনি হেফাজত। গত চার বছরেও শহীদদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। এই দাবির পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণও দিতে পারেনি তারা।

এ বিষয়ে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, হেফাজতের সহিংসতার ঘটনায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৫৩টি মামলা দায়ের হয়। সবগুলো মামলার তদন্ত এখনো চলছে। এর মধ্যে ডিএমপিতে দায়ের করা হয় ১৮টি মামলা। এর মধ্যে ১৩ মামলার তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্তে অগ্রগতি আছে।

অন্য মামলাগুলোর তদন্ত করছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। মামলার পরে বেশ কিছু আসাসিকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ এখন জামিনে রয়েছেন। তিনি আরো জানান, হেফাজতের সন্ত্রাসী তাণ্ডবলীলার ঘটনায় প্রকৃত নাশকতাকারী এবং এদের পেছনের ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ ঘটনা ঘটায়।

এদের মধ্য থেকে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করতে কিছুটা সময় লাগছে। এ কারণে তদন্ত শেষ করে অভিযোগ দাখিল করতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে ইতোমধ্যে তিনটি মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দিয়েছে পুলিশ। অনেক মামলা তদন্ত প্রায় শেষপর্যায়ে।

এদিকে মঙ্গলবার (২ মে) রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, হেফাজত তান্ডবের নির্দেশদাতারা চিহ্নিত হয়েছে। তবে ওইদিন মাঠপর্যায়ে যারা সরাসরি তান্ডব চালিয়েছে তাদের অনেককেই এখনো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। প্রকৃত নির্দেশদাতাদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

মনিরুল বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে ঘটনার পর বিভিন্ন থানায় ৪২টি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে ২১টি পুলিশ এবং ১৯টি ভিকটিমদের স্বজনরা দায়ের করেন। কিছু কিছু মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, আবার অনেক মামলার তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে অনেক লোকের সমাগম হওয়ায় তান্ডব কারা চালিয়েছে তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। একেবারেই সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। তদন্ত শেষ হলে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

হেফাজতের তান্ডবের পর বিএনপির তান্ডবের সময় এসআই শাহজাহান ও একজন সার্জেন্ট নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলা দুটিরও তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। তদন্ত শেষ হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মামলা বৃত্তান্ত : ডিএমপি জানায়, মতিঝিলে ৩টি, পল্টন থানায় ২৩টি, রমনা ২টি, শাহবাগে ৩টি, যাত্রাবাড়ীতে ৩টি ও কামরাঙ্গীর চরে ৩টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে পরে ১৫টি মামলার তদন্ত দায়িত্ব নেয় ডিবি পুলিশ। ৫৩টি মামলার মধ্যে রমনা থানার একটি ও কলাবাগান থানার দুটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

অন্য মামলাগুলোর মধ্যে থানা পুলিশ ৩৫টি ও ডিবি পুলিশ ১৫টির তদন্ত করছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবু নগরীসহ অন্তত ৭৮ জনকে একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাদের অনেকে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন।

তবে গত তিন বছরে গ্রেফতার প্রায় সবাই জামিনে রয়েছে। ডিবির হাতে তদন্তে থাকা মামলার মধ্যে এসআই শাহজাহান হত্যা মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার ও রফিকুল ইসলাম মিয়া গ্রেফতারও হয়েছিলেন।

সেদিন কী ঘটেছিল : ২০১৩ সালের ৫ মে ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ ফাঁসি, রাসুল (সা.) ও ইসলামের অবমাননা বন্ধে আইন পাসসহ ১৩ দফা দাবিতে রাজধানীর শাপলা চত্বরে সমাবেশের ডাক দিয়ে তান্ডব শুরু করে হেফাজতে ইসলাম। হাজার হাজার হেফাজত অনুসারী পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, আওয়ামী লীগ অফিস পোড়ানো, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাটের ঘটনা ঘটায়।

সহিংসতার পর ২০১৩ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, কলাবাগান, শেরেবাংলানগর ও রমনা থানায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়। ৬ মে সকালের সহিংসতার ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও সদর থানায় আরো তিনটি মামলা হয়।

এ ছাড়া সমাবেশের দিন তৎকালীন একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ঘটনায় ৬ এপ্রিল শাহবাগ থানায় আরেকটি মামলা হয়। চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুরসহ কয়েকটি জেলায় আরো ৩০টি মামলা হয়।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির পর কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ জেগে ওঠে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি শেষে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে সরকারের উচ্চমহলে চরম উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছিল তারা।

৫ মে মতিঝিলে অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। ওই সময়ের সংঘর্ষ ও সহিংসতায় রাজধানীসহ সারা দেশে মোট ২৭ জন নিহত ও দেড় হাজারের মতো মানুষ আহত হন। পরে ওই দিন মধ্যরাতে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানের মুখে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন হেফাজতের কর্মীরা।

সোনালীনিউজ/জেডআরসি/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!