• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের জন্য কিছু ভালো মানুষ তৈরি করতে চাই


হৃদয় আজিজ নভেম্বর ২৭, ২০১৭, ০৫:১১ পিএম
দেশের জন্য কিছু ভালো মানুষ তৈরি করতে চাই

ঢাকা: সেবা তাসনিম হক। শিক্ষাজীবনে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে এলএলবি ও এলএলএম শেষ করেছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি তৎকালিন পিএসসির অধিনে সহকারী জজ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিন বছরের মাথায় ১৯৯২ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতায় মননিবেশ করেন তিনি। এরপর থেকে ঢাকার স্বনামধন্য কয়েকটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠদান করেছেন। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ‘ওয়ার্ডব্রিজ স্কুলে’ প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োজিত আছেন এই শিক্ষাবিদ। বাংলাদেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ভূমিকা ও জাতীয় পাঠ্যক্রমের সঙ্গে দূরত্ব নিয়ে কথা হয় তার সাথে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সোনালীনিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক হৃদয় আজিজ, ছবি তুলেছেন নূর-ই-মোহাম্মদ রওশন জামিল।

সোনালীনিউজ: ওয়ার্ডব্রিজ স্কুল সম্পর্কে কিছু বলুন।
সেবা তাসনিম হক: ওয়ার্ডব্রিজ স্কুলের স্বপ্ন অনেক আগেই দেখা হয়েছিল। সব শেষে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হয়। এখানে প্লে থেকে এ-লেভেল পর্যন্ত পড়ানো হয়। শুরু থেকেই অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলি দ্বারা পাঠদান দেয়া হচ্ছে।

সোনালীনিউজ: ঢাকা শহরের বড় বড় স্কুল থাকতে শিক্ষার্থীরা আপনার স্কুলে কেন আসবে?
সেবা তাসনিম হক:  অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী; যারা CIE (Cambridge International Examinations) এবং Edexcel উভয় পদ্ধতিতেই পাঠদানে দক্ষ। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও মনরম পরিবেশ। শিক্ষকরা সবাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খুবই বন্ধু-সুলভ।

এছাড়াও, আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও অন্যসব স্কুল থেকে আলাদা। এজন্য শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের পড়াশোনা করে যেন, দেশের জন্য কাজ করে। তাছাড়া, এখানকার শিক্ষার্থীদের আলাদা কোচিং দিতে হয় না। এসব সুযোগ সুবিধার সঙ্গে যারা একমত হবে, তারা অবশ্যই আমাদের স্কুলে আসবে।

সোনালীনিউজ: ওয়ার্ডব্রিজ স্কুল কী শুধু ব্যবসার দিকটি বিবেচনা করছে, নাকি প্রতিষ্ঠানটির সামাজিক কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে?
সেবা তাসনিম হক: অবশ্যই, ব্যবসা তো একটা উদ্দেশ্য আছেই। তবে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই আমাদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ব্যবসা না হলেও যে দমে যাবো তা নয়। কারণ, আমরা দেশের জন্য, কিছু ভালো মানুষ তৈরি করতে চাই।

সোনালীনিউজ: সাধারণত, আমারা দেখি সরকারি ও বেসকারি পর্যায়ের বড় বড় পদগুলোতে গ্রাম থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীরাই ভূমিকা রাখছে। সেক্ষেত্রে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীরা কী পিছিয়ে নয়?
সেবা তাসনিম হক: এই ব্যবধানের অন্যতম কারণ হলো- আমাদের স্কুলগুলোতে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়, তারা সবাই একটু ভালো পরিবার (ধনী ঘরের) থেকে আসা। ফলে তারা বেশি আদর পেয়ে বড় হয় এ জন্য তারা নিজের প্রতি নির্ভরতা শেখে না। আত্মবিশ্বাসী কম হয়। আর গ্রামের ছেলে মেয়েরা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসার কারণে, তারা নিজেরাই সব কাজ করে। ফলে নিজের কাজ নিজে করার কারণে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ফলে, তারা দেশের সব বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়ে কষ্ট করে পড়ে ওই সব পদগুলোতে জায়গা করে নিচ্ছে। 

তবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেও কিছু পরিশ্রমী শিক্ষার্থী রয়েছে। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষাও দিচ্ছে, কিন্তু, প্রশ্নপত্র বাংলা মিডিয়ামে হওয়ায় তাদের সমস্যায় পড়তে হয়। এ কারণে, ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, নয়তো বিদেশে পড়তে যাচ্ছে।

সোনালীনিউজ: সেক্ষেত্রে আপনারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছেন কি না, তাছাড়া স্কুলগুলো নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের বাংলা শেখার ওপর জোড় দেয় কিনা?
সেবা তাসনিম হক: হ্যাঁ, যেহেতু আমরা ব্রিটিশ কাউন্সেলের অধীনে, ওরা বেশ কয়েকবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি নিয়ে বসেছে। কিন্তু, এখনো কোনো ইতিবাচক কোনো কিছু আমরা পাইনি। আর স্কুলগুলোতে বাংলা শেখানো হয়, উৎসাহিতও করা হয়। তবে যদি সরকারি-বেসকারি উদ্যোগে আন্তঃস্কুল বাংলাভাষা প্রতিযোগীতা করা হতো, তাহলে শিক্ষার্থীরা আরো উৎসাহিত হয়ে নিজ ভাষা শিক্ষায় আগ্রহী হতো।

সোনালীনিউজ: সামাজিক অবক্ষয় এখন চরম পর্যায়ে, এর জন্য নৈতিকতার অবক্ষয়কেই বড় করে দেখা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে স্কুলগুলোর ভূমিকা কী রকম হওয়া উচিত, সেক্ষেত্রে আপনার স্কুলে পদক্ষপ কেমন?
সেবা তাসনিম হক: স্কুলের একটা বিরাট ভূমিকা তো অবশ্যই আছে, পাশাপাশি পরিবারেরও। কারণ, একটি শিশু কাদামাটির মত তাকে যা বানাবেন সে সেটাই হবে। ওই সময় তাকে বাবা মা যেমন- আদর-সোহাগ করবে ঠিক তেমনি শাসনও করবে। তাতেই সে পরিবার থেকেই নৈতিকতা শিখে নেবে। 

আর স্কুলগুলোতেও তেমনি, হাতে-কলমে শিক্ষা দেবে। যেমন কেউ যদি কোনো কিছু চুরি করে বা সহপাঠির সঙ্গে ঝগড়া করে তাহলে তাদের শাস্তি হোক বা বুঝিয়েই হোক টিচার তাকে নৈতিকতা শিক্ষা দেবে। আর এখানেই সে পূর্ণ জ্ঞান নেবে ভালো কোনটা, আর মন্দ কোনটা?

সোনালীনিউজ: ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে হাজার হাজার স্কুল গড়ে উঠেছে। যেগুলোর অধিকাংশই স্কুলের অনুমোদন পাওয়ার শর্ত পূরণ করছে না, সেক্ষেত্রে.
সেবা তাসনিম হক: এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর স্কুলের অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে হবে। আর্থাৎ, কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রভাবে প্রভাবিত হওয়া যাবে না।

সোনালীনিউজ: ম্যাডাম, বাল্য জীবনের স্বরণীয় ঘটনা বলুন।
সেবা তাসনিম হক: আমার মামা ছিলেন অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। তখন তার ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ সিনেমাটি মুক্তি পায়। বাবা মা আমার দুই বোনকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবে। আমি মাকে বললাম আমিও যাবো, আমাকে নিয়ে যাও। তখন সবাই প্রস্তুত হয়েছে বাইরে বের হবে আমার জেদে মা বললো যাও তুমিও বের হও। আমি রুমে গিয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় হলুদ জামাটি পরে এসে দেখি সবাই চলে গেছে। ওই দিন আমি সারাদিন কেঁদেছি। আজও আমার ওই কথা মনে পড়ে।

আর একটা স্মৃতি হলো মুক্তিযুদ্ধের সময়। আমার বাবা সরকারি চাকুরে ছিলেন। যুদ্ধের সময় আমার বড় দুই বোনকে চাচার কাছে রেখে আমাকে নিয়ে ভারত যান বাবা-মা। আমি ছোট মানুষ যুদ্ধ কী তা বুঝতাম না। বিদেশে গেছি দেশের অবস্থা খারাপ ও সব আমার মনে আসতো না। সেখানে গিয়ে স্থানীয় ছেলে মেয়েদের সঙ্গে মজা করতাম, আর বাবা-মাও আমাকে বেশ আদর করতেন। কারণ, দেশে আমার দুই বোনের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না। ভাবছে তারা হয়তো মারা গেছে তাই স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি আদর করতেন। 

আমার মনে আছে, আব্বাকে ওখানে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। সেজন্য আমাদের একটা বাড়ি দেয়া হয়েছিল যার নিচে অনেক ফাঁকা জায়গা ছিল। সেখানে একবার এলাকার লোকজনের কাছ থেকে টাকা, চাল সংগ্রহ করে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে লক্ষ্মীপূজার আয়োজন করি। সেখানে অন্যান্য হিন্দু বন্ধুদের মত আমিও পূজাকে সিজদা করতে যাচ্ছিলাম মা আমার কান ধরে ওখান থেকে উঠে নিয়ে যায়।

সোনালীনিউজ: শিক্ষর্থী ও অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
সেবা তাসনিম হক: শিক্ষার্থীদের বলবো। নিজের মনকে প্রশ্ন করে কাজ করবে। মন যাদি বলে এটা ভালো তাহলে সেটা করবে। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারলে তোমার অভিভাবকদের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করো।

আর অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলবো আপনারা সন্তানের কাছ থেকে সময় কিনবেন না। ওদের সময় দিন। ওরা আপনার থেকে ভালোভালো খাবার খেলনা চায় না, চায় সময়। চায় ভালবাসা ও শাসন।

সোনালীনিউজ: ধন্যবাদ আপনাকে।
সেবা তাসনিম হক: আপনাদেরও ধন্যবাদ।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এআই/জেএ

Wordbridge School
Link copied!