• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
সাঁওতালপল্লীতে আগুন

ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবে হুকুমদাতারা?


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ১১, ২০১৭, ০৬:৪৭ পিএম
ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবে হুকুমদাতারা?

ঢাকা: গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালপল্লীতে আগুন দেয়ার ঘটনায় দুই পুলিশকে চিহ্নিত করে পুলিশ প্রশাসনের দেয়া প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেখানকার চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতাল ও বাঙালিরা মনে করছেন, এটা প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল ও অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা। প্রশাসনের ‘আইওয়াশ’।

একইভাবে এই প্রতিবেদনকে সমগ্র ঘটনার ‘আংশিক’ ও ‘পরিপূরক নয়’ বলে মনে করছেন সাঁওতালদের আইনি ও সামাজিক সহায়তা দেয়া আইনজ্ঞ ও বিশিষ্টজনরা। এই উভয় দলের মত, সাঁওতালপল্লী থেকে উচ্ছেদের ঘটনা সুপরিকল্পিত।

সুতরাং পুলিশের এ প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে ঘটনার নেপথ্য নির্দেশদাতা অর্থাৎ পেছনে যারা করছেন, তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এর ফলে উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতাল ও বাঙালিদের সুষ্ঠু বিচার ও জমি ফেরত পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিতই রয়ে গেল। এমনকি ভবিষ্যতে এসব নির্দেশদাতার অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে উৎসাহ দেবে বলেও মনে করছেন তারা।

অবশ্য আইনজ্ঞ ও বিশিষ্টজনরা কেবল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, রংপুর ও গাইবান্ধার পুলিশ কর্মকর্তা, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব কিংবা রংপুর চিনিকলের মহাব্যবস্থাপককেই সাঁওতালপল্লী থেকে উচ্ছেদ ও সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেয়ার ঘটনার একমাত্র নেপথ্য নিদের্শদাতা হিসেবে মানতে নারাজ।

তাদের মতে, পুলিশ রাষ্ট্রের একটি সংস্থা। তারাই সেদিন উচ্ছেদে অংশ নিয়েছে ও বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। তার মানে এখানে রাষ্ট্র জড়িত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জড়িত। হুকুমের আসামি করতে হলে তাদের করতে হবে। এমনকি ঘটনার চার মাসেও উচ্ছেদ হওয়ার পর সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন সাঁওতালরা।

গত ৬ মার্চ এ ঘটনার চার মাস পূর্ণ হয়েছে। তারা বলছেন, সাঁওতালদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের দায়ের করা ছয়টি মামলায় এখনো সাঁওতালরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অথচ উচ্ছেদকারীদের বিরুদ্ধে তাদের দায়ের করা দুটি মামলায় এখন পর্যন্ত একজনকেও জেরা করার জন্য ডাকা হয়নি। বরং এসব নির্দেশদাতার কারো কারো নিরাপত্তা আরো বাড়ানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা। তারা আরো বলছেন, এখনো তাঁবু খাটিয়ে খোলা আকাশের নিচে তাদের বাস করতে হচ্ছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি সাঁওতালদের।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের নানা ধরনের সহায়তাদানকারী সংগঠন সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর স্থানীয় নেতা সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমন বাস্কের সঙ্গে। তারা তিনজনই ‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত’ করার দাবি জানিয়ে বলেন, প্রকৃত ঘটনা জানতে ও প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করতে হলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রয়োজন।

অবশ্য এসব অভিযোগ মানতে নারাজ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও গাইবান্ধা সাঘাটার আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া। তিনি বলেন, যে ঘরগুলোতে পুলিশকে আগুন দিতে দেখা গেল, সেগুলো প্রকৃতপক্ষে কলাপাতা দিয়ে তুলে রাখা হয়েছিল। সেগুলো তো বাড়িঘর নয়। সুতরাং কাদের বাড়িতে কে আগুন দিলো, সেটিই তো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

তাছাড়া সাঁওতালদের যে উচ্ছেদের কথা বলা হয়, সেটি তো আসলে চিনি কলের জমি। অনেক আগেই ক্ষতিপূরণ নিয়ে সাঁওতালরা সরে গেছে। সুতরাং সেখানে তো তাদের বাড়িঘর থাকার কথা নয়। তা হলে আগুনের প্রশ্ন আসে কেন? তাছাড়া পুলিশ তদন্ত করছে। তবে আমি চাই বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক। তাহলেই প্রকৃত বিষয় উঠে আসবে।

গত বৃহস্পতিবার চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদের সময় সাঁওতালদের ঘরে আগুন দেয়ার ঘটনায় গাইবান্ধার দুই পুলিশ সদস্যকে চিহ্নিত করে আদালতে দুটি প্রতিবেদন দেয় পুলিশ প্রশাসন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাইবান্ধা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এসআই মাহবুবুর রহমান ও গাইবান্ধা পুলিশ লাইনসের কনস্টেবল মো. সাজ্জাদ হোসেন সেদিন সাঁওতালদের ঘরে অগ্নিসংযোগ করেন বলে পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।

‘হুকুমদাতা কারা’ জানতে চাইলে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, পুলিশ রাষ্ট্রীয় সংস্থা। সুতরাং পুলিশ জড়িত মানে রাষ্ট্র জড়িত। রাষ্ট্রকে এ দায় নিতে হবে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। তা না হলে সমাধান হবে না।

এ ব্যাপারে সাঁওতাল নেতা ফিলিমিন বাস্কে বলেন, পুলিশ প্রশাসনের এই প্রতিবেদন প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা। এটি প্রশাসনের ‘আইওয়াশ’। কিন্তু মানুষ তো অত বোকা নয়। তাদের চোখ-কান খোলা। তাদের বিবেক আছে। প্রকৃতপক্ষে সেদিন যারা ছিল জনপ্রতিনিধিসহ কর্মকর্তারা সবাই দায়ী। এ দায় তারা এড়াতে পারবেন না। তাদের আইনের আওতায় আনতে হলে পুলিশ বাদ দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দরকার। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপও কামনা করেন।

১৯৬২ সালে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের এক হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। ওই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে তার দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামে সাঁওতালরা।

পরে সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে বিরোধপূর্ণ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে কয়েকশ’ ঘর তুলে বসবাস শুরু করে তারা। গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন সাঁওতাল, আহত হন অনেকে। পরে দুটি রিট আবেদন হলে বিষয়টি হাইকোর্টে আসে।

ঘটনার প্রায় এক মাস পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা একটি ভিডিওর ভিত্তিতে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। ওই ভিডিওতে দু’জন পুলিশ সদস্যকে সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিতে দেখা যায়। এ প্রেক্ষাপটে এক রিট আবেদনকারীর সম্পূরক আবেদনে হাইকোর্ট বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিলে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ প্রতিবেদন দুটি তাদের প্রতিবেদন দুটি বৃহস্পতিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাইকোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। পরে আদালত শুনানি করে প্রতিবেদন দুটি নথিভুক্ত করেন।

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাকিল আলম বুলবুলের নেতৃত্বে পূর্বপরিকল্পিতভাবে সাঁওতালদের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল বলে দাবি এলাকাবাসীর। অথচ এই বুলবুল এক সময় সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার কমিটির সভাপতি ছিলেন।

ঢাকা থেকে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির আট সদস্যের একটি দল সরেজমিনে গিয়ে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়। কমিটি জানায়, বুলবুল বর্তমানে এমপির ডানহাত। সাহেবগঞ্জ সাঁওতালপল্লীতে হামলা চালানোর আগে মাইকে ঘোষণা দিয়ে পল্লীর সব কটি বাড়িতে লুটপাট এবং কাউকে ছাড় না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন এই বুলবুল।

কমিটি আরো জানায়, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় পুলিশের সহায়তায় স্থানীয় চেয়ারম্যান বুলবুলের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী সাহেবগঞ্জে আদিবাসী-বাঙালির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা পল্লীতে ছয়শ’ ঘর ও স্কুলে অগ্নিসংযোগ করে। এটি মোটেও আখ কাটতে গিয়ে বাধা দেওয়ার ফলে সৃষ্ট কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। পুলিশ প্রহরায় আখ কাটতে যাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। আদিবাসী-বাঙালিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করার জন্যে পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!